খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার মেয়েটি চলে যাবার পর মিসির আলির একটু মন খারাপ হয়ে গেল। পাখি উড়ে যাবার পর পাখির পালক পড়ে থাকে। মেয়েটা চলে গেছে তার পরেও কিছু যেন রেখে গেছে। সুটকেস এবং হ্যান্ডব্যাগ নয়, অন্য কিছু।
মেয়েটির রেখে যাওয়া ৫০০ টাকার নোটটা পকেটে। টাকাটা ফেরত দিতে ভুলে গেছেন। আশ্চৰ্য কাণ্ড-মেয়েটি তার কালো ব্যাগও ফেলে গেছে। তার সব টাকা তো ওই ব্যাগে। বেবিট্যাক্সি নিয়ে যদি কোথাও যায় ভাড়া দিতে পারবে না।
মিসির আলি অস্বস্তি বোধ করছেন। মেয়েটাকে মাথা থেকে তাড়াতে পারছেন না। মাছিটা এখনো টেবিলে বসে আছে। মারা গেছে নাকি? না মারা যায় নি। কীট এবং পতঙ্গ জগতের নিয়ম হল মৃত্যুর পর উল্টো হয়ে থাকা। পিিঠ থাকবে মাটিতে পা থাকবে শূন্যে। মাছির বেলাতেও নিশ্চয়ই সেই নিয়ম। মিসির আলি তার লাইব্রেরির দিকে এগুলেন-মাছি সম্পর্কে জানার জন্যে কোনো বই কি আছে লাইব্রেরিতে? থাকার তো কথা।
মাছি সম্পর্কে মিসির আলি তেমন কোনো তথ্য যোগাড় করতে পারলেন না। শুধু জানলেন পৃথিবীতে মোট ৮৫,০০০ প্রজাতির মাছি আছে। মৌমাছি যেমন মাছি, ড্রাগন ফ্লাইও মাছি। সবচে ছোট মাছি প্রায় অদৃশ্য আর সবচে বড় মাছি চড়ুই পাখি সাইজের। এদের সবারই দু জোড়া পাখা থাকে। এক জোড়া তারা ওড়ার কাজে ব্যবহার করে, অন্য জোড়া ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যবহার করে। বেশিরভাগ প্রজাতির মাছিই মানুষের পরম বন্ধু–শুধু হাউস ফ্লাই নয়। এদের প্রধান কাজ অসুখ ছড়ানো।
চিত্রা দু ঘণ্টার ভেতর ফিরে আসবে
চিত্রা দু ঘণ্টার ভেতর ফিরে আসবে। এ ব্যাপারে মিসির আলি নিশ্চিত ছিলেন। নিশ্চিত ব্যাপারগুলি মানুষের জীবনে প্রায় কখনো ঘটে না। চিত্রা দু ঘণ্টা কেন দশ দিনের মাথাতেও ফিরে এল না। তার হ্যান্ডব্যাগ এবং সুটকেসে ধূলা জমতে লাগল। সে একটা টেলিফোন নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল। টেলিফোন নাম্বার লেখা চিরকুট তিনি ড্রয়ারে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। অযত্নে অবহেলায় রাখা কাগজপত্র সব সময় পাওয়া যায়। যত্নে রাখা কাগজ কখনো পাওয়া যায় না। মারফির এই সূত্র ভুল প্রমাণিত হল। মিসির আলি ড্রয়ার খুলেই চিরকুটটি পেলেন এবং সেই চিরকুট দেখে তিনি ছোটখাটো একটা চমক খেলেন। চিরকুটে টেলিফোন নাম্বার লেখা নেই। শুধু সুন্দর অক্ষরে লেখা Help me!
মিসির আলির একটু মন খারাপ হল। মেয়েটির সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনলেই হত। তিনি এতটা অধৈৰ্য হলেন কেন? বাড়িঘর ছেড়ে নিতান্ত অকারণে এই বয়সের একটা মেয়ে চলে আসে না। এই বয়সের মেয়েদের মাথায় নানান উদ্ভট ব্যাপার খেলা করে তারপরেও বাড়িঘর ছাড়ার ব্যাপারে তারা খুব সাবধানী হয়। আশ্রয় মেয়েদের কাছে অনেক বড় ব্যাপার। প্রকৃতি মেয়েদের সেই ভাবেই তৈরি করেছে। ভবিষ্যতে এরা সন্তানের জন্ম দেবে। সেই জন্যে তাদের নিরাপদ আশ্ৰয় দরকার। কাজেই হে মাতৃজাতি তোমরা আশ্রয় কখনো ছাড়বে না। এই হল ডি এন এর অনুশাসন। ডি এন এ অনুশাসনের বাইরে যাবার ক্ষমতা তাদের নেই।
মেয়েটি তার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো পথ রাখে নি। পথ রাখলে তিনি বলতেনহ্যাঁ আমি এখন তোমার কথা শুনব। সত্যি-মিথ্যা সব কথাই শুনব। আগের বারে তোমার কথা শুনতে চাই নি। তোমার হাত থেকে রক্ষা পাবার ব্যাপারটাই আমার মাথায় প্রবলভাবে ছিল। তার জন্যে আমি দুঃখিত।
মেয়েটি তার হ্যান্ডব্যাগ বা সুটকেসে কোনো ঠিকানা কি রেখে গেছে?
সুটকেস খুললে কোনো গল্পের বই কি পাওয়া যাবে যেখানে তার নাম এবং বাড়ির ঠিকানা লেখা? বই পেলেও লাভ হবে না। এখনকার মেয়েরা বই-এ নিজের নাম লিখলেও বাড়ির ঠিকানা লেখে না। বাড়ির ঠিকানা লেখাটাকে গ্ৰাম্যতা বলে ধরা হয়। ডায়েরি পেলে সবচে ভালো হত। ডায়েরিতে নাম ঠিকানা থাকে। তবে ডায়েরি পাবার সম্ভাবনা অতি সামান্য। আজকালকার মেয়েদের ডায়েরি লেখার মতো সময় নেই। নিজেদের কথা তারা শুধু গোপন করতে চায়। লিখতে চায় না।
মিসির আলি মেয়েটির সুটকেস খুললেন। কয়েকটা শাড়ি, পলিথিনে মোড়া দু জোড়া স্যাণ্ডেল, হেয়ার ড্রায়ার, ট্রাভেলার্স, আয়রন, কিছু কসমেটিকস, এক বোতল পানি, সুন্দর একটা চায়ের কাপ। একটা ফুলতোলা বেডশিট।
বই এবং ডায়েরি পাওয়া গেল না। তবে বেডশিটের নিচে একগাদা কাগজ পাওয়া গেল। দামি ওনিয়ন স্কিন পেপার। কাগজে চিকন নিকের কালির কলমে গুটিগুটি করে। ঠাসবুনন লেখা। যত্ন করে কেউ অনেক দিন ধরে লিখেছে। মনে হচ্ছে দীর্ঘ কোনো চিঠি। কাকে লেখা? মিসির আলি ভুরু কুঁচকে সম্বোধন পড়লেন–
শ্ৰদ্ধাস্পদেষু
জনাব মিসির আলি সাহেব।
চিঠিতে তারিখ নেই। যে লিখছে তার নামও নেই। এর হাতের লেখা এবং চিত্রার হাতের লেখা কি এক? ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্ট ছাড়া বলা যাবে না। চিত্রা ইংরেজিতে লিখেছে হেল্প মি, আর এই দীর্ঘ চিঠি লেখা বাংলায়। ইংরেজি এবং বাংলা হাতের লেখায় মিল-অমিল চট করে চোখে পড়ে না। তার পরেও মিসির আলির মনে হল দীর্ঘ এই চিঠির লেখিকা এবং চিত্ৰ এক মেয়ে নয়।
মেয়েটি বাইরে যাবার প্রভৃতি নিয়ে তার ব্যাগ গোছায় নি। মেয়েরা ব্যাগ গুছানোর সময় অবশ্যই প্রথম নেবে। আন্ডার গার্মেন্টস, পেটিকেট, ব্লাউজ, ব্ৰা, প্যান্টি। এইসব কাপড়ের ব্যাপারে তারা অতিরিক্ত সেনসেটিভ। ব্যাগে আগে এইসব গুছানো হবে তারপর অন্য কিছু। কিন্তু মেয়েটির সুটকেস বা হ্যান্ডব্যাগে এইসব কিছু নেই। টীওয়েলও নেই। মেয়েটি ঘর ছাড়ার জন্যে ব্যাগ গোছায় নি। তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্য কি তাকে দীর্ঘ চিঠিটা নাটকীয় ভঙ্গিতে দেয়া?
শ্রদ্ধাষ্পদেষু
শ্ৰদ্ধাষ্পদেষু
জনাব আপনাকে কেমন ভড়কে দিলাম। সরাসরি চিঠিটা আপনার কাছে দিলে আপনি এত আগ্রহ নিয়ে পড়তেন না। কাজেই সামান্য নাটক করতে হল। আশা করি আমার এই ছেলেমানুষ নাটকে আপনি বিরক্ত হন নি।