কেউ কি আসবেন?
আমি এক নিঃসঙ্গ মানুষ। স্ত্রীর মৃত্যুর পর একা জীবন-
যাপন করছি। সময় আর কাটে না। আমার দীর্ঘ দিবস ও দীর্ঘ
রজনীর নিঃসঙ্গতা কাটাতে কেউ আমাকে দুই লাইন লিখবেন?
জিপিও বক্স নাম্বার ৭৩
দৈনিক পত্রিকায় এ রকম বিজ্ঞাপন দেবার মানে কী? সাপ্তাহিক কাগজগুলিতে এই সব থাকে; ছেলেছোকরাদের কান্ড। এই লোকটি নিশ্চই ছেলেছোকরা নয়। বুড়ো-হাবড়াদের একজন।
‘বাবা, এইটা পড়েছ?’
নীলু জাহিদ সাহেবের হাতে কাগজটা গুঁজে দিল।
‘বাবা, এই বিজ্ঞাপনটা পড় তো!’
জাহিদ সাহেব নিজেও ভ্রু কুঞ্চিত করে দুই বার পড়লেন। তাঁর মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হল বেশ বিরক্ত হয়েছেন।
‘পড়েছ?’
‘হুঁ, পড়লাম।
‘কী মনে হয় বাবা?’
‘কী আবার মনে হবে? কিছুই মনে হয় না। দেশটা রসাতলে যাচ্ছে। খবরের কাগজঅলারা এইসব ছাপে কীভাবে?’
নীলু হাসিমুখে বলল, ‘ছাপাবে না কেন?’
‘দেশটা বিলাত-আমেরিকা নয়, বুঝলি? আর ভালো করে পড়লেই বোঝা যায়, লোকটার একটা বদ মতলব আছে।’
‘কই, আমি তো বদ মতলব কিছু বুঝছি না।’
জাহিদ সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘দেখিস, তুই আবার চিঠি লিখে বসবি না।’
নীলু মুখ নিচু করে হাসল।
‘হাসছিস কেন?’
‘এমনি হাসছি।’
‘চিঠি লিখবার কথা ভাবছিস না তো মনে-মনে?’
‘উঁহু।’
নীলু মুখে উঁহু বললেও মনে-মনে ঠিক করে ফেলল, গুছিয়ে একটা চিঠি লিখবে। দেখা যাক না কী হয়। কী লেখে লোকটি।
রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে সে সত্যি সত্যি একটা চিঠি লিখে ফেলল। মোটামুটি বেশ দীর্ঘ চিঠি।
জনাব,
আপনার বিজ্ঞাপনটি পড়লাম। লিখলাম কয়েক লাইন।
এতে কী আপনার নিঃসঙ্গতা কাটবে? আমার বয়স আঠার।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমরা দু’ বোন। আমার
ছোট বোনটির নাম বিলু। সে হলিক্রস কলেজে পড়ে। আমরা
দু’ বোনই খুব সুন্দরী। এই যা, এটা আপনাকে লেখা ঠিক হল না।
তাই না? নাকি সুন্দরী মেয়েদের চিঠি পেলে আপনার নিঃসঙ্গতা দ্রুত কাটবে?
নীলু
চিঠিটি লিখেই তার মনে হলো যে, এ রকম লেখাটা ঠিক হচ্ছে না। চিঠির মধ্যে একটা বড় মিথ্যা আছে। সে সুন্দরী নয়। বিলুর জন্য কথাটা ঠিক, তার জন্যে নয়। নীলু ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে দ্বিতীয় চিঠিটি লিখল।
জনাব,
আমার নাম নীলু। আমার বয়স কুড়ি। আপনার নিঃসঙ্গতা
কাটাবার জন্যে আপনাকে লিখছি। কিন্তু চিঠিতে কি কারো
নিঃসঙ্গতা কাটে? আপনার বয়স কত, এটা দয়া করে জানাবেন।
নীলু
দ্বিতীয় চিঠিটিও তার পছন্দ হলো না। তার মনে হলো, সে যেন কিছুতেই গুছিয়ে আসল জিনিসটি লিখতে পারছে না। রাতে শুয়ে-শুয়ে তার মনে হলো, হঠাৎ করে সে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কেন? চিঠি লেখারই-বা কী দরকার?
সে নিজেও কি খুব নিঃসঙ্গ? হয়তো-বা। এ বাড়িতে আর দুটি মাত্র প্রাণী। বিলু আর বাবা। বাবা দিন-রাত নিজের ঘরেই থাকেন। মাসের প্রথম দিকের কয়েকটা দিন বাড়িভাড়ার টাকা আদায়ের জন্যে অল্প যা নড়াচড় করেন। তারপর আবার নিজের ঘরেই বন্দি। আর বিলু তো আছে তার অসংখ্য বন্ধুবান্ধব নিয়ে। শুধু মেয়ে বন্ধু নয়, তার আবার অনেক ছেলেবন্ধুও আছে।
মহানন্দে আছে বিলু। তবে সে একটু বাড়াবাড়ি করছে। কাল তার কাছে একটি ছেলে এসেছিল, সে রাত আটটা পর্যন্ত ছিল। এ সব ভালো নয। নীলু উঁকি দিয়ে দেখেছে, ছেলেটি ফরফর করে সিগারেট টানছে। হাত নেড়ে-নেড়ে কথা বলছে। আর বীলু হাসতে-হাসতে ভেঙে পড়ছে। ভাত খাওয়ার সময় নীলু কিছু বলবে না বলবে না করেও বলল, ‘ছেলেটা কে রে?’
‘কোন ছেলে?’
‘ঐ যে রাত আটটা পর্যন্ত গল্প করলি?’
‘ও, সে তো রুবির ভাই! মহাচালবাজ। নিজেকে খুব বু্দ্িধমান ভাবে, আসলে মহা গাধা।’
বলতে বলতে খিলখিল করে হাসে বিলু।
‘মহা গাধা হলে এতক্ষণ বসিয়ে রাখলি কেন?’
‘যেতে চাচ্ছিল না তো কী করব?’
বলতে বলতে বীলু আবার হাসল। বীলু এমন মেয়ে, যার উপর কখনো রাগ করা যায় না। নীলু কখনো রাগ করতে পারে না। মাঝে-মাঝে বাবা দুই-একটা কড়া কথা বলেন। তখন বিলু রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দেয়। সে এক মহা যন্ত্রনা! একবার রাগ করে সে পুরো দুদিন দরজা বন্ধ করে বসেছিল। কত সাধাসাধি, কত অনুরোধ! শেষ পর্যন্ত মগবাজারের ছোট মামাকে আনতে হলো। ছোটমামা বিলুর খাতিরের মানুষ। তাঁর সব কথা সে শোনে। তিনি এসে যখন বললেন, ‘দরজা না খুললে মা আমি কিন্তু আর আসব না। এই আমার শেষ আসা-’ তখন দরজা খুলল। এ রকম জেদী মেয়ে।
নীলুর কোনো জেদ-টেদ নেই। কালো এবং অসুন্দরী মেয়েদের জে কখনো থাকে না। এদের জীবন কাটাতে হয় একাকী। নীলু বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করল। ছোটবেলায় বাতি নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম আসত, এখন আর আসে না । অনেক রাত পর্যন্ত এপাশ-ওপাশ করতে হয়। পাশের খাটে টেবিল-ল্যাম্প জ্বালিয়ে চোখের ওপর একটা গল্পের বই ধরে আছে বিলু। অনেক রাত পর্যন্ত সে পড়বে। পড়তে-পড়তে হঠাৎ এক সময় ঘুমিয়ে পড়বে, বাতি নেভাবে না। মশারি ফেলবে না। নীলুকেই উঠে এসে বাতি নেভাতে হবে, মশারি ফেলতে হবে।
‘বিলু ঘুমো, বাতি নেভা।’
‘একটু পরে ঘুমাব।’
‘কী পড়ছিস?’
‘শীর্ষেন্দুর একটা বই। দারুন!’
‘দিনে পড়িস। আলো চোখে লাগছে।’
‘দিনে আমার সময় কোথায়? তুমি ঘুমাও-না!’
নীলু ঘুমাতে পারল না। শুয়ে-শুয়ে তাকিয়ে রইল বিলুর দিকে। দিনে-দিনে কী যে সুন্দর হচ্ছে মেয়েটা! একই বাবা-মার দুই মেয়ে-একজন এত সুন্দর আর অন্যজন অসুন্দর কেন? নীলু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
‘আপা?’
‘কী?’
‘দারুন বই, তুমি পড়ে দেখ।’
‘প্রেমের?’
‘হ্যাঁ। প্রেমের হলেও খুব সিরিয়াস জিনিস। দারুণ!’
‘তাই নাকি?’
‘হুঁ, একজন খুব রুপবতী মেয়ের গল্প।’
‘তোর মতো একজন?’
‘দুর, আমি সুন্দর নাকি? আমাদের তিনতলার ভাড়াটের বৌটির মতো বলতে পার। রানু নাম, দেখেছ।’
‘না তো, খুব সুন্দরী?’
‘ওরে ব্বাপ, দারুণ! হেমা মালিনীর চেয়েও সুন্দরী।’
‘তুই মেয়েটিকে একবার আসতে বলিস তো আমাদের বাড়িতে! দেখব।’
‘বলব। তুমি নিজে একবার গেলেই পার। মেয়েটা ভালো। কথাবার্তায় খুব ভদ্র। ওর বরকে দেখেছ, আনিস সাহেব?’
‘হুঁ।
‘ঐ লোকটা বোকা ধরণের। বোকার মতো কথাবার্তা। আমাকে আপনি-আপনি করে বলে।
‘কলেজে পড়িস, তোকে আপনি বলবে না?’
‘ফ্রক-পরা কাউকে এ রকম এক জন বুড়ো মানুষ আপনি বলবে নাকি?’
‘বুড়ো নাকি?’
‘চল্লিশের ওপর বয়স হবে।’
‘মেয়েটার বয়স কত হবে?’
‘খুব কম। চৌদ-পনের বছর হবে।’
বিলু বাতি নিভিয়ে দিল এবং নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়ল। নীলু জেগে রইল অনেক রাত পর্যন্ত। কিছুতেই তার ঘুম এল না। ইদানীং তার ঘুম খুব কমে গেছে। রোজই মাঝরাত না হওয়া অবধি ঘুম আসে না।