সূফীর সৰ্বেশ্বরবাদ আর বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদ অভিন্নরূপ নিল চৌদ-পনেরো শতকের মধ্যেই। আচার ও চর্যার ক্ষেত্রেও ঐক্য স্থাপিত হল যোগ-পদ্ধতির মাধ্যমে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এ অভিন্নতা প্ৰথম আমরা প্ৰত্যক্ষ করি। কবীরের (১৩৯৮-১৪৪৮) মধ্যেই। এই মিলনের বিরোধী আন্দোলনও গড়ে উঠে শতোধৰ্ব্ব বছর পরে “মুজদ্দদই-ই-আলফা-ই-সানী’ আহমদ সরহিন্দীর (১৫৬৩-১৬২৪) নেতৃত্বে। কিন্তু সর্বব্যাপী হতে পারেনি সে-সংস্কার আন্দোলন। নকশবদীয়া এবং কিছুটা কাদেরিয়া সম্প্রদায়েই প্রধানত সীমিত ছিল এ সংস্কার আন্দোলন। আলফা সানী স্বয়ং একজন নকশবদীয়া। দেশী তত্ত্বচিন্তা ও চর্যার সঙ্গে ইসলামের বহিরাবয়বের মিলন ঘটানোর চেষ্টায় তা পরিণতিলাভ করে বাঙলায়। সৈয়দ সুলতান ও তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে এই প্ৰচেষ্টাই লক্ষ্য করি।
ভারতীয় যোগ-চৰ্যা ভিত্তিক তান্ত্রিক সাধনার যা কিছু মুসলিম সূফীরা গ্ৰহণ করলেন তাকে একটা মুসলিম আবরণ দেবার চেষ্টা হল, তা অবশ্য কাৰ্যত নয়, নামত। কেননা, আরবী-ফারসী পরিভাষা গ্রহণের মধ্যেই সীমিত রইল এর ইসলামী রূপায়ণ। যেমন নির্বাণ হল ফানা, কুণ্ডলিনীশক্তি হল নকশবন্দীয়াদের লতিফা। হিন্দুতন্ত্রের ষড়পদ্ম হল এঁদের ষড় লতিফা বা আলোককেন্দ্র। এঁদেরও অবলম্বন হল দেহচর্যা ও দেহস্থ আলোর উর্ধায়ন। পরম আলো বা মৌল আলোর দ্বারা সাধকের সর্ব শরীর হয়ে উঠে আলোকময়–এ হচ্ছে এক আলোকময় অদ্বয়সত্তা। এর সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় “সামরস্য” জাত সহজাবস্থার, সচ্চিদানন্দ বা বোধিচিত্তাবস্থার।(৫১)
ভারতিক প্রভাবে যোগীর ন্যাস, প্ৰাণায়াম ও জপের রূপ নিল সূফীর যিকর। বহির্ভারতিক বৌদ্ধ প্রভাবে (ইরানে, সমরকন্দে, বোখারায়, বলখে) এ ভারতিক বৌদ্ধ প্রভাবে বৌদ্ধগুরুবাদও (যোগ-তান্ত্রিক সাধকদের অনুসৃতি বিশে) অপরিহার্য হয়ে উঠল। সূফী সাধনায়। সূফী মাত্রই তাই পীর-মুশীদি নির্ভর তথা গুরুবাদী। গুরুর আনুগত্যই সাধনায় সিদ্ধির একমাত্র পথ। এটিই কবর পূজারও (দরগাহ বৌদ্ধভিক্ষুর স্তুপ” পূজারই মতো হয়ে উঠল) রূপ পেল পরিণামে। আল্লাহর ধ্যানের প্রাথমিক অনুশীলন হিসাবে পীরের চেহারা ধ্যান করা শুরু করেন। সূফীরা। গুরুতে বিলীন হওয়ার অবস্থায় উন্নীত হলেই শিষ্য যোগ্য হয় আল্লাহতে বিলীন হওয়ার সাধনার। প্রথম অবস্থার নাম “ফানা ফিশশেখ” দ্বিতীয় স্তরের নাম ‘ফানা ফিল্লাহ। প্রথমটি রাবিতা (গুরু সংযোগ) দ্বিতীয়টি মুরাকিবাহ (আল্লাহর ধ্যান) এই ‘মুরাকিবাহাঁয় গৃহীত হয়েছে যৌগিক পদ্ধতি। আসন, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি–এই চতুরঙ্গ যোগপদ্ধতি থেকেই পাওয়া।
পীরের খানকা বা আখড়ায় সামা (গান) হালকা (ভাবাবেগে নর্তন) দা’রা (আল্লাহ্র নাম কীর্তনের আসর) হাল (মূর্ছা) সাকী, ইশক প্রভৃতি চিশতিয়া খান্দানের সূফীদের সাধনায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। খাজা মঈনউদ্দীন চিশতির আমল থেকেই। পরবর্তীকালে নিজামিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়েও গৃহীত হয় এই রীতি। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধনায় রয়েছে এরই অনুসৃতি।(৫২)
সূফীদের দ্বারা দীক্ষিত অজ্ঞজন ভাষার ব্যবধানবশত সাধারণ শরীয়তী ইসলামের সঙ্গে অনেক কাল পরিচিত হতে পারেনি। ফলে “তাহারা ক্রিয়া কলাপে আচারে ব্যবহারে, ভাষায় ও লিখায়, সর্বোপরি সংস্কার ও চিন্তায়, প্রায় পুরোপুরি বাঙ্গালী রহিয়া গেল। হিন্দুত্বকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করিতে পারিল না;…এমনকি দরবেশদের প্রশ্ৰয়ও ছিল–তাহারা (দরবেশরা) কখনও বাহ্যিক আচার বিচারের প্রতি বিশেষ মনোযোগ ত দেনই নাই; এমন কি আভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও অসাধারণ মহৎ ও উদার ছিলেন।…এখনও পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গীয় শায়খ’ শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে অনেক হিন্দুভাব, চিন্তা, আচার ও ব্যবহারের বহুল প্ৰচলন (রহিয়াছে).সাধারণ বঙ্গীয় মুসলমানদের মধ্যে এখনও তাহাদের ভারতীয় পিতৃপুরুষ হইতে লব্ধ বা পরবর্তীকালে গৃহীত (যত) হিন্দু ও বৌদ্ধ আচার-ব্যবহার প্রচলিত আছে। এবং চিন্তা ও বিশ্বাস ক্রিয়া করিতেছে।”৫৩
মোকাম, মঞ্জিল ও হাল
বর্হিভারতিক সূফীতত্ত্বে মোকাম-মঞ্জিল-এর ধারণা এরূপ : মোকাম হচ্ছে আল্লার পথে স্থিতি। প্রথম মঞ্জিলের নাম শরীয়ৎ। এ শরীয়ৎ হচ্ছে আল্লার প্রতি মানুষ অবিশেষের স্বাভাবিক কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার অনুগ চর্যা (তওবা)। এ অঙ্গীকার পালিত হয় নাসৃত মোকাম লক্ষ্যে। নাসুত মোকাম হচ্ছে পরিশ্রুত মানবিক গুণের উজ্জীবিত অবস্থা। এর পরে তরিকত তথা আল্লার প্রসন্নদৃষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে বিষয়বুদ্ধি ও সংসার-চিন্তা ত্যাগ করে একনিষ্ঠভাবে আল্লার ধ্যানে আত্মনিয়োগ করা (ইনাবাত)। এ চর্যা গৃহীত হয় মলকুত মোকাম লক্ষ্যে। মলকুত মোকাম হচ্ছে ভগবৎ সাধনায় সমৰ্পিত চিত্ততা। এর পরের স্তর হকিকত। জাগতিক জ্ঞান লোপ করে আল্লাহর সন্ধানে কায়-বাক-চিৎ নিয়োগ করাই হকিকত (যুহৃদ)। এর মোকাম হচ্ছে জবরুতনিশ্চিন্ত নিঃশ্বতা। এর পরে পাই মারফত মঞ্জিল। আল্লাহর ইচ্ছার উপর দেহ-মন-আত্মা সমর্পণের স্তর (তোয়াক্কল)। এর মোকাম হল লাহুত–তথা অহংবোধ শূন্যতা–লীলাময় আল্লাহ্র লীলা নিজ দেহ-মন প্ৰাণের মধ্যে অনুভব করা। এ ব্যাখ্যাই পাই কাশফ-অল-মাহজুব-এ : “Station (Maqam) denotcs anyone’s standing in the way of God, and his fulfilment of the obligation appertaining to that station and his keeping it until he comprehends its perfection so far as lies in a man’s power. It is not permissible that he should quit his station without fulfilling the obligations there of. Thus the first station is repentance (Tawbat), then comes conversion (Inabat) the renunciation (Zuhd), then trust on God (Tawakkul) and son, it is not permissible that anyone should pretend to conversion without repentance, or to renunciation without conversion or to trust in God without renunciation.(১) এর পরেও রয়েছে সর্বেশ্বরবাদীদের হাগুত তথা অদ্বৈতসিদ্ধি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, নাসুত হচ্ছে মানবিক, আর মলকুত হচ্ছে ফিরিস্তা সুলভ পবিত্রতার স্তর, এটি অধ্যাতন্ত্র জগতের দ্বার স্বরূপ। জবরুত মোকামে অধ্যাত্মশক্তি অর্জিত হয়, আর লাহুত মোকামে রহিত হয় ফানাভাব তথা অহং-এর ব্যবধান।(২)