সূফীমতের আংশিক সাদৃশ্যই রয়েছে। রাধা-কৃষ্ণ লীলায়। তাই একেশ্বরবাদী ও অবতারবাদে আস্থাহীন মুসলমান কবিগণের কল্পনায় সাধারণত রাস, মৈথুন, বস্ত্রহরণ, দান, সম্ভোগ, বিপ্ৰলব্ধা প্রভৃতি প্রশ্ৰয় পায়নি। কেবল রূপানুরাগ, অনুরাগ, বংশী, অভিসার, মিলন, বিরহ প্রভৃতিকে গ্রহণ করেছেন তাঁরা জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পৰ্কসূচক ও ব্যঞ্জক বলে। তাদের রচনায় অনুরাগ, বিরহবোধ এবং জীবন জিজ্ঞাসাই আত্মবোধনী বিশেষরূপে প্রকট।
সৃষ্টিলীলা দেখে স্রষ্টার কথা মনে পড়ে–এটিই রূপ; এ সৃষ্টি বৈচিত্র্য দেখে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কবোধ জন্মে–এটিই অনুরাগ; এবং তাঁর প্রতি কর্তব্য বুদ্ধি জাগে–এটিই বংশী; আর সাধনার আদিস্তরে পাওয়া না-পাওয়ার সংশয়বোধ থাকে–তারই প্ৰতীক নৌক। এর পরে ভাবপ্রবণ মনে উপ্ত হয় আত্মসমৰ্পণ ব্যঞ্জক সাধনার আকাজক্ষা–এটিই অভিসার। এরপর সাধনায় এগিয়ে গেলে আসে অধ্যাত্ম স্বস্তি–তা-ই মিলন। এরও পরে জাগে পরম আকাজক্ষণএকাত্ম হওয়ার বাঞ্ছা–যার নাম বাকাবিল্লাহ–এ-ই বিরহ।
পাক-ভারতে সাধারণত ইসলাম প্রচার করেন। সূফী-দরবেশরাই। অধিকাংশ মুসলমান এদেশী জনগণেরই বংশধর। পূর্বপুরুষের ধর্ম, দর্শন ও সংস্কার মুছে ফেলাও পুরোপুরি সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। সূফী সাধকের কাছে দীক্ষিত মুসলমানেরা শরীয়তের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়নি অশিক্ষার দরুন। কাজেই সূফীতত্ত্বের সঙ্গে যেখানেই সাদৃশ্য-সামঞ্জস্য দেখা গেছে, সেখানেই অংশগ্রহণ করেছে মুসলমানেরা। বৌদ্ধ নাথপন্থ, সহজিয়া তান্ত্রিক সাধনা, শাক্ততন্ত্র, যোগ প্রভৃতি এভাবে করেছে তাদেব আকৃষ্ট। এরূপে তারা খাড়া করেছে। মিশ্ৰ-দৰ্শন। ডক্টর সুনীতি চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘পীর, ফকির, দরবেশ, আউলিয়া প্রভৃতিদের প্রচার এবং কেরামতীর ফলে, মুখ্যতঃ ব্ৰাহ্মণদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ বৌদ্ধ ও অন্যান্য মতের বাঙালী ইসলাম ধর্ম গ্ৰহণ করে। …বাঙ্গালা দেশে ইসলামের সূফীমত বেশী প্রসার লাভ করে। সূফীমতের ইসলামের সহিত বাঙ্গালার সংস্কৃতির মূল সুরটুকুর তেমন বিরোধ নাই। সূফীমতের ইসলাম সহজেই বাঙ্গালার প্রচলিত যোগমার্গ ও অন্যান্য আধ্যাতিমুক সাধনমার্গের সঙ্গে একটা আপোষ করিয়া লইতে সমর্থ হইয়াছিল।”৩৬ সূফীরা গুরুত্ববাদী। শেখ, পীর কিংবা মুর্শীদই তাদের পথপ্রদর্শক। এতে বৌদ্ধগুরুবাদের প্রভাব লক্ষণীয়। ফানা ও বাকাবাদী হোসেন বিন মনসুর হল্লাজ, বায়জিদ বোস্তামী কিংবা ইব্রাহিম আদহাম প্রভৃতি সূফীদের কেউ ছিলেন জোরাষ্ট্ৰীয়ানের, কেউ জিনদিকের কেউবা বৌদ্ধের বংশধর এবং জাতিতে ইরানী।(৩৭) ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে পীরপূজা চালু হয় এ ভাবেই। হিন্দুর গুরুবাদও বৌদ্ধ প্রভাবিত।(৩৮)
‘কুনফায়াকুন’ দ্বৈতবাদের পরিচায়ক। পক্ষান্তরে ‘একোহিম বহুস্যাম’ অদ্বৈতবাদ নির্দেশক। সূফীবা মুসলমান, তাই দ্বৈতবাদী, কিন্তু অদ্বৈতসত্তার অভিলাষী। বৈষ্ণবগণ ব্ৰহ্মবাদের প্রচ্ছায় গড়া। তবু তাদের সাধনা চলে দ্বৈতবোধে এবং পরিণামে (রাগাত্মিক সাধনায়) অদ্বৈতসত্তার প্ৰয়াসে। সূফী ও বৈষ্ণব উভয়েই পরমের কাঙাল। মানবাত্মার সুপ্তবিরহবোধের উদ্বোধনই সূফীবৈষ্ণবের প্রধান কাজ। তাই আমরা সূফী গানে এবং বৈষ্ণবপদে মিলন-পিপাসু বিরহী আত্মার করুণ ক্ৰন্দনধ্বনি শুনতে পাই। মানবাত্মার চিরন্তন Tragedy-র সুর ও বাণী বহন করছে সূফীগজল ও বৈষ্ণবপদ-সাহিত্য।
মুসলমানদের রাধা-কৃষ্ণতত্ত্বে আসক্তির সাধারণ কারণ দুটো ১. সূফীমতবাদের সাথে বৈষ্ণবাদর্শের আত্যন্তিক সাদৃশ্য ও আচারিক মিল এবং ২. জগৎ ও জীবনের চিরাবৃত রহস্য, জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ের কৌতুহল প্রভৃতি মানুষের মনে জিজ্ঞাসা জাগায়, তার সদুত্তর সন্ধান-প্ৰয়াস জাত যে অভিব্যক্তি তাতে দেশে বহুল প্রচলিত রাধাকৃষ্ণরূপকের ব্যবহার। বিশেষ করে বৈষ্ণব চর্যায় ইসলামী প্রভাব তাদের ভেদবুদ্ধি লোপ করেছিল; বৈষ্ণবদের নামকীর্তন, জীবে দয়া, বৰ্ণভেদ প্রথার বিলোপ সাধন তথা সাম্যবোধ, বিনয়, নামেরুচি, দশা, সখীভাব, ঐশ্বর্যপ্রদর্শন, রাগানুগভক্তি, তালাকপ্ৰথা, পুনর্বিবাহ প্রভৃতি সূফীদের যিকর, খিদমত, সামা, হাল, সদাসোহাগ, কেরামতি, তরিকত, হকিকত, মারফত প্রভৃতির অনুকরণ মাত্র। ফানাফিল্লাহ এবং বাকাবিল্লাহও রাধা-কৃষ্ণের অভেদতত্ত্ব আর যুগলরূপে পরিকল্পনার উৎস স্বরূপ। এমনকি অদ্বৈতবাদী হিন্দুর দ্বৈতাদ্বৈতবাদও সূফীর দ্বৈতবাদ থেকে উদ্ভূত। অবশ্য বৈদান্তিক তত্ত্বপ্রভাবে মুসলমান সুফীদের কেউ কেউ আগেই হয়েছিলেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী। সুতরাং সুফী মতাসক্ত বাঙালী মুসলমানদের বৈষ্ণবসাধনা অনুপ্রাণিত করবে তাতে আশ্চর্যা কি? এ জন্যেই সাধক নুর কুতবে আলম এবং সৈয়দ মর্তুজা ফারসী গজল যেমন লিখেছেন, তেমনি রচনা করেছেন বাঙলায় রাধা-কৃষ্ণপদও। অতএব, দুই তত্ত্বে অভিন্ন রূপ দেখেছেন তাঁরা। রাধাকৃষ্ণ যে জীবাত্মা ও পরমাত্মা, দেহ ও প্রাণ এবং ভক্তভগবানের পরিভাষারূপে গৃহীত হয়েছিল, পাক-ভারতের সর্বত্র এঁদের এবং পাক-ভারতের বিভিন্ন ভাষায় রাধাকৃষ্ণ কিংবা রামসীতার রূপকে মুসলিম রচিত পদ ও দােহাঁই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বিশেষ করে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই জগৎ ও জীবনের রহস্য সম্বন্ধে চিরজিজ্ঞাসু। সেই চিরন্তন জিজ্ঞাসার রূপ মানুষ অবিশেষে একই। কাজেই চিন্তাধারাও কমবেশী একই রূপ। কেননা, সবারই “চিত্তকাড়া কালার বাঁশি লাগিছে অন্তরে।”