একটি কলেরায় মৃত মানুষের লাশ (৩০/৩৫) মধুপুরের নিমশাসা গ্রামে পাওয়া যায়। লাশটির পচন ধরিয়া গিয়াছিল। প্রথামিক পরীক্ষার পর আমি লাশটির পুঁতিয়া ফেলিবার নির্দেশ দেই। লাশটির কোনো পরিচয় জানা যায় নাই।
মিসির আলি বললেন, ‘কলেরায় মৃত, এটা বোঝা গেল কী করে?’ ওসি সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘সেটা আমি কী করে বলব? রিপোর্ট তো আমার লেখা না। ব্রজগোপাল বাবুকে জিজ্ঞেস করেন। তিনি জানবেন।’
তাঁকে কোথায় পাওয়া যাবে?’
‘পুলিশ ডাইরেক্টরেটে খোঁজ করেন। তবে এই সব খোঁজাখুঁজির কোনো অর্থ নেই। দশ বৎসর আগের ঘটনা মনে করে বসে আছেন নাকি? পুলিশকে আপনারা কী মনে করেন বলেন তো?’
‘ঘটনাটি অস্বাভাবিক। সে জন্যই হয়তো তাঁর মনে থাকবে।’ ‘একটা ডেড বডি পাওয়া গেছে পানিতে, এর মধ্যে আপনি অস্বাভাবিক কী দেখলেন? বাংলাদেশে প্রতি দিন কয়টা ডেড বডি পাওয়া যায় জানেন?’
‘জ্বি-না, জানি না।’
‘পুলিশের লাইনে ডেড বডি পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা, বুঝলেন?’
মিসির আলি মধুপুরে আরো একদিন থাকলেন। দেখে এলেন, যে জায়গায় লোকটিকে পোঁতা হয়েছিল সেই জায়গা। দেখার মতো কিছু নয়। ঘন কাঁটাবন হয়েছে, যার মনে হচ্ছে এই জায়গাটিকে বেশ কিছু দিন লোকজন ভয়ের চোখে দেখেছেন। হাঁটাচলা বন্ধ করে দিয়েছে নিশ্চয়ই।
মিসির আলি অনেকের সঙ্গেই কথা বললেন-যদি নতুন কিছু পাওয়া যায়। নতুন কোনো তথ্য, যা কাজে লাগবে, কিন্তু কিছুই জানা গেল না। দশ বৎসর দীর্ঘ সময়। এই সময়ে মানুষ অনেক কিছু ভুলে যায়।
মধুপুর থেকে তিনি গেলেন রানুদের আদি বাড়িতে। সেখানে যাবার তাঁর একটি উদ্দেশ্য, খুঁজে দেখা-জালালউদ্দিন নামে কাউকে পাওয়া যায় কি না। এই লোকটিকে পাওয়া খুবই প্রয়োজন।
আনিস লক্ষ্য করল, রানু ইদানীং বেশ অস্বাভাবিক। এর প্রধান কারণ বোধহয় বাড়িঅলার দুটি মেয়ে। ওদের সঙ্গে সে বেশ মিলেমিশে আছে। গল্পের বই আনছে। ভালোমন্দ কিছু রান্না হলেই আগ্রহ করে নিচে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়িঅলাদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা আনিসের পছন্দ নয়। বাড়িঅলাদের সে সব সময় শত্রুপক্ষ মনে করে। কয়েক বার ভেবেছিল বলবে মেলামেশাটা কমাতে। না বলে ভালোই হয়েছে, এত যদি অসুখটা চাপা পড়ে তো ভালোই।
কাজের একটি ছেলে পাওয়া গেছে-জিতু মিয়া। এই ছেলেটিও রানুকে বেশ ব্যস্ত রাখছে। ছেলেটির বয়স দশ-এগার, তবে মহাবোকা। কোনো কাজই করতে পারে না। করার আগ্রহও নেই। রানু ক্রমাগত বকঝকা করেও কিছু করাতে পারে না। তবে তার সময় বেশ কেটে যায়।
সন্ধ্যাবেলা সে আবার জিতু মিয়াকে নিয়ে পড়াতে বসে। জিতু ঘুমঘুম চোখে পড়ে ‘স্বরে অ স্বরে আ’। এই পড়াটি গত এক সপ্তাহ ধরে চলছে। জিতু মিয়া কিছুই মনে রাখতে পারছে না, কিন্তু তাতে রানুর উৎসাহে ভাটা পড়েছে না।
আনিস মিয়া একদিন ঠাট্টা করে বলেছে, ‘তুমি দেখি একে বিদ্যাসাগর বানিয়ে ফেলছ!’ রানু তাতে বেশ রাগ করেছে। গম্ভীর হয়ে বলেছে, ‘ঠাট্টা করছ কেন? বিদ্যাসাগর তো একদিন হতেও পারে।’
অবশ্য অদূর-ভবিষ্যতে তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ভবিষৎ-বিদ্যাসাগর রোজ রাতেই পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে পড়ছে এবং রানু প্লেটে খাবার বেড়ে প্রতি রাতেই প্রাণাস্ত চেষ্টা চালাচ্ছে। এতটা বাড়াবাড়ি আনিসের ভালো লাগে না, কিন্তু সে কিছুই বলে না। থাকুক একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত।
এর মধ্যে একদিন আনিস গিয়েছিল মিসির আলি সাহেবের কাছে। ভদ্রলোক বেশ কিছু দিন ঢাকায় ছিলেন না। সবে ফিরেছেন। তাঁর চোখ হলুদ, গা হলুদ।
আনিস অবাক হয়ে বলেছে, ‘হয়েছে কী আপনার?’
‘জন্ডিস। জন্ডিস বাধিয়ে বসেছি।’
‘বলেন কী!’
‘ইনফেকটাস হেপাটাইটিস। লিভারের অবস্থা কাহিল রে ভাই! আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?’
‘ভালো।’
‘আর ভয়টয় পাচ্ছেন না?’
‘জ্বি-না।’
‘খুব ভালো খবর। আমি একটু সুস্থ হলেই যাব আপনার বাসায়।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘আমি কিছু খোঁজখবর পেয়েছি। মনে হয় আপনার স্ত্রীর সমস্যাটি ধরতে পেরেছি।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, একটু ভালো হলেই এনিয়ে কথা বলব।’
রানু মিসির আলি সাহেবের জন্ডিসের খবরে খুবই মন-খারাপ করল।
‘আহা, বেচারা একা-একা কষ্ট করছে।চল এক দিন দেখে আসি। যাবে?’
‘ীঠক আছে, যাব একদিন।’
‘কবে যাবে? কাল যাব?’
‘এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? জন্ডিস যখন হয়েছে, তখন বেশ কিছু দিন থাকবে। এক দিন দেখে এলেই হবে।’
‘আমি এই অসুখরে ভালো অষুধ জানি। অড়হড়ের পাতার রস। সকালবেলা এক গ্লাস করে খেলে তিন দিনে অসুখ সেরে যাবে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। আমার দাদা এই অষুধটা দিতেন। তুমি কিছু অড়হড়ের পাতা ঐ লোকটিকে দিয়ে এস না।’
‘ঢাকা শহরে আমি অড়হড়ের পাতা কোথায় পাব? কী যে বল!’
‘খুঁজলেই পাবে। জংলা গাছ সব জায়গায় হয়।’
আনিস যথেষ্ট বিরক্ত হলো। রানুর এই একটা প্রবলেম-কোনো-একটা জিনিস মাথায় ঢুকলে ওটা নিয়েই থাকবে। আনিস বলল, ‘আচ্ছা, দেখি।’
‘দেখাদেখি না,তুমি খুঁজবে । আর শোন, কাল তো তোমার অফিস নেই, চল ওনাকে দেখে আসি।’
‘এত ব্যস্ত কেন? ভদ্রলোক তো আর পালিয়ে যাচ্ছেন না।’
রানু থেমে- থেমে বলল, ‘আমি অন্য একটা কারণে যেতে চাই।’
‘কি কারণ?’
‘ভদ্রলোক আমার সম্পর্কে খোঁজখবর করার জন্যে মধুপুর গিয়েছিলেন,কী খোঁজ পেলেন জানতে ইচ্ছা করছে।’
‘মধুপুরের খবর পেলে কীভাবে? স্বপ্নে?’
‘না, স্বপ্নটপ্ন না। অনূফা চিঠি দিয়েছে।’
‘কবে চিঠি পেয়েছ?’
‘গতকাল।’
আনিস চুপ করে গেল। রানু তার নিজের চিঠিপত্রের কথা আনিসকে কখনো বলে না। বিয়ের পর রানু তার আত্মীয়স্বজনের যত চিঠিপত্র পেয়েছে তার কোনোটি সে আনিসকে পড়তে দেয় নি। এ নিয়ে আনিসের গোপন ক্ষোভ আছে।
‘কি আমাকে নিয়ে যাবে?’
‘আমি আগে গিয়ে দেখে ভদ্রলোকের অবস্থা কেমন।’
মিসির আলিকে পাওয়া গেল না। বাড়িতে তাঁর এক ছোট ভাই ছিল, সে বলল, ‘ভাইয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অবস্থা বেশি ভালো না। বিলরুবিন নাইন পয়েন্ট ফাইভ। লিভার খুবই ড্যামেজ্ডৃ।
দেবী – ১১
১১
মিসির আলি হাসপাতালে এসেছেন একগাদা বই নিয়ে। তাঁর ধারণা ছিল বই পড়ে সময়টা খুব খারাপ কাটবে না, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। ডাক্তাররা বই পড়তে নিষেধ করেন নি, কিন্তু দেখা গেল বই পড়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই মাথার ভেতর ভোঁতা এক ধরনের যন্ত্রণা হয়। যন্ত্রণা নিয়ে এই বই পড়ে ফেললেন এবং মৃত্যু ব্যাপারটিতে যথেষ্ট উৎসাহ বোধ করতে লাগলেন। তাঁর স্বভাবই হচ্ছে কোনো বিষয় একবার মনে ধরে গেলে সে বিষয়ে সম্পর্কে চূড়ান্ত পড়াশোনা করতে চেষ্টা করেন।
মৃত্যু সাবজেক্টটি তাঁর পছন্দ হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারছেন না। বইপত্র নেই। ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে কিছু থাকার কথা, কিন্তু আনাবেন কাকে দিয়ে? তাঁকে কেউ দেখতে আসছে না। তিনি এমন কোনো জনপ্রিয় ব্যক্তি নন যে তাঁর অসুস্থতার খবরে মানুষের ঢল নামবে। তা ছাড়া অসুখের খবর তিনি কাউকে জানান নি। হাসপাতালে ভর্তি হবার ইচ্ছাও ছিল না, কিন্তু ঘরে দেখাশোনার লোক নেই। কাজের মেয়েটি তিনি মধুপুর থাকাকালীন বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ভেগে গেছে। এমন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়া উপায় কী?
বিকালবেলা তাঁর কাছে কেউ আসে না। সবারই আত্মীয়স্বজন আসে দেখতে, তাঁর কাছে কেউ আসে না। এই সময়টা তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন এবং এখনো মানুষের সঙ্গ পাবার জন্যে তাঁর মন কাঁদে দেখে নিজের কাছেই লজ্জিত বোধ করেন।
আজ সারা দিন মিসির আলির খুব খারাপ কেটেছে। তাঁর রুমমেট ছাব্বিশ বছরের ছেলেটি সকাল ন’টায় বিনা নোটিসে মারা গেছে। মৃত্যু যে এত দ্রুত মানুষকে ছুঁয়ে দিতে পারে তা তার ধারণাতেও ছিল না। ছেলেটা ভোরবেলায় নাস্তা চেয়েছে, তার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথাবার্তাও বলেছে। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আজ কেমন আছ?’
‘আজ বেশ ভালো।’
‘লিভার ব্যাথা করছে না?’
‘নাহ্,তবে তলপেটের দিকে একটা চাপা ব্যাথা আছে।’
‘এটা একটা সায়েন্স ফিকশন-“ফ্রাইভে দি খার্টিস’”। বেশ ভালো বই। তুমি পড়বে?’
‘জ্বি-না। ইংরেজি বই আমার ভালো লাগে না। বাংলা উপন্যাস পড়ি।’
‘কার লেখা ভালো লাগে? এ দেশের-মানে বাংলায়, কার লেখা তোমার পছন্দ?’
‘নিমাই ভট্টাচার্য।’
‘তা নাকি?’
ছেলেটি আর জবাব না দিয়ে কাৎরাতে থাকে। সকাল সাড়ে আটটায় বলল,‘এক জন ডাক্তার পাওয়া যায় কি না দেখবেন?’ তিনি অনেকক্ষণ বোতাম টিপলেন,কেউ এল না। শেষ পর্যন্ত নিজেই গেলেন ডিউটি রুমে। ফিরে এসে দেখেন ছেলেটি মরে পড়ে আছে।
মৃত্যুর সময় পাশে কেউ থাকবে না, এর চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু নেই। শেষ বিদায় নেবার সময় কোনো-একজন মানুষকে বলে যাওয়া দরকার। নিঃসঙ্গ ঘর থেকে একা-একা চলে যাওয়া যায় না। যাওয়া উচিত নয়। এটা হৃদয়হীন ব্যাপার।
এত দিন যে ছেলেটি ছিল, এখন আর সে নেই। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই তার সমস্ত চিহ্ন এ ঘর থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বিছানায় নতুন বালিশ ও চাদর দিয়ে গেছে-হয়তো সন্ধ্যার মধ্যে কোনো নতুন পেশেন্ট এসে পড়বে।
মিসির আলি সমস্ত দিন কিছু খেতে পারলেন না। বিকেলের দিকে তাঁর গায়ে বেশ টেম্পারেচার হলো। প্রথম বারের মতো মনে হলো একজন-কেউ তাঁকে দেখতে এলে খারাপ লাগবে না। ভালোই লাগবে। কেউ না এলে এক জন রোগী হলেও আসুক, একা-একা এই কেবিনে রাত কাটানো যাবে না। ঠিক এই সময় ইতস্তত ভঙ্গিতে রানু এসে ঢুকল।
‘আপনি ভালো আছেন?’
‘না, ভালো না। তুমি কোথেকে?’
‘বাসা থেকে।ইস্! আপনার এ কী অবস্থা!’
‘অবস্থা খারাপ ঠিকই।আনিস সাহেব কোথায়?’
‘ও আসে নি, আমি একাই এলাম। ওর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছি।’
‘বস তুমি। ঐ চেয়ারটায় বস। ফ্লাস্কে চা আছে। খেতে চাইলে খেতে পার।’
‘উঁহু, চা-টা খাব না। আপনার কাছে একটা খবর জানতে এসেছি।’
‘কোন খবরটি?’
‘মধুপুরে গিয়ে আপনি কী জানলেন?’
‘তেমন কিছু জানতে পারি নি।’
‘তবু যা জেনেছেন তা-ই বলুন। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে। অনুফা লিখেছে, আপনি নাকি হাজার-হাজার মানুষকে নানা রকম প্রশ্ন করেছেন।’
মিসির আলি হাসলেন।
‘হাসলে হবে না, আমাকে বলতে হবে।’
‘প্রথম যে জিনিসটি জানলাম-সেটি হচ্ছে, তুমি অনেকগুলো ভুল তথ্য দিয়েছ।’
‘ আমি কোনো তথ্য দিই নি।’
‘তুমি নিজে হয়তো জান না সেগুলো ভুল। যেমন পায়জামা খোলার ব্যাপারটি-এ রকম কোনো কিছু ঘটে নি।
রানু চোখ লাল করে বলল, ‘ঘটেছে।’
‘না রানু। এইসব তুমি নিজে ভেবেছ এবং আমার ধারণা এ জাতীয় স্বপ্ন তুমি মাঝে-মাঝে দেখ। দেখ না?’
‘কী রকম স্বপ্নের কথা বলেছেন?’
মিসির আলি কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন। স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘তুমি প্রায়ই স্বপ্ন দেখ না- এক জন নগ্ন মানুষ তোমার কাপড় খোলার চেষ্টা করছে?’
রানু উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে থাকল।
‘বল রানু। জবাব দাও।’
‘হ্যাঁ, দেখি।’
‘কখনো কি ভেবে দেখেছ এ স্বপ্ন কেন দেখ?’
‘না, ভাবি নি।’
‘আমি ভেবিছি এবং কারণটাও খুঁজে বের করেছি। আজ সেটা বলতে চাই না, অন্য একদিন বলব।’
‘না, আপনি আমাকে আজই বলেন।’
‘মিসির আলি ফ্লাস্ক থেকে চা ঢাললেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘চা খেতে-খেতে শোন। চায়ে ক্যাফিন আছে। ক্যাফিন তোমার নার্ভগুলোকে অ্যাকটিভ রাখবে।’
রানু চায়ের পেয়ালা নিল, কিন্তু চুমুক দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। মিসির আলি ঠান্ডা গলায় বলতে লাগলেন, ‘রানু, তোমাকে নিয়ে এই গল্পটি আমি তৈরি করেছি। তুমি মন দিয়ে শোন। তুমি যখন বেশ ছোট-নয়, দশ বা এগার বছর বয়স, তখন এক জন বয়স্ক লোক তোমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নির্জন কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। তোমাদের গ্রামে এরকম একটা নির্জন জায়গায় খোঁজে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে জঙ্গলের কাছে একটা ভাঙ্গা বিষ্ণুমন্দির দেখেছি। মনে হয় ঐ জায়গাটাই হবে। কারণ সাপের ভয়ে ওখানে কেউ যেত না। রানু, তুমি কি আমার কথা শুনেছ?’
‘শুনছি।’
‘তারপর সেই বয়স্ক মানুষটি মন্দিরে তোমাকে নিয়ে গেল।’
‘আমাকে কেউ নিয়ে যায় নি। আমি নিজেই গিয়েছিলাম। ঐ মন্দিরে খুব সুন্দর একটি দেবীমূর্তি আছে। আমি ঐ মূর্তি দেখার জন্যে যেতাম।’
‘তারপর কী হয়েছ, বল।’
রানু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তীব্র স্বরে বলল, ‘আমি বলব না, আপনি বলুন।’
মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন,‘ঐ লোকটি তখন টেনে তোমার পায়জামা খুলে ফেলল।’
রানুর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
‘ঐ লোকটির নাম ছিল জালালউদ্দিন।’
রানু কিছু বলল না। মিসির আলি বললেন, ‘তোমার অসুখ শুরু হলো সেদিন থেকে। তোমার মনের মধ্যে ব্যাপারটি গেঁথে গেল, পরবর্তী সময়ে গোসলের সময় যখন মরা মানুষটি তোমার পায়ে লেগে গেল, তখন তোমার মনে পড়ল মন্দিরের দৃশ্য। বুঝতে পারছ?’
রানু জবাব দিল না।
‘অসুখের মূল কারণটি আলোয় নিয়ে এলেই অসুখ সেরে যায়; এ জন্যেই আমি এটা তোমাকে বললাম। তুমি নিজেও এখন গোড়া থেকে সমস্ত ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা করবে। তোমার অসুখ সেরে যাবে।’
রানু মৃদু স্বরে বলল, ‘আপনি কি ঐ লোকটির সঙ্গে কথা বলেছেন?’
‘বলেছি।’
‘ও কী বলেছে?’
‘তেমন কিছু বলে নি।’
‘না, বলেছে, আপনি আমাকে বলতে চাচ্ছেন না। একটা যখন বলেছেন, তখন বাকিটাও বলুন।’
রানু তীব্র চোখে তাকাল। মিসির আলি বললেন, ‘দেখ রানু, আমি খুবই যুক্তিবাদী মানুষ। অলৌকিক কোনো কিছুতে বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি সব কিছুরই একটি ব্যাখা আছে। জালালউদ্দিন যা বলেছে, তাও নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করা যায়।’
‘আপনি জালালউদ্দিনের কথা বিশ্বাস করেন না?’
‘না ওর মনে পাপবোধ ছিল। মন্দিরটন্দির নিয়ে মূর্খ মানুষদের মনে অনেক রকম ভয়-ভীতি আছে। তা থেকেই সে একটা হেলুসিনেশন দেখেছে। তুমি নিজে তো কিছু দেখ নি।’
‘না।’
‘তাহলেই হলো। জালালউদ্দিন কী দেখেছে না-দেখেছে, সেটা তার প্রবলেম, তোমার নয়।’
রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘কিন্তু একটা জিনিস কি জানেন? ঐ ঘটনার পর থেকে আমি অসম্ভব সুন্দর হয়ে গেলাম।’
মিসির আলি শব্দ করে হাসলেন। হাসতে-হাসতে বললেন, ‘সুন্দর তুমি সব সময়ই ছিলে। ঘটানাটি ঘটেছে তোমার বয়ঃসন্ধিতে। বয়ঃসন্ধির পর মেয়েদের রূপ খুলতে শুরু করে। এখানেও তাই হয়েছে।’
‘কিন্তু ঐ দেবীমূর্তিটিকে এর পর আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।’
‘তুমি কিন্তু খুব ছেলেমানুষের মতো কথা বলছ রানু। মূর্তিটি চুরি গেছে, কেউ নিয়ে পালিয়ে গেছে, ব্যস।,
‘মূর্তিটি চুরি যায় নি।’
‘তুমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস কর না-একটা পাথরের মূর্তি তোমার মধ্যে ঢুকে আছে? কি, কর?’
রানু তীব্র কণ্ঠে বলল, ‘আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলুন, আমাকে কি অনেকটা মূর্তির মতো দেখায় না?’
‘না রানু, মূর্তির মতো দেখাবে কেন? অসম্ভব রূপবর্তী একটি তরুণী-এর বেশি কিছু না। তোমার মতো রূপবর্তী মেয়ে এ দেশেই আছে এবং তারা সবাই রক্ত-মাংসের মানুষ।’
‘রানু উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি বললেন, ‘চলে যাচ্ছ রানু?’
‘হ্যাঁ।’
‘অসুখ সারলে তোমাদের ওখানে একবার যাব।’
‘না, আপনি আসবেন না। আপনার আসার কোনো দরকার নেই।’
রানু ঘর ছেড়ে চলে গেল। মিসির আলি ক্ষীণস্বরে বললেন, ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং।’ তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত হলো।তিনি ব্যাপরটি ঠিক বুঝতে পারছেন না। যতটা সহজ মনে হয়েছিল এখন ততটা মনে হচ্ছে না। তিনি মৃত্যু-বিষয়ক বইটি আবার পড়তে শুরু করলেন। সাবজেক্টটি তাঁকে বেশ আকর্ষণ করেছে। ফ্যাসিনেটিং টপিক।
দেবী – ১২
১২
গভীর রাতে আনিস জেগে উঠল। শুনশান নীরবতা চারদিকে। রানু হাত-পা ছড়িয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো ঘুমোচ্ছে। জানলার আলো এসে পড়েছে তার মুখে। অদ্ভুদ সুন্দর একটি মুখ। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। আনিস ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। বাথরুমে যেতে হবে।
বাথরুমে পানি জমে আছে। পাইপ জ্যাম হয়ে গেছে। বাড়িঅলাকে বলতে হবে। আনিস নোংরা পানি বাঁচিয়ে সাবধানে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই শুনল ঝুমঝুম করে শব্দ হচ্ছে। নতুন বাজছে যেন। এর মানে কী? মানের ভুল কি? মনের ভুল হবার কথা নয়। বেশ বোঝা যাচ্ছে নূপুর পায়ে দিয়ে ঝমঝম করতে-করতে কেউ-একজন এঘর-ওঘর করছে। শব্দটা অনেকক্ষণ ধরইে হচ্ছে। মনের ভুল হবার কথা নয়।
বাথরুমের দরজা খুলতেই শব্দটা চট করে থেমে গেল। শুধু একটা তীব্র ফুলের গন্ধ আনিসকে অভিভুত করে ফেলল। একটু আগেও তো এ রকম সৌরভ ছিল না।আনিসের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। বিস্ময়ের ঘোর অবশ্যি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আনিসের মনে পড়ল একতলার বাগানে হাস্নাহেনার প্রকাণ্ড একটা ঝাড় আছে। বাতাসের ঝাপটায় ফুলের গন্ধই উড়ে এসেছে বারান্দায়। আনিস কিছুক্ষণ একা-একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল-নূপুরের শব্দ আবার যদি পাওয়া যায়।
দোতলায় একটা বাচ্চা ছেলে শুধু কাঁদছে। তার মা তাকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে। একটা রিকশা গেল টুনটুন করে। ব্যস, আর কিছু শোনা গেল না।
শোবার ঘরে রানু ঘুমাচ্ছে। মড়ার মতো। জানালা খোলা। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে ঘরে। আনিস জানালা বন্ধ করতে গিয়ে শুনল, রান্নাঘর থেকে জিতু মিয়া সাড়াশব্দ দিচ্ছে। কান্না চাপার আওয়াজ।
‘জিতু মিয়া।’
জিতু ফুঁপিয়ে উঠল। আনিস রান্নাঘরে ঢুকে বাতি জ্বালাল। জিতু মশারির ভেতর জুবথবু হয়ে বসে আছে।
‘জিতু, কি হয়েছে রে?’
‘কিছু হয় নাই।’
‘বসে আছিস কেন?’
‘ঘুম আহে না।’
‘স্বপ্ন দেখেছিস?‘
জিতু মাথা নাড়ল।
‘কী স্বপ্ন?’
‘এক জন মাইয়া মানুষ পাকের ঘরে হাঁটতে আছিল।’
‘এই দেখেছিস স্বপ্নে?’
‘স্বপ্নে দেখি নাই। নিজের চোখে দেখলাম।’
‘দূর ব্যাটা, অন্ধকারে তুই মানুষ দেখলি কীভাবে? যা, ঘুমো তুই।’
‘আচ্ছা।’
জিতু শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। আনিস একটি সিগারেট ধরাল। ঘুম চটে গেছে। তাকে এখন দীর্ঘ সময় জেগে থাকতে হবে। এক পেয়লা চা খেতে পারলে মন্দ হত না। রাত তো বাজে প্রায় সাড়ে তিনটা। বাকি রাতটা তার জেগেই কাটবে মনে হয়। সিগারেট টানতে ভালো লাগছে না। পেটের ভেতর পাক দিয়ে উঠছে।
ঘুমের মধ্যে রানু শব্দ করে হাসল। আনিস মৃদু স্বরে ডাকল, ‘এই রানু।’রানু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘কি?’
‘জেগে আছ নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী আশ্চার্য, কখন জাগলে?’
‘অনেকক্ষণ। তুমি বাথরুমে গেলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে।’
‘আমাকে ডাকলে কেন?’
আনিস সিগারেট টানতে লাগল। রানু বলল, ‘বড্ড গরম লাগছে। জানালা বন্ধ করলে কেন?’
‘গরম কোথায়? বেশ ঠাণ্ডা তো!’
‘আমার গরম লাগছে। ফ্যানটা ছাড় না।’
‘এই ঠাণ্ডার মধ্যে ফ্যান ছাড়ব কি, কী যে বল!’
রানু ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘তুমি যখন বাথরুমে ছিলে তখন কি নূপুরের শব্দ শুনেছ?’
আনিস ঠাণ্ডা স্বরে বলল, ‘না তো কেন?’
‘না, এমনি। আমি শুয়ে-শুয়ে শুনছিলাম।’
‘ঘুমাও রানু।’
‘আমার ঘুম আসছে না।’
‘ঘুম না এলে উঠে বস, গল্প করি। চা খাওয়া যেতে পারে, কি বল?’
রানু উঠে বসল, কিন্তু জবাব দিল না। আনিস দেখল রানু কোন ফাঁকে গায়ের কাপড় খুলে ফেলেছে। ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘বড্ড গরম লাগছে। তুমি আমার দিকে তাকিও না, প্লীজ।’
‘এইসব কী রানু? ঘরে একটা বাচ্চা ছেলে আছে।’
‘কী করব, বড্ড গরম লাগছে। তুমি বরং রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে সব অন্ধকার করে দাও।’
‘না, বাতি জ্বালানো থাক।’
‘আনিস দ্বিতীয় সিগারেট ধরাল। রানু বলল, ‘আমাদের গ্রামে একটা মন্দির আছে, তার গল্প এখন শুনব না।’
‘আহ্, মন্দির-ফন্দিরের গল্প এখন শুনব না।’
‘আহ্, শোন না। আমার বলতে ইচ্ছে করছে। আমি যখন খুব ছোট, তখন একা-একা যেতাম সেখানে।’
‘কি মন্দির? কালীমন্দির?’
‘নাহ্, বিষ্ণূমন্দির বলত ওরা।তবে কোনো বিষ্ণূমুর্তি ছিল না। একটি দেবী ছিল। হিন্দুরা বলত রুকমিনী দেবী।’
‘তুমি মন্দিরে যেতে কী জন্যে?’
‘এমনি যেতাম। ছোট বাচ্চা পুতুল খেলে না?’
‘কী করতে সেখানে?’
‘দেবীমূর্তির সাথে গল্পগুজব করতাম। ছেলেমানুষি খেলা আর কি!’
বলতে-বলতে রানু খিলখিল করে হেসে উঠল। আনিস স্পষ্ট শুনল সঙ্গে-সঙ্গে ঝমঝম করে কোথাও নুপুর বাজছে। রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘শুনতে পাচ্ছ?’
‘কী শুনব?’
‘নূপুরের শব্দ শুনছ না?’
আনিস দৃঢ় স্বরে বলল, ‘না। তুমি ঘুমাও রানু।’
‘আমার ঘুম আসছে না।’
‘শুয়ে থাক। তুমি অসুস্থ।’
‘রানু ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি অসুস্থ।’
‘তোমাকে খুব বড় ডাক্তার দেখাব আমি।’
‘আচ্ছা।’
‘এখন শুয়ে থাক।’
রানু মৃদু স্বরে বলল, ‘আমি ঐ দেবীকে গান গেয়ে শোনাতাম।’
‘ঐ সব অন্য দিন শুনব।’
‘আজ রাতে আমার বলতে ইচ্ছে করছে।’
আনিস এসে রানুর হাত ধরল। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। আনিস অবাক হয়ে বলর, ‘তোমার গা তো পুড়ে যাচ্ছে!’
‘হুঁ, বড্ড গরম লাগছে। ফ্যানটা ছাড়বে?’
আনিস উঠে গিয়ে জানালা খুলে দিল। ঘর ভর্তি হয়ে গেল ফুলের গন্ধে। আর তখনি রানু অত্যন্ত নিচু গলায় গুনগুন করে কী যেন গাইতে লাগল। অদ্ভুত অপার্থিব কোনো-একটা সুর-যা এ জগতের কিছু নয়। অন্য কোনো ভূবনের। রান্নাঘর থেকে জিতু ডাকতে লাগল, ‘ও ভাইজান, ভাইজান।’
আনিস রানুকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে গায়ের চাদর টেনে দিল। জিতুকে বলল, এ ঘরে যেন না আসে। তারপর নেমে গেল নিচে, বাড়িঅলার মেয়েটিকে খবর দিয়ে নিয়ে আসতে।
নীলু এল সঙ্গে সঙ্গে। আনিস দেখল রানু শিশুর মতো ঘুমাচ্ছে। জিতু মিয়া শুধু জেগে আছে। কাঁদছে ব্যাকুল হয়ে। নীলুর সঙ্গে তার বাবাও আসছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘হয়েছেটা কি?’ আনিস ভাঙ্গা গলায় বলল, ‘বুঝতে পারছি না, কেমন যেন করছে।’
‘কী করছে?‘
আনিস জবাব দিল না। নীলু বলল, ‘বাবা, তুমি শুয়ে থাক গিয়ে, আমি এখানে থাকি। রাত তো বেশি নেই।’ ভদ্রলোক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিচে নেমে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন,‘হাসপাতালে নিতে হলে বলবেন, ড্রাইভারকে ডেকে তুলব।’
‘জি আচ্ছা।’
রানু বাকি রাতটা ঘুমিয়ে কাটাল। একবারও জাগল না। নীলু সারাক্ষণ তার পাশে রইল। আনিসের সঙ্গে তার কথাবার্তা কিছু হলো না। আনিস বসার ঘরের সোফায় বসে ঝিমুতে লাগল।
দেবী – ১৩
১৩
মিসির আলি লোকটির ধের্য প্রায় সীমাহীন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তিনি দ্বিতীয় দফায় রানুদের গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁর সঙ্গে প্রত্নতও্ব বিভাগের এক ভদ্রলোক, জয়নাল সাহেব। উদ্দেশ্য রুকমিনী দেবীর মন্দির সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা।
জয়নাল সাহেব মন্দির দেখে বিশেষ উল্লসিত হলেন না। তিন শ’ বৎসরের বেশি এর বয়স হবে না। এরকম ভগ্নস্তূপ এ দেশে অসংখ্য আছে। মিসির আলি বললেন, ‘তেমন পুরোনো নয় বলেছেন?’
‘না রে ভাই। ইটের সাইজ দেখলেন বুঝবেন। ভেঙে-টেঙে কী অবস্থা হয়েছে দেখেন!’
‘যত্ন হয় নি। মন্দির যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি হয়তো মারা গেছেন কিংবা তাঁর উৎসাহ মিইয়ে গেছে।’
গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে অল্প কিছু তথ্য পাওয়া গেল-পালবাবুদের প্রতিষ্ঠিত মন্দির। পালরা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তার পরপরই তাদের ভাগ্য-বিপর্যয় শুরু হয়। তিন-চার বছরের মধ্যে পালরা নির্বংশ হয়ে পড়ে। দেবীকে তুষ্ট করার জন্যে তখন এক রাতে কুমারীকন্যাকে অমাবস্যা রাত্রিতে মন্দিরের সামনে বলি দেয়া হয়। দেবীর তুষ্টি হয় না তাতেও। পাথরের মূর্তি এত সহজে বোধহয় তুষ্ট হয় না। তবে গ্রামের মানুষেরা নাকি বলি দেয়া মেয়েটিকে এর পর থেকে গ্রামময় ছুটোছুটি করতে দেখে। ময়মনসিংহ থেকে ইংরেজ পুলিশ সুপার এসে মন্দির তালাবন্ধ করে পালদের দুই ভাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান।
পালরা অত্যন্ত ক্ষমতাবান ছিল। কাজেই ছাড়া পেয়ে এক সময় আবার গ্রামে ফিরে আসে, কিন্তু মন্দির তালাবন্ধই পড়ে থাকে।
ইতিহাস এইটুকুই। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত মূর্তি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা গেল না। দুই-এক ঘর নিম্নবর্ণের হিন্দু যারা ছিল, তারা বিশেষ কিছু বলতে পারে না। হরিশ মণ্ডল বলল, ‘বাবু, আমার কেউ ঐ দিকে যাই না। ঐ মন্দিরে গেলে নির্বংশ হতে হয়, কে যাবে বলেন?’
‘আপনি তো শিক্ষক লোক, এইসব বিশ্বাস করেন?’
‘করি না, কিন্তু যাইও না।’
‘মূর্তিটা আপনি দেখেছেন?’
‘আমি দেখি নাই, তবে আমার জ্যাঠা দেখেছে।’
‘তিনি কি নির্বংশ হয়েছেন?’
‘না তাঁর তিন ছেলে। এক ছেলে নান্দিনা হাইস্কুলের হেড মাস্টার।’
‘মূর্তিটা কেমন ছিল বলতে পারেন?’
‘শ্বেত পাথরের মূর্তি। কৃষ্ণনগেরর কারিগরের তৈরি। একটা হাত ভাঙা ছিল।’
‘মূর্তিটা নাকি হঠাৎ উধাও হয়েছে?’
‘কেউ চুরিটুরি করে নিয়ে বিক্রি করে ফেলেছে। গ্রামে চোরের তো অভাব নাই। এ রকম একটা মূর্তিতে হাজার খানিক টাকা হেসেখেলে আসবে। সাহেবেরা নগদ দাম দিয়ে কিনবে।’
‘আচ্ছা, একটা বাচ্চা মেয়ে যে বলি দেয়া হয়েছিল, সে নাকি অমাবস্যার রাত্রে ঘুরে বেড়ায়?’
‘বলে তো সবাই। চিৎকার করে কাঁদে। আমি শুনি নাই। অনেকে শুনেছে।’
অমাবস্যার জন্যে মিসির আলিকে তিন দিন অপেক্ষা করতে হলো। তিনি অমাবস্যার রাত্রে একটা পাঁচ-ব্যাটারির টর্চ আর একটা মোটা বাঁশের লাঠি নিয়ে মন্দিরের চাতালে বসে রইলেন। তিনি কিছুই শুনলেন না। শেয়ালের ডাক শোনা গেল অবশ্যি। শেষ রাত্রের দিকে প্রচণ্ড বাতাস বইতে লাগল। বাতাসে শিষ দেবার মতো শব্দ হলো। সে সব নিতান্তই লৌকিক শব্দ। অন্য জগতের কিছু নয়। রাত শেষ হবার আগে-আগে বর্ষণ শুরু হলো। ছাতা নিয়ে যান নি। মন্দিরের ছাদ ভাঙা। আশ্রয় নেবার জায়গা নেই। মিসির আলি কাকভেজা হয়ে গেলেন।
ঢাকায় ফিরলেন প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে। ডাক্তার পরীক্ষা করে শুকনো মুখে বললেন, ‘মনে হচ্ছে নিউমোনিয়া। একটা লাংস এফেকটেড, ভোগাবে।’
মিসির আলিকে সত্যি-সত্যি ভোগল। তিনি দীর্ঘ শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন।
দেবী – ১৪
১৪
বইপড়াতে এ সময় লোকজন তেমন থাকে না। আজ যেন আরো নির্জন। নীলু একা-একা কিছুক্ষণ হাঁটল। তার খুব ঘুম হচ্ছে। বারবার সবুজ রুমালটি বের করতে হচ্ছে। চারটা দশ বাজে। চিঠিতে লিখেছে সে চারটার মধ্যেই আসবে, কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নীলু অবশ্যি কারো মূখের দিকে তাকাতেও পারছে না। কাউকে তাকাতে দেখলেই বুকের মধ্যে ধক করে উঠছে।
নীলু একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে পড়ল। গল্পের বই তার তেমন ভালো লাগে না। ভালো লাগে বিলুর। বিলুর জন্যে একটা কিছু কিনলে হয়. কিন্তু কী কিনবে? সবই হয়তো ওর পড়া। ঐ দিন শীর্ষেন্দুর কী-একটা বইয়ের কথা বলছিল। নামটা মনে নেই।
‘আচ্ছা, আপনাদের কাছে শীর্ষেন্দুর কোনো বই আছে?’
‘জ্বি-না। আমরা বিদেশি বই রাখি না।’
নীলু অন্য একটা ঘরে ঢুকল। শুধু-শুধু দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সে একটা কবিতার বই কিনে ফেলল। অপরিচিত কবি, তবে প্রচ্ছদটি সুন্দর। একটি মেয়ের ছবি। সুন্দর ছবি। নামটি সুন্দর-‘প্রেম নেই’। কেমন অদ্ভুত নাম। ‘প্রেম নেই’ আবার কী? প্রেম থাকবে না কেন?’
দাড়িঅলা এক জন রোগা ভদ্রলোক এক রোগা ভদ্রলোক তখন থেকেই তার দিকে তাকাচ্ছে। লোকটির কাঁধে একটি ব্যাগ। এই কি সে! নীলুর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। নীলু বইয়ের দাম দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল। তার পেছনে ফেরারও সাহস নেই।পেছেনে ফিরলেই সে হয়তো দেখবে বুড়ো দাড়িঅলা গুটিগুটি আসছে।
না, লোকটি আসছে না। নীলুর মনে হলো, ভয়ানক মোটা এবং বেঁটে একজন কে যেন তাকে অনূসরণ করছে। তার দিকে তাকাচ্ছে না, কিন্তু আসছে তার পিছু পিছু। নীলুর তৃষ্ণা পেয়ে গেল। বড্ড টেনশান। বাড়ি ফিরে গেলে কেমন হয়? কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। নীলু ঘড় িদেখল, পাঁচটা পাঁচ। তার মানে কি যে সে আসবে না? কথা ছিল নীলু থাকবে ঠিক এক ঘন্টা।
সে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ভালোই হয়েছে। দেখা না-হওয়াটাই বোধহয় ভালো। দেখা হবার মধ্যে একটা আশাভঙ্গের ব্যাপার আছে। না-দেখার রহস্যময়তাটাই না হয় থাকুক। নীলু ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল।
‘নীলু।’
নীলু দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘একটু দেরি হয়ে গেল। তুমি ভালো আছ নীলু?’
চকচকে লাল টাই-পরা যে ছেলেটি হাসছে,সে কে? লম্বা স্বাস’্যবান একটি তরুণ। ঝলমল করছে। তার লাল টাই উড়ছে। বাতাসে মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। সেন্টের গন্ধ। পুরুষ মানুষের গা থেকে আসা সেন্টের গন্ধ নীলুর পছন্দ নয়, কিন্তু আজ এত ভালো লাগছে কেন?
‘চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু বল।’
‘আপনি বলেছিলেন আপনি বুড়ো।’
‘আমরা সবাই কিছু-কিছু মিথ্যা বলি। আমাকে নীলু নামের একটি মেয়ে লিখেছিল, সে দেখতে কুৎসিত।’
লোকটি হাসছে হা হা করে। এত সুন্দর করেও মানুষ হাসতে পারে! নীলুর এক ধরনের কষ্ট হতে লাগল। মনে হতে লাগল সমস্তটাই একটা সুন্দর স্বপ্ন, খুবই ক্ষণস্থায়ী। যেন এক্ষুণি স্বপ্ন ভেঙে যাবে। নীলু দেখবে সে জেগে উঠছে, পাশের বিছানায় বিলু ঘুমাচ্ছে মশারি না-ফেলে, কিন্তু সে রকম কিছু হলো না। ছেলেটি হাসিমুখে বলল, ‘কোথাও বসে এক কাপ চা খেলে কেমন হয়? খাবে?’
নীলু মাথা নাড়ল-সে খাবে।
‘তুমি কিন্তু সবুজ রুমালটি ব্যাগে ভরে ফেলছ। আমি যেতে ঠিক সাহস পাচ্ছি না।’
নীলু অস্বাভাবিক ব্যস্ত হয়ে রুমাল বের করতে গেল।একটা লিপস্টিক,একটা ছোট চিরুনি,কিছু খুচরো পয়সা গড়িয়ে পড়ল নিচে। ছেলেটি হাসিমুখে সেগুলো কুড়াচ্ছে। নীলু মনে-মনে বলল-যেন এটা স্বপ্ন না হয়। আর স্বপ্ন হলেও যেন স্বপ্নটা অনেকক্ষণ থাকে। নীলুর খুব কান্না পেতে লাগল।
নিউ মার্কেটের ভেতর চা খাওয়ার তেমন ভালো জায়গা নেই। ওরা বলাকা বিল্ডিংয়ের দোতলায় গেল। চমৎকার জায়গা! অন্ধকার-অন্ধকার চারদিক। পরিচ্ছন্ন টেবিল। সুন্দর একটি মিউজিক হচ্ছে।
‘চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে নীলু?‘
‘নাহ্।’
‘এরা ভালো সামুচা করে। সামুচা দিতে বলি? আমার খিদে পেয়েছে। কি, বলব?’
‘বলুন।’
ছেলেটি হাসল। নীলুর খুব ইচ্ছা করছিল, জিজ্ঞেস করে-হাসছ কেন তুমি? আমি কি হাস্যকর কিছু করেছি? কিন্তু নীলু কিছু বলল না। ছেলেটির হাসতে-হাসতে বলল, ‘আসলে আমি বিজ্ঞাপনটা মজা করবার জন্যে দিয়েছিলাম, কেউ জবাব দেবে ভাবি নি।’
‘আমি ছাড়া কেউ কি লিখেছিল?’
‘তা লিখেছে। মনে হচ্ছে এ দেশের মেয়েদের কাজকর্ম বিশেষ নেই।সুযোগ পেলেই ওরা চিঠি লেখে। এই কথা বললাম বলে তুমি আবার রাগ করলে না তো?’
‘নাহ্।’
‘গুড। আমি কিন্তু শুধু তোমার চিঠির জবাব দিয়েছি। অন্য কারোর চিঠির জবাব দিই নি। আমার কথা বিশ্বাস করছ তো?’
‘করছি।’
বেয়ারা চায়ের পট দিয়ে গেল। ছেলেটি বলল. ‘দাও’ আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।ঘরে বানাবে মেয়েরা, কিন্তু বাইরে পুরুষেরা-এ-ই নিয়ম।’
নীলু লক্ষ্য করল, ছেলেটি তার কাপে তিন চামচ চিনি দিয়েছে। নীলু একবার লিখেছে সে চায়ে তিন চামচ চিনি খায়। ছেলেটি সেটা মনে রেখেছ। কী আশ্চার্য।
‘চায়ে এত চিনি খাওয়া কিন্তু ভালো না।’
‘নীলু কিছু বলল না।
‘এর পর থেকে চিনি কম খাবে?’[
নীলু ঘাড় নাড়ল।
তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে রইল। নীলু একবার বলল, ‘সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, উঠি?’
ছেলেটি বলল, ‘আরেকটু বস, আমি বাসায় পৌঁছে দেব, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।’ নীলু আর কিছু বলল না।
‘একটু দেরি হলে তোমাকে আবার বাসায় বকবে না তো?’
‘নাহ্, বকবে না। আমি মাঝে-মাঝে অনেক রাত করে বাসায় ফিরি।’
‘সেটা ঠিক না নীলু। শহর বড় হচ্ছে, ক্রাইম বাড়ছে। ঠিক না?’
‘হ্যাঁ, ঠিক।’
‘ঐ দিন কী হলো জান-আমার পরিচিত এক মহিলার কোন থেকে টেনে দুল নিয়ে গেছে, রক্তারক্তি কাণ্ড!’
‘আমি গয়নাটয়না পরি না।’
‘না-পরাই উচিত। আচ্ছা নীলু, তুমি কি আজ তোমার বাবার সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দেবে?’
‘আপনি যদি চান, দেব।’
‘আমি নিশ্চয়ই চাই। তুমি কি চাও?’
‘চাই, বলতে গিয়ে নীলুর চোখ ভিজে উঠল। ছেলেটিকে এখন কত-না পরিচিত মনে হচ্ছে। সে যদি এখন হাত বাড়িয়ে নীলুর হাত স্পর্শ করে, তাহলে কেমন লাগবে নীলুর? ভালোই লাগবে। কিন্তু ছেলেটি অত্যন্ত ভদ্র। সে এমন কিছুই করবে না।
‘নীলু, আমি তোমার জন্যে একটা উপহার এনেছিলাম। কিন্তু তার আগে বল, তুমি কী এনেছ? তুমি বলেছিলে লাল টাই আনবে।ভুলে গেছ, না?’
‘না ভুলব কেন?
‘আমি তোমার জন্যেই লাল টাই পরে এসেছি। যদিও লাল রং আমার পছন্দ নয়। আমার পছন্দ হচ্ছে-নীল।’
‘নীল আমারও পছন্দ।’
‘তবে হালকা নীল, কড়া নীল নয়।’
নীলু এই প্রথম অল্প হাসল। হালকা নীল তার নিজেরও পছন্দ। ছেলেটি হাসতে-হাসতে বলল, ‘আমার সবচে’ অপছন্দ হচ্ছে সবুজ রং। কিন্তু দেখ,আজ সবুজ রংটাও খারাপ লাগছে না।’
তারা উঠে দাঁড়াল সাড়ে আটটায় দিকে। হেঁটে-হেঁটে এল নিউমার্কেটের গেটে। ছোট্ট একটা হোন্ডা সিভিক সেখানে পার্ক করা। ছেলেটি ঘড়ি দেখে বলল, ‘রাত কি বেশি হয়ে গেল নীলু?’
‘না, বেশি হয় নি।’
‘তোমার বাবা দুশ্চিন্তা না-করলে হয়। আমি চাই না আমার জন্যে কেউ বকা খাক। অবশ্যি এক-আধ দিন বকা খেলে কিছু যায়-আসে না, কি বল?’
নীলু হাসল। ছেলেটিও হাসল। মাজির্ত হাসি।
‘সরাসরি বাসায় যাব, নাকি যাবার আগে আইসক্রীম খাবে? ধানমণ্ডিতে একটা ভালো আইসক্রীমের দোকান দিয়েছে।’
‘আজ আর যাব না।’
‘ঠিক আছে, চল বাসায় পৌঁছে দিই।’
ছেলেটি নীলুকে তাদের গেটের কাছে নামিয়ে দিল। নীলুর খুব ইচ্ছে করছিল তাকে বসতে বলে, কিন্তু তার বড্ড লজ্জা করল। বিলু নানান প্রশ্ন শুরু করবে।
দেবী – ১৫
১৫
‘স্যার, ভেতরে আসব?’
‘এস। কী ব্যাপার?’
মিসির আলি মেয়েটিকে ঠিক চিনতে পারলেন না। তিনি কখনো তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের চিনতে পারেন না।
‘স্যার, আমার নাম নীলু, নীলুফার।’
‘ও, আচ্ছা।’
মিসির আলি পরিচিত ভঙ্গিতে হাসলেন কিন্তু নামটি তাঁর কাছে অপরিচিত লাগছে। এও এক সমস্যা। কারো নাম তিনি মনে রাখতে পারেন না। তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত হলো। নাম মনে না করতে পারার একটিই কারণ-মানুষের প্রতি তাঁর আগ্রহ নেই। আগ্রহ থাকলে নাম মনে থাকত।
‘স্যার, আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি সেকেন্ড ইয়ারের। এক দিন এসেছিলাম আমরা চার বন্ধু।’
‘ও হ্যাঁ। এসেছিলে তোমরা। মনে পড়েছে। আজ কী ব্যাপার?‘
‘মেয়েটি ইতস্তত করতে লাগল। তার মানে কী? কমবয়েসী মেয়েদের তিনি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেন। তরলমতি মেয়েরা মাঝে-মাঝে অনেক অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে বসে।
‘তোমরা কী ব্যাপার,বল।’
‘স্যার, আমি ঐ ইএসপির টেস্টটা আবার দিতে চাই।’
‘এক বার তো দিয়েছে। আবার কেন?’
মিসির আলি বিস্মিত হলেন। এই মেয়েটির মতিগতি তিনি বুঝতে পারছেন না।
‘স্যার, আমার মনে হয়, একবার পরীক্ষা করলে দেখা যাবে-আমার ইএসপি আছে।’
‘এ রকম হবার কারণ কী?’
মেয়েটি উত্তর না-দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। লক্ষণ ভালো নয়। মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এখন আমি একটু ব্যস্ত আছি। অন্য এক দিন এস।’
মেয়েটি তবুও কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল।
‘তুমি কি অন্য কিছু বলতে চাও?’
‘জ্বি-না স্যার। আমি যাই। স্লামালিকুম।’
মিসির আলি গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। এ মেয়েটিকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। এরা সহজেই একটা ঝামেলা বাধিয়ে দিতে পারে। এ রকম সুযোগ দেয়া ঠিক না।
বারটায় একটা ক্লাস ছিল। মিসির আলি গিয়ে দেখলেন কোনো ছাত্র-ছাত্রী নেই। কোনো স্ট্রাইক হচ্ছে কি? এরকম কিছু শোনেন নি। সামনে হয়তো টার্ম পরীক্ষা আছে। টার্ম পরীক্ষা থাকলে ছাত্ররা দল বেঁধে আসা বন্ধ করে দেয়। মিসির আলি ভ্রকুঁচকে খালি ক্লাসে পাঁচেক বসে রইলেন। গত রাতে অসুস্থ শরীরে এই ক্লাসটির জন্যে পড়াশোনা করেছেন। এ অবস্থা হবে জানলে সকাল-সকাল শুয়ে পড়তে পারতেন। ছাত্রশূণ্য একটি ক্লাসে তিনি খাতাপত্র নিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন-হাস্যকর দৃশ্য। অনেকেই করিডোর দিয়ে হাঁটবার সময় তাঁকে কৌতূহলী হয়ে দেখল। পাগলটাগল ভাবছে বোধহয়। মিসির আলি উঠে পড়লেন।
আজকের দিনটিই শুরু হয়েছে খারাপভাবে। একটি কাজও ঠিকমতো হচ্ছে না। মিসির আলি ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলেন। তাঁর কপালের মাঝখানে ব্যাথা শুরু হলো। এই উপসর্গটি নতুন। ব্লাড-প্রেশারট্রেশার হয়েছে বোধহয়। ডাক্তার দেখাতে হবে।
তিনি বাড়ি ফিরলেন তিনটার দিকে। এই অসময়েও বসার ঘরে কে যেন বসে আছে। সমস্ত দিনটিই যে খারাপ যাবে, এটা হচ্ছে তার প্রমাণ। গ্রামের বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা চাইতে কেউ এসেছে নির্ঘাত।
‘কে?’
‘জ্বি, আমি আনিস’
‘আনিস সাহেব, আপনি এই সময়ে! অফিস নেই?’
‘ছুটি নিয়ে এলাম।’
‘ ব্যাপার কী?’
‘রানুর শরীরটা বেশি খারাপ। ভাবলাম, আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।’
‘ভালোই করেছেন। বসেন, চা-টা দিয়েছে?’
‘জ্বি, চা খেয়েছি। আপনার ভাই ছিলেন এতক্ষণ।’
‘বসুন, আমি কাপড় ছেড়ে আসি।’
লোকটি জড়সড় হয়ে বসে আছে। মিসির আলি লক্ষ্য করলেন, তার চোখের নিচে কালি পড়েছে। তার মানে রাতে ঘুমাতে পারছে না। এ রকম হওয়ার কথা নয়। মিসির আলি চিন্তিত মূখে ভেতরে ঢুকলেন। তাঁর ফিরে আসতে অনেক সময় লাগল।
‘এখন বলেন, ব্যাপারটা কী?’
আনিস ইতস্তত করে বলল, ‘ভূতপ্রেত বলে কিছু আছে?’
‘এই কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
আনিস মুখ কালো করে বলল, ‘অনেক রকম কাণ্ডকারখানা হচ্ছে। আমি কনফিউজড হয়ে গেছি।’
‘অথাৎ এখন ভূতপ্রেত বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন?’
আনিস চুপ করে রইল।
‘এর কারণটা বলেন, শুনি।’
‘নানারকম শব্দ হয় ঘরে।’
‘তাই নাকি? আপনি নিজে শোনেন?’
‘জ্বি, শুনি। গন্ধও পাই, ফুলের গন্ধ।’
‘আপনি পান, না আপনার স্ত্রী পান?’
‘রানু প্রথম পায়, তারপর আমি পাই।’
মিসির আলি চুরুট ধরালেন। আনিস বললেন, ‘গত রাতে ঘরের মধ্যে কেউ যেন নূপুর পায়ে হাঁটছিল।’
‘এই নূপুরের শব্দ প্রথমে কে শোনে? আপনার স্ত্রী?’
‘জ্বি।’
‘তারপর আপনাকে বলার পর আপনি শুনতে পান।’
‘জ্বি।’
‘আনিস সাহেব, এটাকে বলা হয় ইনডিউসড অডিটরি হেলুসিনেশন। আপনার মন দুর্বল। আপনার স্ত্রী যখন বলেন শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, তখন আপনিও তা শুনতে থাকেন। ব্যাপারটি আপনার মনোজগতে। আসলে কোনো শব্দ হচ্ছে না।’
আনিস দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনি যদি একবার আসলে আমাদের বাসায়, আপনি নিজেও শুনবেন।’
‘না ভাই, আমি শুনব না। আমি খুব শক্ত ধরনের মানুষ। খুবই যুক্তিবাদী লোক আমি।’
‘আপনি আসেন-না এক বার।’
‘ঠিক আছে,যাব।’
‘আমাদের বাড়িঅলার খুব সুন্দর ফুলের বাগান আছে। প্রচুর গোলাপও আছে। বিকেলের দিকে গেলে সেটাও দেখতে পারবেন।’
মিসির আলি কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বড় ফুলের বাগান?’
‘জ্বি।’
‘আনিস সাহেব, এমন কি হতে পারে না, বাতাসে নিচের বাগান থেকে ফুলের সৌরভ ভেসে আসে? সেই সৌরভকে আপনি একটি আধ্যাত্মিক রূপ দেন। হতে পারে?’
‘পারে, কিন্তু শব্দটা?’
‘কোনো একটা ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। মস্তিক খুব অদ্ভুত জিনিস, আনিস সাহেব। সে আপনাকে এমন সব জিনিস দেখাতে বা শোনাতে পারে, যার আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনি কি উঠছেন?’
‘জ্বি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, যান। আমার নিজেরও মাথা ধরেছে। দুটো পেরাসিটামল খেয়েছি, লাভ হচ্ছে না।জ্বরও আসছে বলে মনে হয়। শরীরটা গেছে। বেশি দিন বাঁচব না।’
দেবী – ১৬
১৬
পত্রিকা খুলে নীলু অবাক হলো। সেই বিজ্ঞাপনটি আবার ছাপা হয়েছে। কথাগুলো এক। জিপিও বকা্র নাম্বারও ৭৩। শিরোনামটিও আগের মতো-কেউ কি আসবেন?’ এর মানে কী? নীলুর ধারণা ছিল, এই বিজ্ঞাপনটি আর কোনো দিন ছাপা হবে না। এর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে না। নীলুর ইচ্ছা হলো দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাঁদার। সে মুখ কালো করে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারান্দায় তার জন্যে একটা বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছিল। মিসির আলি সাহেব দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন, ‘এখানে কি আনিস সাহেব থাকেন?’
‘স্যার আপনি? আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
‘ও ইয়ে, তুমি। আমার ছাত্রী? কোন ইয়ার?’
‘থার্ডইয়ার স্যার। নিলু আমার নাম। নীলুফার।’
‘ও আচ্ছা। নীলুফার-তোমাদের তেতলায় আনিস সাহেব থাকেন নাকি?’
‘জ্বি।’
‘তাঁর কাছে এসেছি। উঠবার রাস্তা কোন দিকে?’
নীলু তাঁকে সঙ্গে করে তিনতলায় নিয়ে গেল।
‘ফেরবার পথে আমাদের বাসা হয়ে যাবেন স্যার। যেতেই হবে।’
‘আচ্ছা, দেখি।’
‘দেখাদেখি না স্যার, আপনি আসবেন।’
আনিস ঘরে ছিল না। রানু তাঁকে নিয়ে বসাল। সে খুবই অবাক হয়েছে। মিসির আলি বললেন, ‘খুব অবাক হয়েছেন মনে হচ্ছে?’
‘আপনি-আপনি করে বলেছেন কেন?’
‘ও আচ্ছা, তুমি-তুমি করে বলতাম, তাই না? ঠিক আছে।এখন বল, আমাকে দেখে অবাক হয়েছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘খুব অবাক হয়েছ?’
‘জ্বি। আপনি আসবেন ভাবতেই পারি নি।’
মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘তুমি তো শুনেছি সব কিছু আগে বলে দিতে পার, এটি তো পারার কথা ছিল।’
রানু থেমে-থেমে বলল, ‘আপনি লোকটি বেশ অদ্ভুত!’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। আপনার যুক্তিও খুব ভালো, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়।’
‘বিশ্বাস করলেই পার। আনিস সাহেব কখন আসবেন?’
‘এসে পড়বে।’
‘আমাকে একটু চা খাওয়াও। আর শোন, তোমাদের একটা কাজের ছেলে আছে নাকি? ওকে পাঠাও তো আমার কাছে।’
‘ওকে কী জন্যে?’
‘কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব।’