ভারতে এসেই ভারতীয় যোগ, দেহতত্ত্ব প্রভৃতির প্রভাবে পড়েছিলেন ইরানী সূফীরা। সুফীসাধনার সঙ্গে যোগ ও দেহতত্ত্বের সমন্বয় সাধন করেই তাঁরা শুরু করেন নতুন সূফীচর্যা। পাকভারতের মুসলিমের অধ্যাত্ম সাধনা যোগ-দেহতত্ত্ব বিহীন নয় এ কারণেই। এ সম্বন্ধে আমরা পরে আলোচনা করব অন্য অধ্যায়ে। অতএব সঙ্গীত, যোগ, রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব প্রভৃতিই রচনা করেছে বাঙালী মুসলমানের অধ্যাত্ম তথা মরমীয়া সাধনার ভিত্তি।
৬
মুসলমানদের বিশ্বাস, হযরত মুহম্মদ হযরত আলীকে তত্ত্ব বা গুপ্ত জ্ঞান দিয়ে যান। হাসান, হোসেন, খাজা কামীল বিন জয়দ ও হাসান বসোরী আলী থেকে প্ৰাপ্ত হন সে জ্ঞান। এই কিংবদন্তীর কথা বাদ দিলে হাসান বসোরী (মৃঃ ৭২৮ খ্ৰীঃ), রাবিয়া (মৃঃ ৭৫৩), ইব্রাহীম আদহাম (মৃঃ ৭৭৭), আবু হাশিম (মৃঃ ৭৭৭), দাউদ তায়ী (মৃঃ ৭৮১) মারুফ কখী (মৃঃ ৮১৫) প্রমুখই সূফীমতের আদি প্রবক্তা।(৩৯)
পরবর্তী সূফী জুননুন মিসরী (মৃঃ৮৬০), শিবলী খোরাসানী (মৃঃ৯৪৬), জুনাইদ বাগদাদী (মৃঃ ৯১০) প্রমুখ সাধকরা সূফীমতকে লিপিবদ্ধ, সুশৃঙ্খলিত ও জনপ্রিয় করে তোলেন।(৪০)
আল্লাহ আকাশ ও মর্তের আলো স্বরূপ।৪১ আমরা তার (মানুষের) ঘাড়ের শিরা থেকেও কাছে রয়েছি।৪২ এই প্রকার ইঙ্গিত থেকেই সূফীমত এগিয়ে যায় বিশ্বব্ৰহ্ম বা সৰ্বেশ্বরবাদের তথা অদ্বৈতবাদের দিকে। যিকর বা জপ করার নির্দেশ মিলেছে কোরআনের অপর এক আয়াতে : অতএব (আল্লাহ্কে) স্মরণ কর, কেননা, তুমি একজন স্মারক মাত্র।৪৩ সৃষ্টি ও স্রষ্টার অদৃশ্য লীলা ও অস্তিত্ব বুঝবার জন্যে বোধি তথা ইরফান কিংবা গুহ্যজ্ঞান লাভ করা প্রয়োজন–এ প্রয়োজনবোধ ও রহস্যচিন্তাই সূফীদের করেছে বিশ্বব্ৰহ্মবাদী বা সৰ্বেশ্বরবাদী। এই চিন্তা বা কল্পনার পরিণতিই হচ্ছে “হমহউস্ত’ (সবই আল্লাহ) বা বিশ্বব্ৰহ্মতত্ত্ব তথা ‘সৰ্বংখল্কিদং ব্ৰহ্ম’ বাদ। এ-ই হল তৌহিদই-ওজুদী তথা আল্লাহ্ সর্বত্র বিরাজমান’–এই অঙ্গীকারে আস্থাস্থাপনের ভিত্তি।
বায়জিদ, জুনাইদ বাগদাদী, আবুল হোসেন ইবনে মনসুর হল্লাজ এবং আবু সৈয়দ বিন আবুল খায়ের খোরাসানী (মৃঃ ১০৪৯ খ্ৰীঃ) প্রমুখ প্রথম যুগের অদ্বৈতবাদী সূফী। শরীয়ৎ-পন্থবিরোধী এসব সূফীদের অনেককেই প্রাণ হারাতে হয় নতুন মত পোষণ ও প্রচারের জন্যে। মনসুর হাল্লাজ, শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়াদী, ফজলুল্লাহ প্রমুখ শহীদ হন। এ ভাবেই।(৪৪
ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক বলেন ‘ভারতে সূফী প্রভাব পড়বার পূর্ব হইতে সূফীমতবাদ ভারতীয় চিন্তাধারায় পরিপূর্ণ হইতে থাকে। খ্ৰীষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতেই ভারতে সূফীমত প্ৰবেশ করে। তৎপূর্ব সূফীমতেও ভারতীয় দর্শন ও চিন্তাধারার স্পষ্ট ছাপ দেখিতে পাই’।(৪৫) তাঁর মতে ভারতীয় পুস্তকের আরবী-ফারসী অনুবাদ, ভ্ৰাম্যমাণ বৌদ্ধভিক্ষুর সান্নিধ্য এবং আল-বিরুনী অনুদিত পাতঞ্জল যোগ আর কপিল সাংখ্য তত্ত্বের সঙ্গে পরিচয়ই এ প্রভাবের মুখ্য কারণ।(৪৬ বায়জিদ বিস্তামীর ভারতীয় (সিন্ধুদেশীয়) গুরু। বুআলীর প্রভাবও এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। ৪৭
তিনি আরো বলেন, “(বাঙলা) দেশে সূফীমত প্রচার ও বহুল বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে, ভারতীয় সহজিয়া ও যোগসাধন প্রভৃতি পন্থা, বঙ্গের সূফীমতকে অভিভূত করিয়া ফেলিতে থাকে। কালক্রমে বঙ্গের সূফীমতবাদের সহিত, এ দেশীয় সংস্কার, বিশ্বাস প্রভৃতিও সম্মিলিত হইতে থাকে এবং সূফীমতবাদ ও সাধন পদ্ধতি ক্ৰমে ক্ৰমে যোগ সাধন প্রভৃতি হিন্দু পদ্ধতির সঙ্গে একটা আপোষ করিয়া লইতে থাকে। চিশতীয়হ ও সুহরাবদীয়াহ সম্প্রদায়-দ্বয়ের সাধনা ভারতে আগমন করার পূর্ব হইতেই অনেকখানি ভারতীয় ভাবাপন্ন হইয়া পড়িয়াছিল; ভারতে আগমনের পর এদেশীয় সাধনার সহিত তাহাদের সাক্ষাৎ যোগসূত্রের সৃষ্টি হইল; ভারতের প্ৰাণের সহিত আরব ও পারস্যের প্রাণের ত্রিবেণী সঙ্গম ঘটিয়া গেল। ভারত বিখ্যাত সাধক কবীর (১৩৯৮-১৪৪০ খ্ৰীঃ) উক্ত প্ৰাণত্রয়ের পুণ্যতীর্থ প্রয়াগক্ষেত্রে পরিণত হইলেন। তাঁহার মধ্যে ভারতীয় যোগ-সাধনা ও সূফীদের “তস্বব্বফ” বা ব্ৰহ্মবাদ সম্মিলিত হইল। সূফীরা সাক্ষাৎভাবে তাহার ভিতর দিয়া ভারতীয়দের আর ভারতীয়েরাও সূফীদের প্রাণের সন্ধান লাভ করিলেন।”৪৮ চৌদ্দটি সূফী-খান্দান বা মণ্ডলীর উল্লেখ আছে আইন-ই-আকবরীতে।(৪৯)
আবুল ফজল প্ৰধান সম্প্রদায়গুলোরই নাম করেছেন হয়তো। তখন এক এক পীর-কেন্দ্রী এক এক সম্প্রদায় ছিল বলেই আমাদের অনুমান। পরে তাত্ত্বিক ও আচারিক বিধিবদ্ধ শাস্ত্র গড়ে উঠার ফলে সম্পপ্রদায় সংখ্যা কমেছে এবং চারটি প্রধান মতবাদী খান্দান প্রসার লাভ করে, আর অপ্রধানগুলো কালে লোপ পায়, অথবা স্থানিক সীমা অতিক্রম করার যোগ্যতা হারায়। আবুল ফজল কথিত চৌদটি খান্দানের অনেকগুলোই লোপ পেয়েছে একারণেই।
চিশতিয়া ও সুহরাওয়াদীয়া মতই প্ৰথমে ভারতে তথা বাঙলায় প্রসার লাভ করে।৫০ এর পরে নকশবন্দীয়া এবং আরো পরে কাদেরিয়া সম্পপ্ৰদায় হয় জনপ্রিয়। মনে হয় ষোলশতক অবধি চিশতিয়া মাদারিয়া ও কলন্দরিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাবই ছিল বেশী। মদারিয়া ও কািলন্দরিয়া মত এক সময় জনপ্ৰিয়তা হারিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।