আপনি কি রাগ করছেন?
দয়া করে রাগ করবেন না। আমি জানি আপনি অন্যদের মতো না। আপনি আপনার সীমারেখা জানেন। প্রকৃতি মানুষের চারদিকে একটা গণ্ডি এঁকে দিয়ে বলে দেয়-এর বাইরে তুমি যেতে পারবে না। তোমার অতি উন্নত জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়েও তোমাকে থাকতে হবে এই গণ্ডির ভেতর। এই সত্য আপনার জানা আছে। আপনি গণ্ডির ভেতর থেকেও গণ্ডি অতিক্রম করতে চেষ্টা করেন। এইখানেই আপনার বাহাদুরি। বড় বড় কথা বলছি? হয়তো বলছি। তবে এগুলি আমার নিজের কথা না। অন্য একজনের কথা। সেই অন্য একজন প্রচুর জ্ঞানের কথা বলেন এবং খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেন। তিনি যে জ্ঞানের কথা বলছেন তা তখন মনে হয় না। একটু চিন্তা করলেই মনে হয় ওরে বাবারে-এ তো অসম্ভব জ্ঞানের কথা। এই প্রসঙ্গে আমি পরে বলব। তবে আপনি হচ্ছেন মিসির আলি, কে জানে ইতিমধ্যে হয়তো অনেক কিছু বুঝে ফেলেছেন।
আপনি কীভাবে চিন্তাভাবনা করে একটা সমস্যা সমাধানের দিকে এগোন তা আমার জানতে ইচ্ছা করে। চিন্তাশক্তি আমার নিজের খুবই কম। সহজ রহস্যই ধরতে পারি না। আমাদের স্কুলে একবার একজন ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাতে এসেছিলেন। বেচারি খুবই আনাড়ি ধরনের। যে ম্যাজিকই দেখান সবাই ধরে ফেলে। একমাত্র আমিই ধরতে পারি না। তিনি যা দেখান তাতেই আমি মুগ্ধ হই। আপনার সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিও হয়তো ম্যাজিকের মতো। সেই ম্যাজিক দেখে মুগ্ধ হতে ইচ্ছা করে। আচ্ছা এই এতগুলি পাতা যে পড়লেন এর মধ্যে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ইনফরমেশন দিয়ে দিয়েছি। বলুন তো ইনফরমেশনটা কী? যদি বলতে পারেন তা হলে বুঝব আপনার সত্যি বুদ্ধি আছে। বলতে না পারলে তেত্রিশ পৃষ্ঠায় দেখুন।
মিসির আলি পড়া বন্ধ করলেন। তেত্রিশ পৃষ্ঠা না দেখে মেয়েটির সম্পর্কে বিশেষ কী বলা হয়েছে বের করার চেষ্টা করলেন। যা বলা হয়েছে তার বাইরে কি কিছু আছে? হ্যাঁ আছে, মেয়েটা তার আসল নাম বলেছে। তার আসল নাম ফারজানা। ফানিম্যান ছড়াটির প্রতি লাইনের প্রথম অক্ষর নিলে ফারজানা নামটা পাওয়া যায়। এমন জটিল কোনো ধাধা না। এ ছাড়া আর কিছু কি আছে? আরেকবার পড়তে হবে। তবে যা পড়েছেন তাতে মেয়েটিকে খুঁজে বের করে ফেলার মতো তথ্য আছে। ফারজানা মেয়েটি বোধ হয় তা জানে না। যেমন মেয়েটির বাবার নামে একটি হত্যা মামলা হয়েছিল। সেই মামলা ডিসমিস হয়ে যায়। আদালতের নথিপত্র ঘাটলেই বের হয়ে পড়বে। ডেড বিডির পোস্টমর্টেম হয়েছিল। হাসপাতাল থেকেও সেই সম্পর্কিত কাগজপত্র পাওয়া যাবে। একটু সময়সাপেক্ষ, তবে সহজ।
সেই সময়কার পুরোনো কাগজ ঘাটলেও অনেক খবর পাওয়া যাওয়ার কথা। পাষণ্ড খামীর হাতে স্ত্রী খুন জাতীয় খবর পাঠক-পাঠিকারা খুব মজা করে পাঠ করেন। পত্রিকাওয়ালারা গুরুত্বের সঙ্গে সেইসব খবর ছাপেন। প্রথম পাতাতেই ছবিসহ খবর আসার কথা। তারপরের কয়েকদিন খবরের ফলে আপ।
অবিশ্যি বাংলাদেশে পুরোনো কাগজ ঘাটা খুব সহজ ব্যাপার নয়। যে কবার তিনি পুরোনো কাগজ ঘাটতে গেছেন সে কবারই তার মাথা খারাপ হবার যোগাড় হয়েছে। বিদেশের মতো ব্যবস্থা থাকলে ভালো হত। সবকিছু কম্পিউটারে ঢুকানো, বোতাম টিপে বের করে নেয়া।
মিসির আলি তার খাতা বের করলেন। কেইস নাম্বার দিয়ে ফারজানার নামে একটা ফাইল খোলা যেতে পারে। খাতার পাতায় ফারজানা নাম লিখতে গিয়ে মিসির আলি ইতস্তত করতে লাগলেন। ফাইল খোলার দরকার আছে কি? এখনো বোঝা যাচ্ছে না, ফারজানার লেখা সব কটা পাতা না পড়লে বোঝা যাবেও না। মিসির আলি পেনসিলে গোটা গোটা করে লিখলেন,
নাম। ফারজান।
বয়স : ২৩
রোগ : স্কিজোফ্ৰেনিয়া???
স্কিজোফ্ৰেনিয়া লিখে তিনবার প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিলেন। ফারজানার লেখা যে কটি পাতা এখন পর্যন্ত পড়েছেন তা তিনি আরো তিনবার পড়বেন। তারপর ঠিক করবেন। প্ৰশ্নবোধক চিহ্নগুলি রাখবেন, কি রাখবেন না। সে যা লিখেছে তা সত্যি কি না তাও দেখার ব্যাপার আছে। সত্যি কথা না লিখলে তথ্যে ভুল থাকবে। প্রথম পাঠে তা ধরা পড়বে না। যত বেশি বার পড়া হবে ততই ধরা পড়তে থাকবে। তার নিজের নামটা সে যেমন কায়দা করে ঢুকিয়ে দিয়েছে তার থেকে মনে হয় আরো অনেক নাম লেখার ভেতর লুকিয়ে আছে। সেগুলিও খুঁজে বের করতে হবে। তার মায়ের নাম কি চাপা? প্রিয় রঙ বলছে চাপা। আবার প্রিয় দুটি জিনিস চাঁদ এবং পানির প্রথম অক্ষর নিলেও চাপা হচ্ছে। এটা কাকতালীয়ও হতে পারে। যদি কাকতালীয় না হয় তা হলে মেয়েটি তার সঙ্গে রহস্য করছে কেন? এই রহস্য করার জন্য তাকে প্রচুর সময় দিতে হয়েছে। চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে। এটা সে কেন করছে? ব্যাপারটা ছেলেমানুষি তো বটেই। ফাইভ সিক্সে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা এইসব করতে পারে। ২৩ বছরের একটা মেয়ে তুচ্ছ ধাঁধা তৈরি করার জন্য সময় নষ্ট করবে: কেন? ব্যাপার কী এমন যে মেয়েটার কিছু করার নেই। দিনের পর দিন যারা বিছানায় শুয়ে থাকে তারা ক্রসওয়ার্ড পাজল, বা ব্রেইন টিজলার জাতীয় খেলায় আনন্দ পেতে পারে। এমনকি হতে পারে যে মেয়েটিকে দিনের পর দিন শুয়ে থাকতে হচ্ছে। চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে হাতে পাতার পর পাতা লেখা কষ্টকর। সে লিখেছে ১০০ পৃষ্ঠা, লিখতে তার সময় লেগেছে ২ বছর। একটা পৃষ্ঠা লিখতে তার গড়পড়তা সময় লেগেছে সাতদিনের কিছু বেশি। লেখাগুলি লেখা হয়েছে কালির কলমে। চিৎ হয়ে শুয়ে কালির কলমে লেখা যায় না। তাকে লিখতে হয়েছে উপুড় হয়ে। উপুড় হয়ে যে লিখতে পারে সে বিছানায় পড়ে থাকার মতো অসুস্থ না। কাজেই সে শয্যাশায়ী একজন রোগী এই হাইপোথিসিস বাতিল।