দেখিতে না পারি যারে তারে বলি শূন্য
তাহারে চিন্তিলে দেখি পুরুষ হএ ধন্য।
নাম শূন্য কাম শূন্য শূন্যে যার স্থিতি
সে শূন্যের সঙ্গে করে ফকির পিরীতি।
শূন্যেত পরম হংস শূন্যে ব্ৰহ্মজ্ঞান
যথাতে পরম হংস তথা যোগ ধ্যান।(৬) [জ্ঞান প্ৰদীপ]
ণ. পরকীয়া প্রেমসাধনা তথা বামাচারী যোগ সাধনাও কারো কারো স্বীকৃতি পেয়েছে :
স্বকীয়া সঙ্গে নহে অতি প্ৰেমরস
পরকীয়ার সঙ্গে যোগ্য প্রেমের মানস।(৭) [জ্ঞান সাগর]
ত. ঘৰ্ম থেকেই যে সৃষ্টি পত্তন, তা’ সব বাঙালী সূফীই মেনে নিয়েছেন।
সৃষ্টিতত্ত্ব, যোগ ও দেহচর্যা
১
আগেই বলেছি, জীবচৈতন্যের স্থিতি দেহাধার বিহীন হতে পারে না–এ সাধারণ বোধ থেকেই মানুষ দেহ সম্বন্ধে হয়েছে কৌতুহলী। আধেয় চৈতন্যের স্বরূপ দেহাধার বিশ্লেষণ করেই উপলব্ধি করা সম্ভব। তাই গোড়া থেকেই দেহের অন্ধি-সন্ধি বুঝবার প্রয়াস পেয়েছে মানুষ। জীবের জন্মরহস্য, গৰ্ভে দেহ গঠন ও প্ৰাণের সঞ্চার প্রভৃতি বিষয়ে মানুষের বিচিত্র চিন্তা ও অনুমান বিধৃত রয়েছে শাস্ত্রে, সাহিত্যে ও লোকশ্রুতিতে।
ঋগ্বেদের কথাই ধরা যাক। নৈষধ সূক্তে আছে, “আদিতে সর্বত্র অন্ধকার ও জল বিরাজ করত। তার মধ্য থেকে তপঃ প্রভাবে পরব্রহ্মের উদ্ভব হল। ইনি হিরণ্যগৰ্ভ এবং পৃথিবী ও আকাশের কর্তা ও দেবেন্দ্র।”
শামীয় জগতে ‘চিরন্তন ভাবসত্তা’ স্রষ্টার হুকুমেই গড়ে উঠেছে সৃষ্টি। এই সৃষ্টা জ্যোতিস্বরূপ। চীনাদের প্রাচীন মত এই যে নারী পুরুষের (yin ও yang) সহযোগেই সম্ভব হয়েছে সৃষ্টি। এঁদেরই অদ্বয় রূপ Talikelih, ভারতের অনাৰ্য পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্বও এর অনুরূপ। পুরুষ-প্রকৃতি চিন্তাধারার ক্ৰমবিকাশে শিব-শক্তি, বিষ্ণু-লক্ষ্মী প্রভৃতি তত্ত্ব রূপ নিয়েছে।
বৌদ্ধ সৃষ্টিতত্ত্ব এরূপ : জলময় অন্ধকার অবস্থা থেকেই অনাদি শক্তি গড়ে উঠে, এবং তাঁর ইচ্ছা থেকে কায়াধারী আদিনাথ ও নিরঞ্জনের উদ্ভব। আদি শক্তির ঘর্ম থেকে জল, জল থেকে কূর্ম, তারপর হংস, তারপর উলুক, তারপর হল বাসুকীয় জন্ম এবং আদিনাথের মন থেকে আদ্যাশক্তির উদ্ভব। এই আদ্যাশক্তিই জন্ম দিলেন শিব, বিষ্ণু ও ব্ৰহ্মার। আবার শিব ও শক্তি থেকে দেব-মানবের সৃষ্টি।
অহোমেরা, পলিনেশীয়রা, ধর্মঠাকুরের পূজারীরা ও নাথেরা উক্তরূপ সৃষ্টি পত্তনে বিশ্বাসী। আর্যদের সৃষ্টি তত্ত্বেরও মিশ্রণ ঘটেছে এর সঙ্গে। তাই শূন্য পুরাণ, গোরক্ষাবিজয়, আদ্যপরিচয় প্রভৃতি গ্রন্থে একই তত্ত্ব পাই।
যোগ-তান্ত্রিক সাধনায় সৃষ্টিতত্ত্বের গুরুত্ব কম নয়। বাঙলা দেশের সূফীতত্ত্বেও দেশী প্রভাবে সে ঐতিহ্য অবহেলিত হয়নি। সৃষ্টি রহস্য বিমুগ্ধ মনে জাগিয়েছে বিচিত্র চিন্তা। কেউ ভেবেছে নারী-যোনিই সৃষ্টির উৎস, কেউ জেনেছে। পুরুষের লিঙ্গই সৃষ্টির আকর, আবার কেউ কেউ নারী-পুরুষের মিলনেই সৃষ্টি সম্ভব বলে মেনেছে; পুরুষ-প্রকৃতি yin-yang, প্রজ্ঞা-উপায়, শিব-শক্তি, ব্ৰহ্মা-মায়া, বিষ্ণু-লক্ষ্মী প্রভৃতি তত্ত্বের উন্মেষ এমনি ধারণা থেকেই।
আবার স্রষ্টর হুকুমেই সৃষ্টি–এ তত্ত্বটিও সামীয় গোত্রগুলোর সাধারণ আস্থা অর্জন করেছে। “একোহিম বহুস্যাম’ তত্ত্বও বিকশিত মননে হয়েছে সম্ভব। এর পরও রয়েছে আলো-অন্ধকার তত্ত্ব সত্ত্ব-রজঃ-তম বাদ আর সুন্দর কুৎসিত, ভাল-মন্দ, মিত্ৰ-অরি এবং কল্যাণ অকল্যাণ তত্ত্ব। অনস্তি ত্ব, অসুন্দর ও অকল্যাণই অন্ধকার আর সৃষ্টিশীলতা, আনন্দ, সত্য, শিব ও সুন্দরই আলো। এই জ্যোতিতত্ত্বে বাহ্য অনৈক্য থাকলেও মৌল অর্থে কোথাও কোন অমিল নেই।
জোরাষ্ট্ৰীয় মতে দেহে রয়েছে : চৈতন্য (Conscience), প্ৰাণ-শক্তি (Vitaliforce), আত্মা (Soulemind), বিবেক (spirit>reason), আর ফরাবশী (Farawalshi ভগবদাসক্তি স্বরূপ),–যদি সৎচিন্তা, সৎকথা ও সৎকর্মের মাধ্যমে পরিচর্যা পায়, এগুলোই তাহলে আদি জ্যোতি (Primal Light) তথা পরব্রহ্মের সঙ্গে অদ্বয় এবং অবিনশ্বর হয়।(১) ভারতিক যোগেও পাই— “Plane of physical body, Plane of Ethical Double, Plane of Vitality, Plane of Emotional Nature. Plane of thoutht, Plane of Spiritual soul-Reason, the plane of pure Spirit,(২) যোগের আট-বিভূতি;(৩) অনিমা (অণুবৎ হওয়া), মহিমা (বৃহৎ), লঘিমা (light), গরিমা (Heavy), প্রাপ্তি। প্রকাম্য (obtaining pleasure), ঈশত্ব, বশীত্ব।
সূফীরা ভারতিক যোগের আলোকে একে বিভিন্ন মোকামে ও মঞ্জিলে ভাগ করেছেন! World of body নাসুত (দেহলোক), world of pure intelligence মলকুত (বৌদ্ধলোক); world of power জবরুত (শক্তিলোক), the world of negation লাহুত (ফানা বা আত্মবিলোপের জগৎ), the world of Absolute Silence হাহুত (বাকাবিল্লাহ তথা অদ্বয় অবস্থা)।(৪)
২
তেরো শতকের গোড়া থেকেই ভারতিক যোগ ও বেদান্তদর্শনের প্রভাব ইরানী তথা মুসলিম সূফীদের উপর গভীরভাবে পড়তে থাকে। কামরূপের ভোজর ব্ৰাহ্মণ (ভোজবৰ্মণ?) নামে এক ব্ৰাহ্মণ (বৌদ্ধতান্ত্রিকত্ব) যোগীর প্রদত্ত ‘অমৃতকুণ্ড’ নামে যোগী-তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের এক সংস্কৃত গ্ৰন্থ লখনৌতীর শাসক আলি মরদানে খলজীর (১২১০-১৩) আমলের লখনৌতীর কাজী রুকনুদ্দীন সমরখন্দী (১২১০-১৮; ১২১৯ খ্ৰীষ্টাব্দে বোখারায় মৃত্যু হয়) ফারসী ও আরবীতে অনুবাদ করেন।(৫) পরে কামরূপের অপর ব্ৰাহ্মণ অম্ভব নাথের সাহায্যে আর এক অজ্ঞাত সূফীও আরবীতে তৰ্জমা করেন এ গ্রন্থ। Brocklemann-এর মতে এই অনুবাদক দামস্কের সূফী ইবনুল আরবী।(৬) শাত্তারিয়া খান্দানের সূফী গোয়ালিয়রের শেখ মুহম্মদ গাওসীর (মৃত্যু ১৫৬২) প্রবর্তনায় তাঁর শিষ্য মুহম্মদ খাতিরুদ্দীন ‘বহর-অল-হায়াৎ’(৭) নামে পুনরায় এই গ্ৰন্থ অনুবাদ করেন ফারসীতে। এবার সহযোগী ছিলেন কামরূপ বাসী কনাম (Kanama)। কাজী রুকনুদ্দীন সমর খন্দীর পুরোনাম ছিল কাজী রুকনুদ্দীন আবু হামিদ মুহম্মদ বিন মুহম্মদ আলি সমরখন্দী। ইনি ছিলেন বোখারা বাসী। বাঙলায় ছিলেন ১২১০ থেকে ১২১৮ খ্রীস্টাব্দ অবধি। ১২১৯ সনে বোখারায় তিনি দেহত্যাগ করেন।(৮)