এই আরবী অনুবাদ চৌদ্দ শতকের মিশরেও ছিল সুপরিচিত। চৌদ্দ শতকে মিশরের সূফী মুহম্মদ আল মিসূরী অমৃতকুণ্ডের উল্লেখ করেছেন।(৯) মুসলিম জগতের সর্বত্র জনপ্রিয় হয় এ গ্রন্থ। তাই ভারত থেকে মিশর অবধি সব জায়গায় মিলেছে এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি।
অমৃতকুণ্ড কামরূপের গ্ৰন্থ কামরূপবাসী ভোজবৰ্মণ ও অম্ভরানাথের সাহায্যে প্রাপ্ত ও অনুদিত। এতে অনুমান করা চলে যে যোগী ব্ৰাহ্মণ নন–বৌদ্ধ। গ্রন্থটি সম্ভবত প্রাকৃতে কিংবা অবহট্টে রচিত ছিল। হিন্দু যোগ-শাস্ত্রীয় গ্ৰন্থ হলে এটি দেশে অবহেলায় লোপ পেত বলে মনে হয় না। বিশেষ করে অমৃতকুণ্ডে বর্ণিত সৃষ্টিপত্তন ও মানব জন্ম রহস্য যোগ্যতান্ত্রিক বৌদ্ধ ঐতিহ্য ধারার সঙ্গেই মেলে বেশী। তা’ ছাড়া আরবী অনুবাদের উপক্ৰমে ‘কামরূপে বিদ্বান ও দার্শনিকদের বাস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে : … … Kamrup the extreme territory of Hind where lived its famed men and philosophers and one of them came out to hold discussions with the learned divines of Islam. His name was Bhojar Brahmin etc.(১০) আবার অমৃতকুণ্ড গোরক্ষশিষ্যদের শাস্ত্ৰ গ্ৰন্থ বলে উল্লেখ করেছেন মোহসেন ফানী।(১১) সেকালে ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের তথা সমাজের প্রভাব ছিল না কামরূপে। ওটি ছিল বৌদ্ধ বজ্ৰযান-তান্ত্রিক-সহজিয়া-যোগীর প্রাণকেন্দ্র। আর ব্ৰাহ্মণ সম্ভবত বর্মণের বিকৃতি। কামরূপের বর্মণরাজারা পূর্ববঙ্গেও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।(১২)
অমৃতকুণ্ডের সূচীপত্র দেখলেই এর বিষয়বস্তু জানা যাবে। দশ অধ্যায়ে এবং পঞ্চাশটি শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে বিষয়গুলো :
অধ্যায় ১. জীবসৃষ্টি On the Knowledge of Microcosm.
অধ্যায় ২. জীবসৃষ্টির রহস্য On the Knowledge of the secrets of Microcosm.
অধ্যায় ৩. On the Knowledge of mind & its meaning.
অধ্যায় ৪. অনুশীলন ও তার পদ্ধতি of the exercises and how to practise them.
অধ্যায় ৫. শ্বাসক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি of breathing and how it should be done.
অধ্যায় ৬. বিন্দুধারণ On the preservation of semen.
অধ্যায় ৭. চিত্তচাঞ্চল্য On the knowledge of whims
অধ্যায় ৮. মৃত্যুলক্ষণ On the symptoms of death.
অধ্যায় ৯. ইন্দ্রিয় দমন On the subjugation of spirit.
অধ্যায় ১০. ইন্দ্রিয় ও মানস জগতের বর্ণনা On the continution of the physical and Metaphsical world.
তেরো-চৌদ্দ শতকের সূফী সাধক শরফুদ্দীন বু আলি কলন্দর (মৃত্যু : ১৩২৬ খ্ৰীঃ কবর পানিপথে) আরবী-ফারসী পরিভাষা সমন্বিত একটি মুসলিম যোগ-পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। ‘যোগ কলন্দির’ নামে প্ৰখ্যাত হয় তা। বিশেষ করে, বাঙলা দেশে আজো তা বিরল নয়। ‘চণ্ডীমঙ্গলে’ মুকুন্দরাম কলিন্দরিয়া ফকিরের বাহুল্যের আভাস দিয়েছেন। (ঋণ কড়ি নাহি দেও, নহ কলন্দর, কলন্দর হৈয়া কেহ ফিরে দিবারাতি)। আর ‘যোগ কলন্দর’ পুথির বহুল প্ৰাপ্তি ও কলন্দরিয়া সূফীমতের অন্তত যোগ-পদ্ধতির বহুল প্রসার প্রমাণ করে।(১৩)
আমবা পূর্বেই বলেছি, পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্ব ভারতের আদিম তত্ত্ব। এই তত্ত্বের আচারিক দিক হল যোগপদ্ধতি। আর্য ধর্ম এবং সংস্কৃতির চাপেও তা’ বিলুপ্ত হয়নি। মহাভারতে এ স্বীকৃতি রয়েছে :
সাংখ্যঞ্চ যোগঞ্চ সনাতনে দ্বে।
দেবশ্চ সর্বে নিখিলেন রাজন।।(১৪)
ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ও বলেন–Some of the fundamental things in Brahmanical Hinduism, like worship of siva and Uma, Visnu and Sri and Yogo philosophy and practice came from the dravidian speakers.(১৫) তাঁর মতে ব্যাস, কৃষ্ণ বাসুদেব, পূজাপদ্ধতি প্রভৃতিও অনার্য। ১৬ বৌদ্ধ ও জৈন আন্দোলন হচ্ছে আর্য তথা ব্ৰাহ্মণ্য দেব, দ্বিজ ও বেদদ্রোহী অভু্যুথান। যোগ ও তন্ত্র নবজীবন লাভ করে বৌদ্ধ যুগে। বিশেষত তিব্বতীনেওয়ারী প্ৰভাবে তা’ কাশ্মীর থেকে বাঙলা-আসাম অবধি হিমালয় প্ৰাস্তিক দেশে প্রবল হয়ে উঠে। ফলে এসব অঞ্চলে ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থান কালে ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মেরও অঙ্গ হিসেবে স্থিতি লাভ করে তা।
মুসলিম বিজয়ের পরে ভারতিক সূফীমতেরও অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠে এই যোগ। ফলে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম সমাজে যোগ সামান্য আচারিক পার্থক্য নিয়ে সমভাবে গুরুত্ব পেতে থাকে। এক কথায় অধ্যাতন্ত্ৰ সাধনার তথা মরমীয়া বাদের ভিত্তিই হল যোগ-পদ্ধতি। বৌদ্ধ সিদ্ধা, সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া নাথপন্থী, হিন্দু শৈব, শাক্ত, মুসলিম সূফী ও হিন্দু-মুসলিম বাউলদের মধ্যে আজো তা অবিরল। বাঙলা চর্যাপদে, শ্ৰীকৃষ্ণ কীৰ্তন, গোর্থসংহিতায়, যোগীকাচে, চৈতন্যচরিতে, মাধব ও মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে, সহদেব ও লক্ষ্মণের অনিল পুরাণে, বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলে, গোবিন্দ দাসের কালিকা মঙ্গলে, দ্বিজ শক্ৰয়ের স্বরূপবর্ণনে, আর, যোগাচিন্তামণি, বাউল গান, প্রভৃতি সব গ্রন্থে ও রচনায় যোগ আর যোগীর কথা পাই।
মুসলমান লেখকদের মধ্যে শেখ ফয়জুল্লাহ, সৈয়দ সুলতান, হাজী মুহম্মদ, আলাউল, শেখ জাহিদ, শেখ জোঁৰু, আবদুল হাকিম, শেখচাদ, যোগকলন্দরের অজ্ঞাত লেখক, আলিরাজা, শুকুর মাহমুদ, রমজান আলী, রহিমুদ্দিন মুনসী প্রভৃতিকে যোগ-পদ্ধতির মহিমা কীর্তনে মুখর দেখি। আলি রজার ‘জ্ঞানসাগরে’ আছে :