নীলুদের সব ক’টি ঘরে আলো জ্বলছে। রাত প্রায় এগারটা বাজে। নীলুর বাবা পাথরের মূর্তির মতো বাগানের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। রানুদের ঢুকতে দেখে এগিয়ে এলেন কিন্তু কিছু বললেন না। রানু মাথা নিচু করে তিনতলায় উঠে গেল। নীলুদের ঘরে ঘনঘন টেলিফোন বাজছে। দুটি গাড়ি এসে থামল। মনে হয় ওঁরা খুঁজতে শুরু করেছেন। পুলিশের কাছে নিশ্চয়ই লোক গিয়েছে। নীলুর বাবা অস্থির ভঙ্গিতে বাগানে হাঁটছেন।
দেবী – ২২
২২
ছোট্ট একটি ঘর। কিন্তু দু শ’ পাওয়ারের একটি বাতি জ্বলছে ঘরে। চারদিক ঝলমল করছে। লোকটি একটি চেয়ারে বসে আছে। নীলু লোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছে না, কারণ লোকটি বসে আছে তার পেছনে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাবার কোনো উপায় নেই নীলুর। নাইলনের চিকন দড়ি তার গা কেটে বসে গেছে। চারদিকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। মাঝে-মাঝে দূরের রাস্তা দিয়ে দ্রুতগামী ট্রাকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নীলু থেমে-থেমে বলল, ‘আপনি কি আমাকে মেরে ফেলবেন?’
কেউ কোনো জবাব দিল না।
‘আমি আপনার কোনো ক্ষতি করি নি। কেন আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? প্লীজ, আমাকে যেতে দিন। আমি কাউকে কিছু বলব না। কেউ আপনার কথা জানবে না।’
পেছনের চেয়ার একটু নড়ে উঠল। ভারি গলায় লোকটি কথা বলল, ‘কেউ জানলেও আমার কিছু যায়-আসে না।’
‘কেন আপনি এ রকম করছেন?’
‘আমি একজন অসুস্থ মানুষ। মাঝে-মাঝে আমাকে এ রকম করতে হয়।’
‘আপনি কি আমাকে মেরে ফেলবেন?’
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। লোকটি হাত বাড়িয়ে বাতি নিভিয়ে দিল। চারদিকে ঘন অন্ধকার। নীলু চাপা স্বরে ডাকল, ‘মা, মাগো!’
‘চুপ করে থাক, কথা বলবে না।’
‘কেন এ রকম করছেন আপনি?’
‘আমি একজন অসুস্থ মানুষ। পৃথিবীতে কি অসুস্থ মানুষ থাকে।’
‘আপনি কি আমার মতো আরো অনেক মেয়েকে এইভাবে ফাঁদ পেতে এনেছেন?’
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। লোকটি এগিয়ে এসে নীলুর গায়ে হাত রাখল। এই কি সেই ভালোবাসার স্পর্শ? নীলূ ডাকল, ‘মা, মাগো!’
‘চুপ করে থাক।’
‘আপনি মানুষ, না অন্য কিছু?’
‘বেশির ভাগই আমি মানুষ থাকি, মাঝে-মাঝে অন্য রকম হয়ে যাই।’
লোকটি শব্দ করে হাসল। কী কুৎসিত হাসি! ঘরে একটুও বাতাস নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে। নীলু প্রাণপণে তার একটা হাত ছুটিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। যতই চেষ্টা করছে দড়িগুলো ততই যেন কেটে-কেটে বসে যাচ্ছে।
‘কেন, কেন আপনি এরকম করছেন?’
‘বলেছি তো নীলু! অনেক বার বললাম তোমাকে। আমি অসুস্থ।’
‘কী করছেন অন্যদের?’
লোকটি হেসে উঠল। নীলু কাতর স্বরে বলল, ‘আপনি দয়া করুন, আমি আপনার পায়ে পড়ি। প্লীজ। আমি আপনার কথা কাউকে বলব না।’
‘তা কি হয়?’
‘বিশ্বাস করুন। আমি আমার কথা রাখি। কাউকে আমি আপনার কথা বলব না।’
লোকটি ফিরে যাচ্ছে। নীলু কি বেঁচে যাবে? লোকটি কি তাকে ছেড়ে দেবে? নীলু গুছিয়ে চিন্তা করতে পারছে না। সব কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। লোকটি একটি ড্রয়ার খুলল। ঘর অন্ধকার, নীলু কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু সে নিশ্চিত জানে, তার হাতে ধারাল কিছু একটা আছে। ক্ষুরজাতীয় কিছু। লোকটি সেটি বাঁ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। আসবে, সে এক সময় এগিয়ে আসবে তার কাছে। খুব কাছে কোথাও রিকশার টুনটুন শোনা গেল। নীলু প্রাণপণে চেঁচাল,‘বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও।’ কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুল না।
দেবী – ২৩
২৩
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রানুর অবস্থা খারাপ হতে লাগল। বারবার বলতে লাগল-উফ্, বড্ড গরম লাগছে। আনিস সমস্ত দরজা-জানালা খুলে দিল, ফ্যান ছেড়ে দিল, তবু তার গরম কমল না। রানু কাতর স্বরে বলল, ‘তুমি আমাকে ধরে থাক, আমার বড্ড ভয় লাগছে।’
‘কোনো ভয় নাই রানু।’
‘লোকটি ক্ষুর হাতে বসে আছে। তবু তুমি বলছ ভয় নেই?’
‘এই সব তোমার কল্পনা। এস, তোমার মাথায় একটু পানি দেই?’
‘তুমি কোথায়ও যেতে পারবে না। ঐ লোকটি এখন উঠে দাঁড়িয়েছে। তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে থাক। আরও শক্ত করে ধর।’
আনিস তাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। রানু ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘আমি তোমাকে একটি কথা কখনো বলি নি। একবার একজন লোক আমাকে মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিল।’
‘রানু, এখন তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। দয়া করে চুপ করে থাক।’
‘না, আমি বলতে চাই।’
‘সকাল হোক। সকাল হলেই শুনব।’
‘মাঝে-মাঝে আমার মনে হয় একজন-কেউ আমার সঙ্গে থাকে।’
‘রানু, চুপ করে থাক।’
‘না, আমি চুপ করে থাকব না। আমার বলতে ইচ্ছে করছে। যে আমার সঙ্গে থাকে, তার সঙ্গে আমি অনেক বার কথা বলেছি, কিন্তু আজ সে কিছুতেই আসছে না।’
‘তার আসার কোনো দরকার নেই।’
‘তুমি বুঝতে পারছ না, তার আসার খুব দরকার।’
রাত দেড়টার দিকে নিচ থেকে বিলুর কান্না শোনা যেতে লাগল। অনেক লোকজনের ভিড়। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। রানু বলল, ‘বিলু কাঁদছে। বড় খারাপ লাগছে আমার।’
‘রানু, তুমি একটু শুয়ে থাক। আমি জিতুকে ডেকে দিচ্ছি।’
‘তুমি কোথায় যাবে?’
‘আমি একজন ডাক্তার নিয়ে আসব। আমার মোটেই ভালো লাগছে না।’
‘তুমি আমাকে ফেলে রেখে কোথাও যেতে পারবে না।’
রানুর কথা জড়িয়ে যেতে লাগল। এক সময় বিছানায় নেতিয়ে পড়ল। আনিস ছুটে গেল ডাক্তার আনতে। বড় রাস্তার মোড়ে একজন ডাক্তারের বাসা আছে। ডাক্তার সাহেবকে পাওয়া গেল না। আনিস ফিরে এসে ঘরে ঢোকবার মুখেই তীব্র ফুলের গন্ধ পেল। ঘরের বাতি নেভানো। কে নিভিয়েছে বাতি? আনিস ঢুকতেই রানু বলল, ‘ও এসেছে।’
‘কে? কে এসেছে?’
‘তুমি গন্ধ পাচ্ছ না?’
আনিস এগিয়ে এসে রানুর হাত ধরল। গা ভীষণ গরম। রানু বলল, ‘ও নীলুর কাছে যাবে।’
‘রানু, শুয়ে থাক।’
‘উহু, শোব কীভাবে? ও একা যেতে ভয় পাচ্ছে। আমিও যাব ওর সঙ্গে। ও আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।’
বলতে বলতে রানু খিলখিল করে হাসল।
আনিস বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাকল, ‘রহমান সাহেব, রহমান সাহেব। ভাই, একটু আসুন, আমার বড় বিপদ।’
রহমান সাহেব ঘরে ছিলেন না। তাঁর স্ত্রী বেরিয়ে এলেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে?’
‘আপনি একটু আসুন, আমার স্ত্রী কেমন যেন করছে।’
ভদ্রমহিলা সঙ্গে-সঙ্গে এলেন। এবং ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে বললেন, ‘নূপুরের শব্দ না?’ রানু কিশোরী মেয়ের গলায় খিলখিল করে হাসল।
‘কী হয়েছে ওনার?’
‘আপনি একটু বসুন ওর পাশে। আমি ডাক্তার নিয়ে আসি।’
আনিস ছুটে বেরিয়ে গেল। ফুলের সৌরভ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। রানু হাসিমুখে বলল, ‘আামার সময় বেশি নেই, ঐ লোকটি এগিয়ে আসছে।’
‘কোন লোক?’
‘আপনি চিনবেন না। না-চেনাই ভালো।’
ভদ্রমহিলা রানুর হাত ধরলেন। উত্তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে। তিনি কী করবেন ভেবে পেলেন না।
আনিস ডাক্তার নিয়ে ফেরার আগেই রানু মারা গেল।
দেবী – ২৪
২৪
ঘর অন্ধকার, কিন্তু চোখে অন্ধকার সয়ে আসছে। আবছামতো সব কিছু দেখা যায়। বাড়িটা কোথায়? কহর থেকে অনেক দূরে কী? কোনো শব্দ নেই। কত রাত এখন? বাড়িতে এখন ওরা কী করছে? বিলু কি ঘুমিয়েছি মশারি ফেলে? না, না-আজ কেউ ঘুমায় নি, আজ সবাই ছোটাছুটি করছে। সবাই খুঁজছে নীলুকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো পুলিশের গাড়ির শব্দ শোনা যাবে। বাবা এসে বলবেন-কোনো ভয় নেই মা-মণি।
চেয়ার নড়ার শব্দ হলো। লোকটি কি উঠে দাঁড়িয়েছে? তার হাতে ওটা কী? নীলু মনে-মনে বলল, ‘বাবা, আমি একজন অসুস্থ লোকের হাতে আটকা পড়েছি, আমাকে তোমরা বাঁচাও। আমার আর মোটেও সময় নেই বাবা। তোমাদের খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।’
লোকটি এগিয়ে আসছে। পেছন থেকে খুব ধীর গতিতে এগিয়ে এল সামনে। এখন নীলু আবছাভাবে লোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছে। কী সুন্দর একটি মুখ! নীলু বিড়বিড় করে বলল, ‘প্লীজ, দয়া করুন।’ লোকটি অদ্ভুত শব্দ করল। এটি হাসির শব্দ? নীলুর গা গোলাচ্ছে। নীলু চিৎ হয়ে থাকা অবস্থাতেই মুখ ভর্তি করে বমি করল।দুঃস্বপ্ন, সমস্তটাই একটা দুঃস্বপ্ন। এক্ষুণি ঘুম ভেঙে যাবে। আর নীলু দেখবে-বিলু বাতি জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার বুকের ওপর একটা গল্পের বই। এখানে যা ঘটেছে, তা সত্যি হতেই পারে না।
লোকটি তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল। নীলু চাপা গলায় বলল, ‘আমার গায়ে হাত দেবেন না, প্লীজ।’ লোকটি হেসে উঠছে শব্দ করে। আর ঠিক তখনই নূপুরের শব্দ শোনা গেল। যেন কেউ-একজন ঢুকেছে এ ঘরে।
লোকটি ভারি গলায় বলল, ‘কে, কে ওখানে?’ তার উত্তরে অল্পবয়সী একটি মেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। লোকটি চেচাঁল, ‘কে, কে?’ কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। শুধু ঘরের শেষ প্রাস্তের একটা জানালা খুলে ভয়ানক শীতল একটা হাওয়া এসে ঢুকল ঘরে। সে হাওয়ায় ভেসে এল অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ।
নীলুর দেখল, লোকটি ক্রমেই দেয়ালের দিকে সরে যাচ্ছে। এক বার সে চাপা স্বরে বলল, ‘তুমি কে?’ মিষ্টি একটি হাসি শোনা গেল তখন। ফুলের গন্ধ আরো তীব্র হলো। অন্য কোনো ভুবন থেকে ভেসে এল নূপুরের ধ্বনি। লোকটি গা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে! কে, এখানে কে?’ কেউ তার কথার জবাব দিল না। একটি দুষ্টু মেয়ে শুধু হাসতে লাগল। ভীষণ দুষ্টু একটি মেয়ে। তার পায়ে নূপুর। তার গায়ে অপার্থিব এক ফুলের গন্ধ। মেয়েটি এবার দুইহাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে লোকটির দিকে। লোকটির কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল, ‘এইসব কী? কে, কে?’ তার উত্তরে সমস্ত ঘরময় মিষ্টি খিলখিল হাসি ঝমঝম করতে লাগল। লোকটি চাপা গলায় বলে উঠল, ‘আমাকে বাঁচাও। বাঁচাও।’ দুষ্টু মেয়েটি আবার হাসল, যেন খুব একটা মজার কথা।