ব্যাপারটা প্রেমঘটিত। আমি একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাই। দরিদ্র ফালতু টাইপ ছেলে। কিছুই করে না। তার প্রেমে পড়ার কারণ নেই। তারপরেও আমি পড়ে গেছি এবং এবং …
এবং কী?
গোপনে বিয়ে করার জন্যে তার সঙ্গে পালিয়েও গিয়েছিলাম। আমাকে ধরে আনা হয়। আমি তো খুব জেদি মেয়ে, কাজেই আমি সবাইকে বলি–আমি আবারো পালিয়ে যাব। তোমাদের কোনো সাধ্য নেই আমাকে ধরে রাখার।
ছেলেটার নাম কী?
ছেলেটার নাম দিয়ে আপনার দরকার কী?
কোনো দরকার নেই। কৌতুহল বলতে পার।
উনার নাম ফরহাদ।
শুধুই ফরহাদ?
ফরহাদ খান।
তারপর?
তারপর আবার কী?
তোমার কাছ থেকে এই কথা শোনার পর তারা তোমাকে তালাবন্ধ করে রাখল?
তই তো রাখবে। যে মেয়ে এ জাতীয় কথা বলে তাকে নিশ্চয়ই কেউ কোলে করে ঘুরে বেড়াবে না। ঘুমপাড়ানি গান গাইয়ে ঘুম পাড়াবে না।
আজ তুমি ছাড়া পেয়েছ, আমার কাছে না এসে ওই ছেলেটির কাছে চলে যাচ্ছ না। কেন?
যাব তো বটেই। আপনার কি ধারণা আমি চিরকালের জন্যে আপনার সঙ্গে থাকব?
মিসির আলি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, চিত্ৰা তুমি আবারো মিথ্যা কথা বলছ।
বুঝলেন কী করে?
ছেলেটার নাম কী বল জিজ্ঞেস করার পর–থতামত খেয়ে গেলে। চট করে বলতে পারলে না। একটা কোনো নাম ভাবার জন্যে সময় নিলে। তারপর বললে উনার নাম ফরহাদ। উনি বললে-যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছ তার প্রসঙ্গে উনি বলবে কেন? বলবে ওর নাম ফরহাদ ।
তা হলে কি সত্যি কথা শুনতে চান?
আমি এখন সত্যি-মিথ্যা কোনো কথাই শুনতে চাই না। তুমি আমার সাহায্য চাচ্ছ। যদি সত্যি চাও আমি তোমাকে সাহায্য করি, তা হলে তোমাকে সত্যি কথা বলতে হবে। তা তুমি পারবে না। মিথ্যা বলাটা তোমার রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। কিছুক্ষণ সত্যি বলার পর আবার মিথ্যা শুরু করবে।
তাতে অসুবিধা কী? যেই মুহুর্তে আমি মিথ্যা বলব। আপনি ধরে ফেলবেন। আপনার তো সেই ক্ষমতা আছে।
মিসির আলি আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন–চিত্রা শোন আমার পক্ষে তোমাকে এ বাড়িতে রাখা সম্ভব না। তোমাকে চলে যেতে হবে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যেতে হবে।
আমার সমস্যা আপনি সমাধান করবেন না?
মানুষের বেশিরভাগ সমস্যাই এরকম যে তা তারা নিজেরাই সমাধান করতে পারে। আমার ধারণা তোমার সমস্যার সমাধান তুমিই করতে পারবে।
আমি আপনার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছি বলে কি আপনি রাগ করেছেন?
রাগ করার প্রশ্ন আসছে না। মিথ্যা কথা বলাটাকে সবাই যতবড় অন্যায় মনে করে আমি তা করি না। আমার কাছে মনে হয় মানুষের অনেক অদ্ভূত ক্ষমতার একটি হচ্ছে মিথ্যা বলার ক্ষমতা। কল্পনাশক্তি আছে বলেই সে মিথ্যা বলতে পারে। যে মানুষ মিথ্যা বলতে পারে না সে সৃষ্টিশীল মানুষ না–রোবট টাইপ মানুষ।
আপনি কি মিথ্যা বলেন?
না বলি না। মানুষ হিসেবে আমি রোবট টাইপের। শোনচিত্রা, তুমি এখন চলে যাও।
চিত্রা বিশিত গলায় বলল, চলে যাব?
হ্যাঁ চলে যাবে।
আপনি আমাকে খুব অপছন্দ করেছেন তাই না?
আমি তোমাকে অপছন্দও করি নি। আবার পছন্দও করি নি।
আমার বিষয়ে আপনার কোনো কৌতূহলও হচ্ছে না?
লোকজনের ধারণা আমার কৌতুহল খুব বেশি, আসলে তা না। আমার কৌতুহল কম। অনেক কম।
নীল রঙের মাছটার দিকে আপনি যতটা কৌতুহল নিয়ে তাকিয়েছেন আমার দিকে তাও তাকান নি। আমি কি মাছির চেয়েও তুচ্ছ?
মিসির আলি চুপ করে রইলেন।
চিত্রা ক্লান্ত গলায় বলল, আচ্ছা। আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু আপনি দয়া করে গম্ভীর হয়ে থাকবেন না। যাবার আগে হাসিমুখে থাকুন। আপনার হাসিমুখ দেখে যাই।
মিসির আলি হাসলেন। চিত্রা বলল, বাহ আপনার হাসি তো সুন্দর। যারা গভীর ধরনের মানুষ তাদের হাসি খুব সুন্দর হয়। এরা হঠাৎ হঠাৎ হাসে তো এই জন্যে। আর যারা সব সময় হাসিমুখে থাকে তাদের হাসি হয় খুব বিরক্তিকর। তাদের কান্না হয় সুন্দর। আচ্ছা আমি তা হলে এখন উঠি।
চিত্ৰ উঠে দাঁড়াল। মেয়েটা এত সহজে চলে যেতে রাজি হবে তা মিসির আলি তাবেন নি। তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
আচ্ছা শুনুন, আমি আমার ব্যাগগুলি রেখে যাই। ব্যাগ হাতে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আশ্ৰয় খোঁজার তো কোনো মানে হয় না, তাই না?
বিছানা বালিশ নিয়ে যাওয়াই তো ভালো, সবাই ভাববে এই মেয়ের আসলেই আশ্ৰয় প্রয়োজন।
আপনি কিন্তু সেরকম ভাবেন নি। আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। যাই হোক আমি জিনিসপত্র রেখে যাচ্ছি। একসময় এসে নিয়ে যাব।
আচ্ছা।
আপনি আসলেই রোবট টাইপ মানুষ। যাই কেমন?
তুমি কি তোমার বাড়ির টেলিফোন নাম্বারটি দিয়ে যাবে?
কেন? আচ্ছা দিচ্ছি। কাগজে লিখে দিচ্ছি। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে টেলিফোন করবেন না। আর যদি করেন। আপনি ভয়াবহ বিপদে পড়ে যাবেন। এইবার কিন্তু আমি সত্যি কথা বলছি–কি বলছি না?
মনে হচ্ছে বলছ।
চিত্রা তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে কাগজ নিয়ে টেলিফোন নাম্বার লিখল। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, এই নিন নাম্বার। আবারো বলছি নিতান্ত প্রয়োজন না হলে টেলিফোন করবেন না।
নিতান্ত প্রয়োজন বলতে তুমি কী বুঝাচ্ছ?
ধরুন আমি আপনার ঘর থেকে বের হলাম। আর হঠাৎ একটা ট্রাক এসে আমার গায়ের উপর দিয়ে চলে গেল তখন আপনি বাসায় টেলিফোন করে বলবেন–চিত্রা মারা গেছে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
চিত্রা বেশ সহজ ভঙ্গিতেই বের হল। মিসির আলি উঠে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তিনি আজ আর ঘর থেকে বের হবেন না। তিনি জানেন ঘণ্টা দু-একের ভেতর চিত্রা ফিরে আসবে, তার জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। মেয়েরা তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র কোথাও রেখে স্বস্তি পায় না। কাজেই অপেক্ষা করাই ভালো।