০০. প্ৰসঙ্গ কথা এবং ভূমিকা – বাঙলার সূফী-সাধনা ও সূফী-সাহিত্য
প্ৰসঙ্গ কথা
[প্ৰথম সংস্করণ]
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সূফী মতবাদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এ যুগের বাঙালি সূফীরা মুসলিম ভাবধারার সংগে বৈষ্ণব ভাবধারার সংযোগ সাধনের চেষ্টা করেছিলেন। এর ফলে, একদিকে যেমন আল্লাহ্র পথে মানুষ নিজকে উৎসর্গ করেছে অন্য দিকে তেমনি রসূল (সঃ) প্রবর্তিত শরীয়তের বিধানসমূহও তারা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে গ্ৰহণ কবেছে। আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে পরবর্তী পর্যায়ে তারা বিষয়-বুদ্ধি ও সংসার-চিন্তা ত্যাগ করে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ধ্যানে আত্মনিয়োগ করেছে। মধ্যযুগের সূফী সাহিত্যসমূহ এ প্রচেষ্টারই ফলশ্রুতি।
সূফী মতবাদের উদ্ভব সম্বন্ধে পণ্ডিতরা নানা মত পোষণ করেন। তবে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন দেশেই এ মতবাদের উন্মেষ। পাক-ভারতে এ মতবাদ প্ৰবেশ ও প্রচার লাভ করেছে ইরানীদের সংগে এদেশবাসীর ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। তবে এ কথা সত্য যে, পাক-ভারতে সূফী মতবাদের ওপরে স্থানীয় প্রভাব পড়েছে এবং এটা স্বাভাবিকও বটে। বাংলা সাহিত্য মুসলিম সাধকের প্রভাবে কতখানি প্রসারিত হয়েছিল, তারই একটা মোটামুটি চিত্র তুলে ধরার উদ্দেশ্যে বাংলা একাডেমী ‘বাঙলার সূফী সাহিত্য’ গ্ৰন্থখানি প্রকাশ করেছেন।
কাজী দীন মুহম্মদ
পবিচালক, বাংলা একাডেমী
৫ই ফেব্রুযারি ১৯৬৯
প্ৰসঙ্গ কথা
বাঙলাদেশের সমােজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎ-এ ড. আহমদ শরীফ (১৯২১-১৯৯৯) একজন প্ৰাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, যাকে উপক্ষো করা যায়। তবে কোন অবস্থাতেই তার বিশাল কীর্তি অস্বীকার করা যায় না। নিজস্ব দর্শন, চিন্তা ও বৈশিষ্ট্যের কারণে বোদ্ধা সমাজের কাছে ছিলেন বহুল আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও এ ধারা বহমান। তবে অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, বাঙলাদেশের মতন একটি অনুন্নত দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে এখানে লেখা-পড়া জানা মানুষের মাঝে না-পড়া এবং না-জানার প্রবণতা গড়ে উঠেছে, তাই কেউ নিজে থেকে কোন বইয়ের বা পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে দেখার গরজ অনুভব করে না। আবার যে কোন মানুষকে বা কোন বিষয়কে সমাজে পরিচিত করতে প্রচার হচ্ছে সবচেয়ে বড় মাধ্যম। সরকারী পৃষ্ঠপােষকতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পর্যায়ের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে বা বিভিন্ন জাতীয়-পর্ষদগুলোতে কিংবা জাতীয় প্রচার মাধ্যম আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতে যারা ঘুরে-ফিরে সবসময় অংশ গ্ৰহণ করার সুযোগ পেয়ে থাকে তারাই কেবল দেশে শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি লাভ করে থাকে। সরকারী বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের রচনাশৈলী যাই হোক না কেন, তার গুণগত মান প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবে সঠিক মূল্যায়ণ বিশ্লেষণ শুধুমাত্র বর্তমান ও ভবিষ্যত-এর গবেষকগণই করতে পারবেন।
বাঙলাদেশে ড. আহমদ শরীফ-এর মতন হাতে গোনা চার থেকে পাঁচজন লিখিয়ে পাওয়া যাবে যারা কোন সময়ই সরকারী বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপােষকতার বেড়াজালে নিজেদেরকে জড়াননি। তাই তারা মননশীল লেখক হিসেবে বা তাদের চিন্তা সমৃদ্ধ গ্রন্থগুলো লেখা-পড়া জানা মানুষের কাছে অদ্যাবধি অজ্ঞাত ও অপঠিত থেকে গেছে। দেশ-স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে মৃত্যুর পরবর্তী বছর অবধি প্রতিবছর গড়ে দুটো করে ড. আহমদ শরীফ-এর মৌলিক রচনা সংবলিত গ্ৰন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত সমােজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উপর শতের অধিক মননশীল গ্ৰন্থ শুধু অপঠিতই নয়, অগোচরেও থেকে গেছে।
পঞ্চাশ দশকের প্রথম থেকে নব্বই দশকের শেষ অবধি সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন ইতিহাসসহ প্রায় সব বিষয়ে তিনি অজস্র লিখেছেন। দ্রোহী সমাজ পরিবর্তনকামীদের কাছে তাঁর পুস্তকরাশির জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়, তাঁর রচিত পুস্তকরাশির মধ্যে বিচিত চিন্তা, স্বদেশ-অন্বেষা, বাঙালির চিন্তা চেতনার বিবর্তন ধারা, বাঙলার বিপ্লবী পটভূমি, নির্বাচিত প্ৰবন্ধ, প্রত্যয় ও প্রত্যাশা এবং বিশেষ করে দুখণ্ডে রচিত বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য তাঁর অসামান্য কীর্তি। তবে এ কথা নিদ্বিধায় বলা যায় যে, পিতৃব্য আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ-এর অনুপ্রেরণায় মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে পাহাড়সম গবেষণা কর্ম তাকে কিংবদন্তী পণ্ডিত-এ পরিণত করেছে। উভয় বঙ্গে এ বিষয়ে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় এবং অদ্যাবধি স্থানটি শূন্য রয়ে গেছে। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করে তিনি মধ্যযুগের সামাজিক ইতিহাস রচনা করে গেছেন। বিশ্লেষণাত্মক তথ্য-তত্ত্ব ও যুক্তি সমৃদ্ধ দীর্ঘ ভূমিকার মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগের সমাজ ও সংস্কৃতির যে ইতিহাস বাঙলা ভাষা-ভাষী মানুষকে দিয়ে গেছেন, তা বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর গাঁথা হয়ে থাকবে।
ভারত উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিত সূফীতত্ত্ব ও সূফী সাধনা বিষয় ও তত্ত্বগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে ড. আহমদ শরীফ রচিত ও সম্পাদিত শতাধিক গ্রন্থাবলীর মধ্যে “বাঙলার সূফী সাহিত্য” গ্রন্থটি ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আলোচ্য গ্রন্থে ড. আহমদ শরীফ রচিত ভূমিকা থেকে জানা যায় যে, “ইসলামের উদ্ভবের প্রায় ১৫০ বছর পরের থেকে সূফীমত ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হতে থাকে এবং সময়ের বিবর্তনে প্রচলিত বিভিন্ন শাখার সূফীমতগুলো ভিন্ন ধরনের, তাই সূফীমত হচ্ছে একটি মিশ্র দর্শন” (পৃষ্ঠা : ২১)। প্রসঙ্গত যে, কুফার আবু হাশিমই (মৃত্যু ১৬২ হি:) প্রথম সূফী বলে পরিচিত; তিনি হুজুহরীর সংজ্ঞানুগ সূফী। মূলত: ইব্রাহিম আদহম (মৃত্যু: ১৬২হিঃ); ফাজিল আয়াজ (মৃত্যু: ১৮৮হিঃ); হাসান বসোরী প্রমুখের সাধনা ও বাণী থেকেই বিশিষ্ট ও আলোচিত হয়ে উঠে সূফীমত।