মিসির আলি : কি নাম?
জিতু : জিতু মিয়া।
মিসির আলি : দেশ কোথায়?
জিতু : টাঙ্গাইল।
মিসির আলি : শুনলাম দুই-এক দিন আগে তুমি নাকি রাতের বেলা কি-একটা দেখে ভয় পেয়েছ?
জিতু : জ্বি, পাইছি।
মিসির আলি : কী দেখছ?
জিতু : পাকের ঘরে একজন মেয়েমানুষ। হাঁটাচলা করতাছে।
মিসির আলি : সুন্দরী?
জিতু : জ্বি, খুব সুন্দর!
মিসির আলি : রান্নাঘরে তো বাতি জ্বালানো ছিল?
জিতু : জ্বি-না।
মিসির আলি : অন্ধকারে তুমি মানুষ কীভাবে দেখলে?
জিতু : নিশ্চুপ।
মিসির আলি : আমার মনে হয় জিনিসটা তুমি স্বপ্নে দেখছ।
জিতু : নিশ্চুপ।
মিসির আলি : আচ্ছা জিতু মিয়া, তুমি যাও। শোন, এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এস আমার জন্যে। ক্যাপস্টান। নাও, টাকাটা নাও।
জিতু মিয়া চলে গেল। রানু ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ইউনিভার্সিটির সব মাস্টাররাই কি আপনার মতো বুদ্ধিমান?’
‘না। আমার নিজের বুদ্ধি একটু বেশি। আচ্ছা, এখন যে খুটখাট শব্দ শোনা যাচ্ছে, এই শব্দটার কথাই কি আনিস সাহেব আমাকে বলেন?’
রানু জবাব দিল না। মিসির আলি কান পেতে শুনলেন।
‘শব্দটা তো বেশ স্পষ্ট। রান্নাঘর থেকে আসছে না?’
‘হুঁ।’
‘এই শব্দটার কথাই আনিস সাহেব বলেন, তাই না?’
‘বোধহয়।আপনি রান্নাঘরে দেখবেন?আপনি যাওয়ামাত্রই শব্দ থেমে যাবে।’
‘শব্দটা বেশির ভাগই রান্নাঘরে হয়?’
‘জ্বি।’
‘ইঁদুর-মরা কিছু বিষ ছড়িয়ে দিও, আর শব্দ হবে না। ওটা ইঁদুরের শব্দ। রান্নাঘরে খাবারের লোভে ঘোরাঘুরি করে। সে জন্যেই শব্দটা বেশি হয় রান্নাঘরে। বুঝলে?’
‘হুঁ।’
‘যুক্তিটা পছন্দ হচ্ছে না মনে হয়।’
‘যুক্তি ভালোই। আরেক কাপ চা খাবেন?’
‘নাহ, এখন উঠব। আনিস সাহেব মনে হয় আজ আর আসবেন না।’
‘না, আপনি আরেকটু বসুন। আপনাকেও একটা গল্প বলব।’
‘আজ আর না, রানু। মাথা ধরেছে।’
‘মাথা ধরলেও আপনাকে শুনতে হবে। বসুন, আমি চা আনছি। প্যারাসিটামল খাবেন?’
‘ঠিক আছে।’
চা আনবার আগেই আনিস এসে পড়ল। তার অফিসে নাকি কী-একটা ঝামেলা হয়েছে। দশ হাজার টাকার একটা চেকের হিসাব গণ্ডগোল। চেকটা ইস্যু হয়েছে আনিসের অফিস থেকে। আনিসের চোখে-মুখে ক্লান্তি। মিসির আলি বললেন, ‘আপনি বিশ্রামটিশ্রাম করেন। আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না। আমি রানুর কাছ থেকে একটা গল্প শুনব।’
‘কী গল্প?’
‘জানি না কী গল্প। ভয়ের কিছু হবে।’
রানু বলল,‘না, ভয়ের না। তুমি গোসলটোসল সেরে এসে চা খাও।’
‘আমি গল্পটা শুনতে পারব না?’
‘নাহ্। সব গল্প সবার জন্যে না।’
আনিসের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। সে কিছু বলল না। ব্যাথরুমে ঢুকে পড়ল। রানু তার গল্প শুরু করল খুব শান্ত গলায়। মিসির আলি তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে লাগলেন।
রানুর দ্বিতীয় গল্প
আমার তখন মাত্র বিয়ে হয়েছে। সপ্তাহখানেকও হয় নি। সেই সময় এক কাণ্ড হলো।
আমার বিয়ে হয়েছিল শ্রাবণ মাসের ছ’ তারিখে। ঘটনাটা ঘটল শ্রাবণ মাসের চোদ্দ তারিখ।সকালবেলা আমার এক মামাশ্বশুর এসে ওকে নিয়ে গেলেন মাছ মারতে। নৌকায় করে মাছ মারা হবে। নৌকা বড় গাঙ দিয়ে যাবে সোনাপোতার বিলে। বঁড়শি ফেললেই সেখানে বড়-বড় বোয়াল মাছ পাওয়া যায়। বর্ষাকালে বোয়ালের কোনো স্বাদ নেই জানেন তো? কিন্তু সোনাপোতার বোয়ালে বর্ষাকালেই নাকি সবচেয়ে বেশি তেল হয়।
দুপুরের পর থেকেই হঠাৎ করে খুব দিন-খারাপ হলো। বিকেল থেকে বাতাস বইতে লাগল। আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম।ও ওরা আর ফেরে না। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল।
আমাদের বাড়িটা হচ্ছে কাঠের। কাঠের দোতলা। আমি একা-একা দোতলায় উঠে গেলাম। দোতলায় কোণার দিকের একটা ঘরে আজেবাজে জিনিস রাখা হয়। স্টোররুমের মতো। কেউ সেখানে যায়টায় না। আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে শুরু করলাম। তখন হঠাৎ একটি মেয়ের কথা শুনতে পেলাম। মেয়েটি খুব নিচুস্বরে বলল- সোনাপাতার বিলে ওদের নৌকা ডুবে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই ডুবেছে। এটা শোনার পর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।
মিসির আলি বললেন, ‘এইটুকুই গল্প?’
‘হ্যাঁ।’
‘গল্পের কোনো বিশেষত্ব লক্ষ্য করলাম না।’
‘বিশেষত্ব হচ্ছে, সেদিন সন্ধ্যায় ওদের সত্যি-সত্যি নৌকাডুবি হয়েছিল। এর কোনো ব্যাখ্যা আছে আপনার কাছে?’
‘আছে। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, কাজেই তোমার মনে ছিল অমঙ্গলের আশঙ্কা। অবচেতন মনে ছিল নৌকাডুবির কথা। অবচেতন মনই কথা বলেছে, তোমার সঙ্গে। মানুষের মন খুব বিচিত্র রানু। আমি উঠলাম।’
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘একতলার নীলু নামের যে মেয়েটি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে, সে আপনার জন্যে বারান্দায় অপেক্ষা করছে। যাবার সময় ওর সঙ্গে আপনার দেখা হবে।’
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তাতে কি?’
রানু বলল, ‘নীলু এই মুহূর্তে কী ভাবছে তা আমি বলতে পারব।ওকে জিজ্ঞেস করলেই দেখবেন আমি ঠিকই বলেছি। আমি অনেক কিছুই বলতে পারি।’
‘নীলু কী ভাবছে?’
‘নীলু ভাবছে এক জন অত্যন্ত সুপুরুষ যুবকের কথা।’
‘সেটা তো স্বাভাবিক। এক জন অবিবাহিত যুবতী এক জন সুপুরুষ যুবকের কথাই ভাবে। এটা বলার জন্যে কোনো অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দরকার হয় না, রানু।’
মিসির আলি নেমে গেলেন। নীলু সত্যি-সত্যি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। সে খুব অনুরোধ করল যাতে স্যার এক কাপ চা খেয়ে যান, কিন্তু মিসির আলি বসলেন না। তাঁর প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।প্যারাসিটামল কাজ করছে না। সারা জীবন তিনি এত অষুধ খেয়েছেন যে অষুধ তাঁর ওপর এখন আর কাজ করে না। খুব খারাপ লক্ষণ।
দেবী – ১৭
১৭
নীলুর বাবা বারান্দায় বসেছিলেন। নীলুকে বেরুতে দেখে তিনি ডাকলেন,‘নীলু কোথায় যাচ্ছ মা?’
‘একটু বাইরে যাচ্ছি।’
কিন্তু এইটুকু বলতেই নীলুর গলা কেঁপে গেল। গলা লাল হলো। তিনি তা লক্ষ্য করলেন। বিস্মিত গলায় বললেন,‘বাইরে কোথায়?’ নীলু জবাব দিল না।
‘কখন ফিরবে মা?’
‘আটটা বাজার আগেই ফিরব।’
‘গাড়ি নিয়ে যাও।’
‘গাড়ি লাগবে না। তোমার কিছু লাগবে বাবা, চা বানিয়ে দিয়ে যাব?’
‘না, চা লাগবে না। একটু সকাল-সকাল ফিরিস মা। শরীরটা ভালো না।’
‘সকাল-সকালই ফিরব।’
বিকেলের আলো নরম হয়ে এসেছে। সব কিছু দেখতে অন্য রকম লাগল নীলুর চোখে। নিউ মার্কেটের পরিচিত ঘরগুলোও যেন অচেনা। যেন ওদের এক ধরনের রহস্যময়তা ঘিরে আছে।
‘কেমন আছ নীলু?’
নীলূ তৎক্ষণাৎ তাকাতে পারল না। তার লজ্জা করতে লাগল। তার ভয় ছিল আজ হয়তো সে আসবে না। প্রিয়জনদের দেখা তো এত সহজে পাওয়া যায় না।
‘আজ তুমি দেরি করে এসেছ। পাঁচ মিনিট দেরি। তোমার তার জন্যে শাস্তি হওয়া দরকার।’
‘কী শাস্তি?’
‘সেটা আমার চা খেতে-খেতে ঠিক করব। খুব চায়ের পিপাসা হয়েছে।’
‘কোথায় চা খাবেন?’
‘এখানে কোথাও। আর শোন নীলু, চা খেতে-খেতে তোমাকে আমি একটা কথা বলতে চাই। খুব জরুরি কথা।’
‘এখন বলুন। হাঁটতে-হাঁটতে বলুন।’
‘নাহ্। এই কথা হাঁটতে-হাঁটতে বলা যায় না। বলতে হয় মুখোমুখি বসে। চোখের দিকে তাকিয়ে।’
নীলূর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমল। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। সে কোনোমতে বলল,‘ঠিক আছে, চলুন কোথাও বসি।’
‘কি বলতে চাই তা কি বুঝতে পারছ?’
‘নাহ্।’
‘বুঝতে পারছ, নীলু। মেয়েরা এইসব জিনিস খুব ভালো বুঝতে পারে।’
নীলুর গা কাঁপতে লাগল। অন্য এক ধরনের আনন্দ হচ্ছে। অন্য এক ধরনের সুখ। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এখন আর কেউ নেই। চারিদিকে সীমাহীন শূন্যতা। শুধু তারা দুই জন হাঁটছে। হেঁটেই চলছে। কেমন যেন এক ধরনের কষ্টও হচ্ছে বুকের মধ্যে।
ওরা একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল।
‘চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে?’
‘না।’
‘খাও না! কিছু খাও।’
সে বয়কে ডেকে কী যেন বলল। নীলু শুনতে পেল না। কোনো কিছুতেই তার মন বসছে না। সব তার কাছে অস্পষ্ট লাগছে।
‘কি নীলু, কিছু বল। চুপ করে আছ কেন?’
‘কী বলব?’
‘যা ইচ্ছা বল।’
নীলূ ইতস্তত করে বলল, ‘আপনি ঐ বিজ্ঞাপনটা আবার দিয়েছেন কেন?’
সে হাসল শব্দ করে।
‘দেখেছ বিজ্ঞাপনটা?’
‘হ্যাঁ।’
‘মন-খারাপ হয়েছে?’
‘নীলু কিছু বলল না।
‘বল, মন-খারাপ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
সে আবার শব্দ করে হাসল। তার পর ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি পত্রিকার অফিসে টাকা দিয়ে রেখেছিলাম। কথা ছিল প্রতি মাসে দুই বার করে ছাপাবে। তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর তার আর প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু সেটা বলা হয় নি। আগামী কাল বন্ধ করে দেব। এখন খুশি তো?’
নীলু জবাব দিল না।
‘বল, এখন তুমি খুশি? এইভাবে চুপ করে থাকলে হবে না, কথা বলতে হবে।বল, তুমি খুশি?’
‘হুঁ।’
সে আরেক দফা চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। খানিকক্ষণ দুই জনেই কোনো কথা বলল না। বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পৃথিবী বড় সুন্দর গ্রহ। এতে বেঁচে থাকতে সুখ আছে।
‘নীলু।’
‘হুঁ।’
‘তোমাকে যে কথাটি আমি বলতে চাচ্ছিলাম সেটি বলি?’
‘বলুন।’
‘দেখ নীল, সারা জীবন পাশাপাশি থেকেও এক সময় একজন অন্যজনকে চিনতে পারে না। আবার এমনও হয়, এক পলকের দেখায় একে অন্যকে চিনে ফেলে। ঠিক না?’
নীলু জবাব দিল না।
‘বল, ঠিক না?’
‘হ্যাঁ।’
তোমাকে প্রথম দিন দেখেই….’
সে চুপ করে গেল। নীলুর চোখে জল এল।
‘নীলু, আজ যদি তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, তাহলে তোমার আপত্তি আছে?’
নীলু ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল।জবাব দিল না। সে মুখ ঘুরিয়ে বসেছিল। সে তার চোখের জল তাকে দেখাতে চায় না।
‘বল নীলু, আপত্তি আছে?’
‘আমাকে আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে।’
‘আটটার আগেই আমরা বাড়ি ফিরব। এস উঠি।’
সে নীলুর হাত ধরল। ভালবাসার স্পর্শ, যার জন্যে তরুণীরা সারা জীবন প্রতীক্ষা করে থাকে।
দেবী – ১৮
১৮
রানু আজ অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন দিন প্রায় শেষ। আকাশ লালচে হতে শুরু করেছে। সে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিচের বারান্দায় বিলু হাঁটছে একা-একা। রানুর কেমন জানি অস্বস্তি বোধ হতে লাগল। যেন কোথাও কিছু-একটা অস্বাভাবিকতা আছে, সে ধরতে পারছে না। নিচে থেকে বিলু ডাকল, ‘রানু ভাবী, চা খেলে নেমে এস, চা হচ্ছে।’
‘চা খাব না।’
‘আস না বাবা! ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার বলব। কুইক।’
রানু নেমে গেল। তার মাথায় সূক্ষ্ম একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না। বমিবমি ভাব হচ্ছে।
বারান্দায় নীলূর বাবাও ছিলেন। ওপর থেকে তাঁকে দেখা যায় নি। তিনি নরম স্বরে বললেন, ‘এখন তুমি কেমন আছ মা?’
‘জ্বি, ভালো।’
‘আমি আনিস সাহেবকে বলেছি বড় একজন ডাক্তার দেখাতে। পিজির একজন প্রফেসর আছেন, আমার আত্মীয়, তাঁকে আমি বলে দেখতে পারি। তুমি আলাপ করো আনিসের সাথে, কেমন?’
‘জ্বি, করব।’
বিলু বলল, ঘরে গিয়ে তুমি চা খাও। তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আমরা দুই জন বাগানে বসি।’ ভদ্রলোক চলে গেলেন সঙ্গে-সঙ্গে।
রানু বলল, ‘নীলু কোথায়?‘
‘ওর এক বন্ধুর বাড়ি গেছে।’
বন্ধুর বাড়ি যাওয়া এমন কোনো ব্যাপার নয়, তুব কেন জানি রানুর বুকে ধক করে একটা ধাক্কা লাগল। ভোঁতা এক ধরনের যন্ত্রণা হতে লাগল মাথায়। বিলু বলল, ‘রানু ভাবী, তোমাকে একটা গোপন কথা বলছি। টপ সিক্রেট, কাউকে বলবে না।’
‘না, বলব না।’
‘ইভেন নীলু আপাকেও নয়। কারণ কথাটা তাকে নিয়েই।’
‘ঠিক আছে, কাউকে বলব না।’
‘ নীলু আপা ডুবে-ডুবে জল খাচ্ছে। আজকে সকালে টের পেয়েছি।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। নীলু আপার ট্রাঙ্ক ঘাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি। জনৈক ভদ্রলোক দারুণ সব রোমান্টিক চিঠি লিখেছে নীলু আপাকে। খুব লদকালদকি।’
বিলু হাসল। রানু কিছু বলল না। তার মাথার যন্ত্রণাটা ক্রমেই বাড়ছে।
‘দু একটা চিঠি পড়ে দেখতে চাও?’
‘না, না। অন্যের চিঠি।’
‘আহ্,পড় না, কেউ তা জানতে পারছে না। আমরা ব্যাপারটা টপ সিক্রেট রাখব, তাহলেই তো হলো।’
‘না বিলু, আমি চিঠি পড়ব না।’
‘পড়ব না বললে হবে না। পড়তেই হবে। দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি। যে আলো আছে তাতে দিব্যি পড়তে পারবে।’
বিলু ঘর থেকে চিঠি নিয়ে এল। রানু চিঠিটি হাতে নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিলু অবাক হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?’
‘না, কিছু হয় নি।’
‘এ রকম করছ কেন?’
‘মাথা ধরছে। বড্ড মাথা ধরছে।’
‘প্যারাসিটামল এনে দেব? তুমি চিঠিটা পড়ে আমাকে বল ভদ্রলোক সম্পর্কে তোমার কী ধারণা।’
রানু চিঠি পড়ল। বিলু বলল,‘বল, তোমার কী মনে হয়?’
রানু কিছু বলল না। এক হাতে মাথার চুল টেনে ধরল।
‘তোমার কী হয়েছে?’
‘বড্ড শরীর খারাপ লাগছে। আমি এখন যাই।’
‘চা খাবে না?’
‘না। বিলু, নীলু কখন ফিরবে-বলে গেছে?’
‘না। সন্ধ্যার আগে-আগেই ফিরবে বোধহয়। তোমার কী শরীর বেশি খারাপ লাগছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তা হলে যাও, শুয়ে থাক গিয়ে।’
রানু উপরে উঠে এল। ঘর অন্ধকার। বাতি জ্বালাতে ইচ্ছে হলো না। শুয়ে পড়ল বিছানায়।আনিস আজ ফিরতে দেরি করবে। তার অফিসে কী-সব নাকি ঝামেলা হচ্ছে। রানু ডাকল, ‘জিতু মিয়া।’ কেউ সাড়া দিল না। জিতু কি বাসায় নেই? ‘জিতু-জিতু।’ কোনো উত্তর নেই। জিতু মিয়া ইদানীং বেশ লায়েক হয়েছে। রানু কিছু বলে না বলেই হয়তো বিকেলে খেলতে গিয়ে সন্ধ্যা পার করে বাড়ি ফেরে। বকাঝকা তার গায়ে লাগে না।
রান্নাঘরে খুটখুট শব্দ হচ্ছে।ইঁদুর। নিশ্চয়ই ইঁদুর। তবু রানু বলল, ‘কে?’ খুটখুট শব্দ থেমে গেল। ইঁদুর ছাড়া আর কিছু নয়, কিন্তু সেই গন্ধটা আবার পাওয়া যাচ্ছে। কড়া ফুলের গন্ধ। রানুর ইচ্ছা হলো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। রানু দুর্বল গলায় ডাকল, ‘জিতু, জিতু মিয়া।’ আর তখন কে-একজন ডাকল, ‘রানু-রানু।’ এই ডাক রানুর চেনা। এই জীবনে সে অনেক বার শুনেছে। তবে এটা কিছু নয়। প্রফেসর সাহেব বলেছেন, ‘অডিটরি হেলুসিনেশন’। আসলেই তাই। এছাড়া আর কিছু নয়।
‘রানু-রানু।’
‘কে? তুমি কে?’
রানুর মনে হলো কেউ-একজন যেন এগিয়ে আসছে। তার পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ছোট্ট-ছোট্ট পা নিশ্চয়ই। হালকা শব্দ। পায়ে কি নূপুর আছে? নুপুর বাজছে?
‘রানু।’
রানু চোখ বন্ধ করে ফেলল। এ সব সত্যি নয়, চোখের ভুল। রানু দুর্বল গলায় বলল, ‘তুমি কে?’
‘আমাকে তুমি চিনতে পারছ না?’
‘না।’
কিশোরীর গলায় মৃদু হাসি শোনা গেল।
‘তাকাও রানু। তাকালেই চিনবে।’
‘আমি চিনতে চাই না।’
‘তোমার বন্ধু নীলুর খুব বিপদ, রানু। এক দিন তোমার যে বিপদ ঘটতে যাচ্ছিল, তার চেয়েও অনেক বড় বিপদ।’
দরজায় ধাক্কা পড়েছে। জিতু এসেছে বোধহয়।রানু তাকাল, কোথাও কেউ নেই। ফুলের গন্ধ কমে আসছে। জিতু মিয়া বাইরে থেকে ডাকল, ‘আম্মা, আম্মা।’ রানু উঠে দরজা খুলল।
‘আপনের কী হইছে?’
‘কিছু হয় নি।’
রানু এসে শুয়ে পড়ল।তার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। সে বিছানায় ছটফট করতে লাগল। কখন আসবে আনিস? কখন আসবে?
‘জিতু।’
‘জ্বি।’
‘নিচে গিয়ে দেখে আয় তো-নীলু ফিরেছে নাকি।’
জিতু ফিরে এসে জানাল, এখনও আসে নি।রানু একটি নিশ্বাস ফেলে ঘড়ি দেখল, আটটা বাজতে চার মিনিট বাকি। কখন আসবে আনিস?
দেবী – ১৯
১৯
সারাটা পথ নীলু চুপ করে রইল। একবার সে বলল, ‘কী ব্যাপার, এত চুপচাপ যে?’ নীলু তারও জবাব দিল না।তার কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সে আছে একটা ঘোরের মধ্যে।
‘গান শুনবে? গান দেব?’
নীলু মাথা নাড়ল। সেটা হাঁ কি না, তাও স্পষ্ট হলো না।
‘কী গান শুনবে? কান্ট্রি মিউজিক? কান্ট্রি মিউজিকে কার গান তোমার পছন্দ?’
নীলু জবাব দিল না।
‘আমার ফেবারিট হচ্ছে জন ডেনভার। জন ডেনভারের রকি মাউন্টেন হাই গানটা শুনেছ?’
‘না।’
‘খুব সুন্দর! অপূর্ব মেলোডি!’
সে ক্যাসেট টিপে দিতেই জন ডেনবারের অপূর্ব কণ্ঠ শোনা গেল, ‘ক্যালিফোর্নিয়া রকি মাউন্টেন হাই।’
‘কেমন লাগছে নীলু?’
‘ভালো।’
‘শুধু ভালো না। বেশ ভালো।’
সেও জন ডেনভারের সঙ্গে গুনগুন করতে লাগল। নীলুর মনে হলো ওর গানের গলাও তো চমৎকার! একবার ইচ্ছা হলো জিজ্ঞেস করে গান জানেন কি না, কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। তার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। গাড়ি কোন দিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছে তাও সে লক্ষ্য করছে না। এক বার শুধু ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এক জন ভিখিরি এসে ভিক্ষা চাইল। সে ধমকে উঠল কড়া গলায়। তারপর আবার গাড়ি চলল। নীলু ফিসফিস করে বলল, ‘কটা বাজে?’
‘সাতটা পঁয়ত্রিশ। তোমাকে আটটার আগেই পৌঁছে দেব।’
‘আপনার বাড়ি মনে হয় অনেক দূর?’
‘শহর থেকে একটু দূরে বাড়ি করেছি। কোলাহল ভালো লাগে না। ফার ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড কার লেখা জান?’
‘নাহ্।’
‘টমাস হার্ডির। পড়ে দেখবে, চমৎকার! অথচ ট্রাজিডি হচ্ছে, টমাস হার্ডিকেই নোবেল পুরুষ্কার দেয়া হয় নি। তুমি তাঁর কোনো বই পড়েছে?’
‘পড়ে দেখবে। খুব রোমান্টিক ধরনের রাইটিং।’
গাড়ি ছুটে চলছে মিরপুর রোড ধরে। হঠাৎ নীলু বলল, ‘আমার ভালো লাগছে না।’
সে তাকাল নীলুর দিকে। একটি হাত বাড়িয়ে ক্যাসেটের ভল্যুম বাড়িয়ে দিল। গাড়ির গতি কমল না।
‘আমি বাসায় যাব।’
‘আটটার সময় আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব।’
‘না, আজ আমি কোথাও যাব না। প্লীজ গাড়িটা থামান, আমি নেমে পড়ব।’
‘কেন?’
‘আমার ভালো লাগছে না। প্লীজ।’
সে তাকাল নীলুর দিকে। নীলু শিউরে উঠল। এ কেমন চাউনি! যেন মানুষ নয়, অন্য কিছু।
‘প্লীজ, গাড়িটা একটু থামান।’
‘কোনো রকম ঝামেলা না-করে চুপচাপ বসে থাক। কোনো রকম শব্দ করবে না।’
‘আপনি এ রকম করে কথা বলছেন কেন?’
গাড়ির গতি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ঝড়ের গতিতে পাশ দিয়ে দুটো ট্রাক গেল। লোকটি তার একটি হাত রাখল নীলুর উরুতে। নীলু শিউরে উঠে দরজার দিকে সরে গেল। লোকটি হাসল। এ কেমন হাসি!
‘গাড়ি থামান। আমি চিৎকার করব।’
‘কেউ এখন তোমার চিৎকার শুনবে না।’
‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’
‘আমি ভয় দেখাচ্ছি না।’
‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করে গাড়িতে উঠেছি।’
‘আরো কিছুক্ষণ থাক। বেশিক্ষণ নয়, এসে পড়েছি বলে।’
‘কী করবেন আপনি?’
‘তেমন কিছু না।’
নীলু এক হাতে দরজা খুলতে চেষ্টা করল। লোকটি তাকিয়ে দেখল, কিন্তু বাধা দিল না। দরজা খোলা গেল না। নীলু প্রাণপণে বলতে চেষ্টা করল, আমাকে বাঁচাও, কিন্তু বলতে পারল না। প্রচুর ঘামতে লাগল। প্রচণ্ড তৃষ্ণা বোধ হলো।
দেবী – ২০
২০
আনিস এলো রাত সাড়ে আটটায়। ঘর অন্ধকার। কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই। রানু বাতিটাতি নিভেয়ে অন্ধকারে বসে আছে। জিতু মিয়া মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়েছে।
‘রানু, কী হয়েছে?’
রানু ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, ‘তুমি এত দেরি করলে!’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘নীলুর বড় বিপদ।’
আনিস কিছু বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে তাকাল। রানু থেমে-থেমে বলল, ‘নীলুর খুব বিপদ।’
‘কিসের বিপদ? কী বলছ তুমি?’
রানুর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। সে গুছিয়ে কিছু বলতে পারছে না।
‘রানু, তুমি শান্ত হয়ে বস। তারপর ধীরেসুস্থে বল-কী হয়েছে নীলুর?’
‘ও একজন খারাপ লোকের পাল্লায় পড়েছে। লোকটা ওকে মেরে ফেলবে।’
রানু ফোঁপাতে লাগল। আনিস কিছুই বুঝতে পারল না। নীলুর বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই তার কথা হয়েছে। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেছেন, ‘কি, এত দেরি যে?’ যার মেয়ের এত বড় বিপদ, সে এ রকম স্বাভাবিক থাকবে কী করে?
আনিস বলল, ‘ওরা তো কিছু বলল না।’
‘ওরা কিছু জানে না। আমি জানি, বিশ্বাস কর-আমি জানি।’
‘আমাকে কী করতে বল?‘
‘আমি বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘জিনিসটা কি তুমি স্বপ্নে দেখেছে?’
‘না। কিন্তু আমি দেখেছি।’
‘কী দেখেছ?’
‘আমি সেটা তোমাকে বলতে পারব না।’
‘তুমি যদি চাও আমি নিচে গিয়ে ওদের বলতে পারি, কিন্তু ওরা বিশ্বাস করবে না।’
রানু চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে রইল। ওর শরীর অল্প-অল্প করে কাঁপছে। আনিস বলল, ‘নাকি মিসির আলি সাহেবের কাছে যাবে? উনি কোনো-একটা বুদ্ধি দিতে পারেন।যাবে?’
রানু কাঁপা গলায় বলল,‘তুমি নিজে কি আমার কথা বিশ্বাস করছ?’
‘হ্যাঁ, করছি।’
একতলার বারান্দায় বিলু বসেছিল। ওদের নামতে দেখেই বিলু বলল, ‘ভাবী, নীলু আপা এখনো ফিরছে না। বাবা খুব দুশ্চিন্তা করছেন।’
রানু কিছু বলল না।
‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ ভাবী?’
রানু তারও জবাব দিল না। রিকশায় উঠেই সে বলল, ‘আমাকে ধরে রাখ,খুব ভালো লাগছে।’
আনিস তার কোমর জড়িয়ে বসে রইল। রানুর গা শীতল। রানু খুব ঘামছে। জ্বর নেমে গেছে।
দেবী – ২১
২১
রানু চোখ বড়-বড় করে বলল, ‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, তাই না?’
মিসির আলি চুপ করে রইলেন।
‘আগে আপনি বলুন-আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন?’
‘বিশ্বাসও করছি না, আবার অবিশ্বাসও করছি না। তুমি নিজে যা সত্যি বলে মনে করছ, তা-ই বলছ। তবে আমি এত সহজে কোনো কিছু বিশ্বাস করি না।’
‘কিন্তু যদি সত্যি হয়,তখন?‘
মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে কাশতে লাগলেন।
‘বলুন, যদি আমার কথা সত্যি হয়-যদি মেয়েটা মারা যায়?’
মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, ‘ঠিক এই মুহূর্তে কী করা যায়, তা তো বুঝতে পারছি না। মেয়েটি কোথায় আছে, তা তো তুমি জান না। নাকি জান?’
‘না,জানি না।’
‘ছেলেটির নামধামও জান না?’
‘ছেলেটি দেখতে খুব সুন্দর। আমার এ রকম মনে হচ্ছে।’
‘এই শহরে খুব কম করে হলেও দশ হাজার সুন্দর ছেলে আছে।’
‘আমরা কিছুই করব না?’
‘পুলিশের কাছে গিয়ে বলতে পারি একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে এবং আশঙ্কা করা যাচ্ছে দুষ্ট লোকের খপ্পরে পড়েছে। কিন্তু তাতেও একটা মুশকিল আছে, ২৪ ঘন্টা পার না হলে পুলিশ কাউকে মিসিং পারসন হিসেবে গণ্য করে না।’
‘রানু, তুমি যদি ঐ লোকটির কোনো ঠিকানা কোনোভাবে এনে দিতে পার, তাহলে একটা চেষ্টা চালানো যেতে পারে।’
‘ঠিকানা কোথায় পাব?’
‘তা তো রানু আমি জানি না। যেভাবে খবরটি পেয়েছ, সেইভাবেই যদি পাও।’
রানু উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি সাহেব বললেন, ‘যাচ্ছ নাকি?’
‘হ্যাঁ, বসে থেকে কী করব?’