আপনি বুঝতেই পারছেন আমার শৈশবটা সুখের ছিল না। একটা বিরাট বাড়িতে আমি প্রায় একা একাই মানুষ হই। আমাদের বাড়িটা ছিল টু ইউনিট। একতলায় রান্নাঘর, খাবার ঘর, বসার ঘর, স্টাডি আর দোতলায় শুধুই শোবার ঘর আর ফ্যামিলি লাউঞ্জ। কাজের লোকদের দোতলায় ওঠা নিষেধ ছিল। তারা সবাই বাবাকে ভয় পেত বলে দোতলায় উঠত না। আমি স্কুল থেকে ফিরে একা একাই দোতলায় খেলতাম। আমার মতো বাচ্চারা মনে মনে একজন খেলার সাখী তৈরি করে নেয়, তার সঙ্গেই খেলে। আমিও তাই করলাম। একজন খেলার সাখী বানিয়ে নিলাম। সেই খেলার সাখী হল আমার মা। আমার ছোট মা। আমার আসল মাকে তো আমি দেখি নি, কাজেই তার সম্পর্কে আমার কোনো মমতা বা ভালবাসা কিছুই ছিল না। ছোট মা আমাকে খুবই আদর করতেন। সেই আদরের একটা ছোট্ট নমুনা দিলেই আপনি বুঝবেন। যেমন মনে করুন। তিনি আমাকে ডাকছেন-চিত্রা খেতে এস। চিত্রা কলার আগে তিনি একগাদা আদরের নাম অতি দ্রুত বলে যাবেন। তারপর বলবেন খেতে এস। তাঁর আদরের নামগুলি হল
ভিটভিটি খিটখিটি,
মিটমিটি ফিটফিটি
ভুতুন খুনখুন
সুনসুন ঝুনঝুন।
এ্যাং বেঙ ঝেং, টেঙা টেঙ।
আদরের নাম ছাড়াও তাঁর নিজের কিছু কিছু বিচিত্র ছাড়াও ছিল। ননসেন্স রাইমের মতো কোনো অর্থ নেই, কোনো মানে নেই। সেই সব ছড়া তিনি গানের সুরে বলতেন। সব সুর এক রকম। যেমন ধরুন–
ফানিম্যান হাসে তার
রং ঢং হাসি।
জানা কথা যে জানে না
না শুনে সে বাঁশি।
এইসব বিচিত্র ছড়া বলে তিনি খিলখিল করে হাসতেন। আমার খুবই মজা লাগত। মনে হত আহ। কী আনন্দময় আমার জীবন।
অতি আদরের একজন মানুষ আমার খেলার সাথী হবে এটাই স্বাভাবিক। আমি নিজের মনে পুতুল খেলতাম, রান্নাবাটি খেলতাম এবং ক্রমাগত ছোট মায়ের সাথে কথা বলতাম, প্রশ্ন করতাম, ছোট মা উত্তর দিতেন। উত্তর তো আসলে দিতেন না। আমি উত্তরটা কল্পনা করে নিতাম। তখন আমার বয়স সাত। সাত বছরের বাচ্চারা এই ধরনের খেলা খেলে। এটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু একদিন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটল। সেদিন স্কুল ছুটি ছিল। বাবা গেছেন ঢাকার বাইরে। আমি সারা দিন একা একা খেলেছি।
সন্ধ্যাবেলা আমার শরীর খারাপ করল? গা কেঁপে জ্বর এল। আমি চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে আছি। কিছু ভালো লাগছে না। খাট থেকে একটু দূরে আমার পড়ার টেবিল। টেবিলে বাবার এনে দেয়া মোটা একটা ইংরেজি ছবির বই। শুয়ে শুয়ে ছবি দেখতে ইচ্ছা করল। বিছানা থেকে নেমে যে ছবির বইটা আনব সেই ইচ্ছা করছে না। আমি অভ্যাসমতো বললাম, ছোট মা বইটা এনে দাও। কল্পনার খেলার সাখী মাকে এই জাতীয় অনুরোধ আমি প্রায়ই করি। সেই অনুরোধ আমি নিজেই পালন করি। তারপর বলি, থ্যাংক ইউ ছোট মা। ছোট মারি হয়ে আমি প্রায়ই বলি, ইউ আর ওয়েলকাম।
সেদিন সন্ধ্যায় অন্য ব্যাপার হল। অবাক হয়ে দেখলাম ছোট মা টেবিলের দিকে যাচ্ছেন। বইটা হাতে নিয়ে বিছানার দিকে ফিরছেন। বইটা আমার দিকে ধরে আছেন। আমি এতই অবাক হয়েছি যে হাত বাড়িয়ে বইটা নিতে পর্যন্ত ভুলে গেছি। ছোট মা আমার বিছানার পাশে বইটা রেখে নিঃশব্দে বের হয়ে গেলেন। খোলা দরজাটা হাত দিয়ে ভিড়িয়ে দিয়ে গেলেন। ভয়ে আমার চিৎকার করে ওঠা উচিত ছিল। আমি চিৎকার করলাম না। ভয়ের চেয়ে বিস্ময়বোধই আমার প্রবল ছিল। চোখে ভুল দেখেছি। এই জাতীয় চিন্তা আমার একবারও মনে আসে নি। বরং মনে হয়েছে আমি যা দেখছি ঠিকই দেখছি। ছোট মা আমাকে দেখতে এসেছেন। আমার শরীর ভালো না তো এই জন্যে আমাকে দেখতে এসেছেন।
নিঃসঙ্গ শিশুরা তার চারপাশের জগৎ সম্পর্কে অনেক ব্যাখ্যা নিজেরা দাড় করায়। আমিও একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেললাম। এই ব্যাখ্যায় অসুস্থ শিশুঁকে দেখতে মৃত মানুষ ফিরে আসতে পারেন।
যদিও আমি নিজেই একটা ব্যাখ্যা দাড় করালাম তারপরেও আমার মনে হল এই ব্যাখ্যায় কিছু ফাকি আছে। ফাঁকির ব্যাপারটা আমি নিজে জানতে চাচ্ছিলাম না। কাজেই মাকে দেখতে পাওয়ার কথাটা কাউকে বললাম না। আমার মনে হল পুরো ব্যাপারটায় এক ধরনের গোপনীয়তা আছে। কেউ জেনে ফেললে মা রাগ করবেন, তিনি আর আসবেন না।
সেই রাতে আমার জ্বর খুব বাড়ল। মাথায় পানি দেয়া হল। তাতে কাজ হল না। বাথটাবে বরফ মেশানো ঠাণ্ডা পানিতে আমাকে ড়ুবিয়ে রাখা হল। ডাক্তার ডাকা হল। চিটাগাং-এ আমার বাবাকে জরুরি খবর পাঠানো হল। আমার খুব ভালো লাগতে লাগল এই ভেবে যে, যেহেতু আমার শরীর খুব খারাপ করেছে আমার ছোট মা নিশ্চয়ই আবারো আমাকে দেখতে আসবেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ছোট মা অবিশ্যি এলেন না।
আমার এই ঘটনা শুনে আপনি কী ভাবছেন তা আমি জানি। আপনি ভাবছেন হেলুসিনেশন। একটি নিঃসঙ্গ শিশু তার নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্যে নিজের মধ্যে একটি জগৎ সৃষ্টি করেছে। হেলুসিনেশনের জন্ম সেই জগতে। আপনারা সাইকিয়াট্রিস্টরা খুব সহজেই সবকিছু ব্যাখ্যা করে ফেলেন। আপনাদের কাছে রহস্য বলে কিছু নেই। আইনষ্টাইন যখন বলেন সৃষ্টি রহস্যময়, সব রহস্যের জট এই মুহুর্তে খোলা সম্ভব না। তখন আপনারা বলেন, ব্যাখ্যাতীত বলে কিছু নেই। সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায়। আমার এক জীবনে আমাকে অনেক সাইকো এনালিসিসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। আমি এই সব ব্যাপার খুব ভালো জানি। আপনাদের মতো মনোবিদ্যা বিশারদদের দেখলে আমার সত্যিকার অর্থেই হাসি পায়। আপনারা একেকজন কী গভীর ভঙ্গিতে কথা বলেন, যেন পৃথিবীর সবকিছু জেনে বসে আছেন। অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর হয়। আপনাদের বিদ্যা শুধু যে অল্প তাই না, শূন্য বিদ্যা।