আমি আপনাকে চিনি না। আপনার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয় নি। আপনার সম্পর্কে যা জানি বই পড়ে জানি! বইয়ে লেখকরা সবকিছু ঠিকঠাক লিখতে পারেন না। মূল চরিত্রগুলিকে তারা মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেন। আমি ধরেই নিয়েছি আপনার বেলাতেও তাই হয়েছে। বইয়ের মিসির আলি এবং ব্যক্তি মিসির আলি এক নন। কে জানে আপনি হয়তো বইয়ের মিসির আলির চেয়েও ভালো মানুষ।
আমি আপনার সম্পর্কে মনে মনে একটা ছবি দাড় করিয়েছি-আচ্ছা দেখুন তো সেই ছবিটার সঙ্গে কতটুকু মেলে। তারও আগে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নেই। আমার ধারণা। আপনি এখন তুরু কুঁচকে ভাবছেন, চিঠির মেয়ে এবং চিত্রা কি এক? ব্যাপারটা আমি ধীরে ধীরে পরিষ্কার করুব। আপাতত আপনি এটা নিয়ে চিন্তা করবেন। না। আপনাকে লেখা চিঠিটা মন দিয়ে পড়ুন। এই চিঠি আমি দু বছর ধরে রাত জেগে লিখেছি। অসংখ্য বার কাটাকুটি করেছি। বানান ঠিক করেছি। যেন চিঠি পড়ে। আপনি কখনো বিরক্ত হয়ে না। ভাবেন-মেয়েটা এই সহজ বানানও জানে না। আশ্চর্য তো!
ভালো কথা আপনার সম্পর্কে আমার ধারণা কী এখন বলি, দেখুন তো মেলে কি না। আমার ধারণা। আপনি হাসিখুশি ধরনের মানুষ। বইয়ে আপনার যে গভীর প্রকৃতির কথা লেখা হয় সেটা ঠিক না। আপনার চেহারার যে বর্ণনা বইয়ে থাকে সেটাও ঠিক না। আপনার বিশেষত্বহীন চেহারার কথা লেখা হলেও আমি জানি আপনার চেহারা মোটেও বিশেষত্বহীন নয়। আপনার চোখ ধারালো ও তীব্র সার্চ লাইটের মতো। তবে সেই ধারালো চোখেও একটা শান্তি শান্তি ভাব আছে। আমার খুব ইচ্ছা কোনো একদিন আপনাকে এসে দেখে যাব। শান্ত ভঙ্গিতে আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকব। একসময় আপনাকে বলব, আমাকে একটা হাসির গল্প বলুন তো। আমার কেন জানি মনে হয়। কেউ আপনার কাছে গল্প শুনতে আসে না। সবাই আসে ভয়ঙ্কর সব সমস্যা নিয়ে। দিনের পর দিন এইসব সমস্যা শুনতে কি আপনার ভালো লাগে? মাঝে মাঝে আপনার কি ইচ্ছা করে না সহজ স্বাভাবিক গল্প শুনতে এবং বলতে? যেমন আপনি একটা ভূতের গল্প শুনে ভয় পাবেন। ভুরু কুঁচকে ভাববেন-না, ভূত বলে কিছু নেই।
আমাদের চারপাশের জগৎটা সহজ স্বাভাবিক জগৎ, এই জগতে মাঝে মাঝে বিচিত্র এবং ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে! আমার নিজের জীবনেই ঘটে গেল। এবং আমি আপনাকে সেই গল্পই শুনাতে বসেছি। না শুনালেও চলত। কারণ আমি আপনার কাছ থেকে কোনো সাহায্য চাচ্ছি না। বা আপনাকে বলছি না। আপনি আমার সমস্যার সমাধান করে দিন। তারপরেও সব মানুষেরই বোধহয় ইচ্ছা করে নিজের কথা কাউকে না কাউকে শুনাতে। আমার চারপাশে তেমন কেউ নেই।
এখন আমি আপনার একটা অস্বস্তি দূর করি। চিত্রা নামের যে মেয়েটি আপনার কাছে এসেছিল আমি সেই মেয়ে। কাজেই আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। চিত্রার সেদিন আপনাকে কেমন লেগেছিল তা আর আপনাকে কোনোদিন জানানো হবে না। কারণ চিত্রার সঙ্গে আপনার আর কোনোদিন দেখা হবে না। আপনাকে খানিকটা ধাধায় ফেলে চিত্রা বিদেয় নিয়েছে! আমিও বিদায় নেব। আমার দীর্ঘ চিঠি শেষ করার পর আপনি ভাববেন-আচ্ছা মেয়েটার কি মাথা খারাপ? সে এইসব কী লিখেছে? কেনই বা লিখেছে? দীর্ঘ লেখা পড়তে আপনার যেন ক্লান্তি না লাগে সে জন্যে আমি খুব চেষ্টা করেছি। চেষ্টা কতটুকু সফল হল কে জানে। চ্যাপ্টার দিয়ে দিয়ে লিখলাম। চ্যাপ্টারের প্ৰথম কয়েক লাইন পড়ে। আপনি ঠিক করবেন। আপনি পড়বেন কি পড়বেন না। সব চ্যাপ্টার যে পড়তেই হবে তা না।
পরিচয়
নাম : চিত্রা (নকল নাম)
বয়স : ২৩ বছর। (যখন লেখা শুরু করেছিলাম। তখন বয়স ছিল ২০ বছর তিন মাস)।
উচ্চতা : পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি।
আমার প্রিয় রঙ : চাঁপা!
আমার দেখতে ভালো লাগে। চাঁদ এবং পানি।
পড়াশোনা : এস. এস. সি. পাস করার পর আর পড়াশোনা করতে পারি নি। তবে আমি খুব পড়ুয়া মেয়ে। শত শত বই পড়ে ফেলেছি। শুধু গল্পের বই না। সব ধরনের বই। বাড়িতে আমি যেন পড়তে পারি। সে জন্যে আমার একজন শিক্ষক আছেন। দর্শনবিদ্যার শিক্ষক। তবে দৰ্শন আমার প্রিয় বিষয় নয়।
আমি কেমন মেয়ে? ভালো মেয়ে। খুব ভালো মেয়ে। আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে হাসছেন। ভাবছেন এই মেয়েটা এমন ছেলেমানুষ করছে কেন? আমি তো আসলে ছেলে মানুষই। ২৩ বছর তো এমন কোনো বয়স না। তাই না? তবে আমি কিন্তু আসলেই ভালো
দূর ছাই লেখার এই ধরনটা আমার ভালো লাগছে না। আমি বরং ধারাবাহিকভাবে শুরু করি। পড়তে পড়তে আমার সম্পর্কে আপনার ধীরে ধীরে একটা ধারণা তৈরি হবে। তখন আর আমাকে বলতে হবে না যে আমি ভালো মেয়ে। আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।
খুব অল্প বয়সে রোড অ্যাকসিডেন্টে আমার মা মারা যান। বান্দরবান থেকে একটা ঞ্জিপে করে আমরা আসছিলাম। আমার বাবা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। বাবার পাশে মা বসেছিলেন। মার কোলে আমি। হঠাৎ গাড়ির সামনে একটা ছাগল পড়ল। বাবা সেই ছাগল বাঁচাতে গিয়ে গাড়ি নিয়ে খাদে পড়ে গেলেন। মা তৎক্ষণাৎ মারা গেলেন। আমার এবং বাবার কিছু হল না। বান্দরবানের রাস্তাগুলি খুব নির্জন থাকে। অ্যাকসিডেন্টের অনেক পরে লোকজন এসে আমাদের উদ্ধার করল। আমার তখন বয়স মাত্র দেড় বছর। আমার কিছু মনে নেই।
আমার বাবা পরে আবার বিয়ে করেন। সেই বিয়ে সুখের হয় নি। ছোট মার মেজাজ খুব খারাপ ছিল। তিনি অল্পতেই রেগে যেতেন। তাঁর আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল। বাবার সঙ্গে রাগারগি হলেই বলতেন, সুইসাইড করব। শেষ পর্যন্ত মা সুইসাইড করেন। এই নিয়ে খুব ঝামেলা হয়। মা পক্ষের লোকজন মামলা করেন। তারা বলার চেষ্টা করেন মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। যাই হোক মামলায় প্রমাণিত হয়, মা মানসিক রোগী ছিলেন। ছোট মা দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। গায়ের রঙ অবিশ্যি শ্যামলা ছিল। কিন্তু তার চেহারা এতই মিষ্টি ছিল—শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করত।