হাল
হাল হচ্ছে সাধনার সিদ্ধিস্বরূপ আল্লাহর দান। মানুষের মোকাম সাধনা যদি অকৃত্রিম ও নিখুঁত হয়, তাহলে আল্লাহ তাকে সাধনানুরূপ ফল দান করেন। অতএব মোকাম হচ্ছে সাধ্যকর্ম আর হাল হল সাধ্যফল। হুজুইরী এ সম্পর্কে বলেন, “State (Hal) on the otherhand, is something that descends from God into man’s heart, without his being able to repcal it when it comes, or to attract it when it goes, by his own effort. Accordingly, while the term “statuion’ denotes the way of the seeker and his progress in the field of exertion, and his rank before God in proportion to his merit, and the term “state’ denotes the favour and grace which are god bestows upon the heart of his servant, and which are not connected with any mortification on the latter’s part. ‘Station’ belongs to the catagory of acts, state to the catagory of gifts. Hence the man that has a station stands by his own self mortification, whereas a man that has a “state’ is dead to ‘self” and stands by a ‘state’ which god creats in him ।(৩)
এই হাল দ্বিবিধ : ধ্যান, আল্লাহর সান্নিধ্যবোধ, গ্ৰীতি, ভয়, আশা, বিরহবোধ বা ব্যাকুলতা (উদ্বিগ্নতা) এবং ঘনিষ্ঠতা, শান্তি, সমাধি ও নিশ্চিতভাব। “The states or ahwal’ are meditation, nearncss to God, love, fear, hope, longing, intimacy, Tranquility, contemplation and certainty.”(৪)
সূফীর দেহতত্ত্ব, মোকাম-মঞ্জিল, হাল ও দর্শনের দেশী অবয়ব
বৌদ্ধতন্ত্র ভিত্তি করেই হিন্দুতন্ত্রের উদ্ভব। আবার হিন্দু-বৌদ্ধ তন্ত্রের প্রভাবে বাঙালী সূফীর যৌগিক কায়াসাধনের উদ্ভব। বাঙালী সূফীরা দুইকূল রক্ষার প্রয়াসে দেহতত্ত্ব ও সাধন চৰ্যার অসমন্বিত মিলন ঘটিয়েছেন। ফলে মোকাম, মঞ্জিল, হাল, সূফীতত্ত্ব প্রভৃতি নতুন তাৎপর্য লাভ করেছে তাদের চিন্তায়। বাঙলাদেশের বাইরে কলন্দির ও কবীরই প্ৰথম সমন্বয়কারী। তাদের শিষ্য-উপশিষ্যের হাতে বাঙলায়ও বৌদ্ধ-হিন্দু প্রভাবিত অধ্যাত্ম সাধনা শুরু হয়। এ প্রভাবের কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
ক. বৌদ্ধ চর্তুকায়ের আদলে তন লতিফু, তন কসিফু, তন ফানি এবং তন বকাউ কল্পিত।
খ. আবার চার ‘দীল’ও পরিকল্পিত হয়েছে ; দীল আম্বরী (বক্ষের দক্ষিণাংশে), দীল সনুকরী (বক্ষের বামাংশে), দীল মুজাওয়ারী (মস্তকে), দীল নিলুফারী (উদর ও উরুর সন্ধিস্থলে)। এটিও বৌদ্ধ চার তত্ত্বের–আত্মতত্ত্ব, মন্ত্রতত্ত্ব, দেবতাতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্বের অনুকৃতি। আবার হারিস, মারিস, মুকিম ও মুসাফির–এই চার রুহও হয়েছে কল্পিত। [তালিবনাম]
গ. হিন্দুর ষটচক্র এবং ষড়পদ্মও স্বীকৃত। বিশেষ করে মূলাধার মণিপুর, অনাহত ও আজ্ঞাচক্রের বহুল প্রয়োগ সর্বত্র সুলভ।
ঘ. কুণ্ডলিনী ও পরশিবশক্তিকে এঁরা অভিহিত করেছেন জ্যোতি (লতিফা) নামে।
ঙ. আবার ষড়পদ্মের আদলে ষড় লতিফ’ও কল্পনা করা হয়েছে ; কলুবি (হৃদয়, রুহ, আত্মা), সির (গুপ্তহৃদয়) খাফি (গুপ্ত আত্মা) কস্ফ (বিবেকী আত্মা) ও নাফীস (দুষ্পপ্রবৃত্তি)। এগুলো বিশেষ করে নকশবন্দীয়া খান্দানের পরিকল্পিত।(৫ রুহও চার প্রকার–ক, নাতকি, খ, সামি, গ, জিসিমি ও ঘ, নাসি। [সির্নামা]
চ. ইড়া (গঙ্গা), পিঙ্গল (যমুনা) ও সুষুম্না (সরস্বতী) নাড়ী এবং প্ৰাণ-অপান বায়ুর (দমের) নিয়ন্ত্রণ ও উল্টা সাধনা এদের লক্ষ্য।
ছ. চক্রের অধিষ্ঠাত্রী বৌদ্ধদেবতা লোচনা, মামকী, পাণ্ডুরা, তারার মতো কিংবা হিন্দুতন্ত্রের চক্রদেবতা ব্রহ্মা-ডাকিনী, মহাবিষ্ণু-রাকিনী, রুদ্র-লাকিনী, ঈশ-কাকিনী প্রভৃতির মতো চর্তুদ্বারের জন্যে জিব্রাইল, মিকাইল, ইস্রাফিল ও আজাইল-এই চার ফিরিস্তা প্রহরীরূপে কল্পিত।
জ. হিন্দুর মন্ত্ৰ-তন্ত্র, সঙ্গীতাদি প্রায় সব শাস্ত্র ও তত্ত্ব যেমন শিবপ্রোক্ত বলে বর্ণিত, তেমনি মুসলমানদের কাছে রসুলের পরেই আলির স্থান এবং সব ইসলামী গৃহ্যতত্ত্বই আলিপ্রোক্ত।
ঝ. শরীয়ৎ-নাসূত, তরিকত-মলকুত, হকিকত-জবরুত, মারফত-লাহুত ও হাহুত প্রভৃতি নাম রক্ষিত হয়েছে বটে, কিন্তু তত্ত্ব ও তাৎপর্যের পরিবর্তন হয়েছে।
ঞ. অদ্বৈততত্ত্ব তথা সৰ্বেশ্বরবাদ সর্বত্রই স্বীকৃত। এবং বাকাবিল্লাহ লক্ষ্যে সাধনাও দুর্লক্ষ্য নয়। ‘হমহ্ উস্ত’ (সবই আল্লাহ) বিশ্বাসে এবং হাহুত (পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম-অবস্থা) লক্ষ্যের সাধনায় বৌদ্ধ নির্বাণবাদ এবং বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদের প্রত্যক্ষ অনুকৃতি লক্ষণীয়।
ট. আসন, ন্যাস, প্রাণায়াম, জপ প্রভৃতিও হয়েছে সূফীদের যিকরের অপরিহার্য অঙ্গ। রেচক, পূরক ও কুম্ভক সূফীদের দম নিয়ন্ত্রণচর্যার অঙ্গ।
ঠ. ‘পীরবাদ’ চালু হয়েছিল বৌদ্ধগুরুবাদের প্রভাবেই। বৌদ্ধ-হিন্দু প্রভাবে সূফী সাধনায় পীরের উপর অপরিমেয় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ফলে অধ্যাত্ম-সাধনা মাত্ৰই গুরুনির্ভর। গুরুর আনুগত্যই সাধনায় সিদ্ধির একমাত্র পথ।
ড. প্রর্বত, সাধক ও সিদ্ধির অনুকরণেই সম্ভবত রাবিতা (গুরু সংযোগ) মুরাকিবাহ্ (আল্লাহ্র ধ্যান) তথা ‘ফানাফিশশেখ’ ও ফানাফিল্লাহ পরিকল্পিত।
ঢ. আল্লাহ্কে বৌদ্ধ ‘শূন্য’-এর সঙ্গে অভিন্ন করেও ভেবেছেন কোনো কোনো সূফী সম্প্রদায়: