এই লাইটারটা আপনি রেখে দিন। লাইটারটা আমি আপনার জন্যে এনেছি।
থ্যাংক য়্যু।
আর এক প্যাকেট সিগারেটও এনেছি। আপনার একটা বইয়ে পড়েছিলাম। একজন কে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসত। যেদিনই আসত আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসত।
মিসির আলি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, একটু আগে বলেছিলে তুমি আমার একটা বইই পড়েছি।
মিথ্যা কথা বলেছিলাম। অনেকগুলি বই পড়েছি। সুধাকান্ত বাবুর উপর লেখা বইটা সবচে ভালো লেগেছে। বইটা আমি পড়েছি তিনবার। না তিনবার না। আড়াইবার পড়েছি। দুবার পড়েছি পুরোটা। শেষ বার পড়েছি শুধু শেষের কুড়ি পাতা।
ভালো।
মিথ্যা কথা বললে কি আপনি রেগে যান?
না।
আমাকে কেউ মিথ্যা কথা বললে আমি অবিশ্যি খুব রেগে যাই। আর আমার এমনই কপাল যে সবাই শুধু আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলে। তবে আপনি বলবেন না সেটা আমি জানি। আপনার চেহারা দেখেই বোঝা যায় আপনি মিথ্যা কথা বলতে পারেন না! আপনি কি জানেন যারা সব সময় মিথ্যা কথা বলে তাদের চেহারায় একটা মাইডিয়ার ভাব থাকে।
তাই নাকি?
জি।
যেসব মেয়েকে দেখবেন খুব মায়া মায়া চেহারা, আপনি ধরেই নিতে পারেন তারা প্রচুর মিথ্যা কথা বলে।
এই তথ্য জানতাম না।
আপনি মিসির আলি আর আপনি এই সাধারণ তথ্য জানেন না? অথচ বইয়ে কত আশ্চৰ্য আশ্চৰ্য কথা যে আপনার সম্পর্কে লেখা হয়। যেমন কাউকে এক পলক দেখেই আপনি তার সম্পর্কে হড়বড় অনেক কথা বলে দিতে পারেন। আসলেই কি পারেন?
না। পারি না।
আচ্ছা চেষ্টা করে দেখুন না। আমার সম্পর্কে বলুন।
কী বলব?
আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে। এইসব। দেখি আপনার পাওয়ার অব অবজারভেশন।
দেখ সায়রা বানু, আমি পরীক্ষা দেই না।
পরীক্ষা ভাবছেন কেন? ভাবেন একটা খেলা। বলুন আমার সম্পর্কে বলুন।
মিসির আলি হাতের সিগারেট ফেলে দিলেন। আরেকটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা! করছে। তিনি নিজের ওপর একটু বিরক্ত হচ্ছেন কারণ তাঁর টেনশন হচ্ছে। টেনশন হলেই একটা সিগারেট শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা সিগারেট ধরতে ইচ্ছা করে। তাঁর শরীর ভালো না! এখন কিছুদিন টেনশন ফ্রি জীবন যাপন করতে চান। অজানা-অচেনা একটা মেয়ে হুট করে উপস্থিত হয়ে তাতে বাধা দিচ্ছে।
মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে বলল, কী হল কিছু বলছেন না কেন?
মিসির আলি খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললেন, তোমার সম্পর্কে আমার প্রথম অবজারভেশন হচ্ছে তোমার নাম সায়রা বানু নয়।
এরকম মনে হবার কারণ কী?
মনে হবার কারণ হচ্ছে–সায়রা বানু যদি তোমার নাম হত তা হলে সায়রা বানু। ডাকলে তুমি সহজ ভাবে রেসপন্স করতে। একটু আগে আমি বললাম, দেখ সায়রা বানু। পরীক্ষা আমি দেই না। বাক্যটা আমি একবারে বলি নি। দেখ সায়রা বানু, বলে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করেছি। যখন দেখলাম তুমি হঠাৎ চমকে উঠলে তখনই আমি বাক্যটা শেষ করলাম। তোমার চমকে ওঠার কারণ হচ্ছে সায়রা বানু বলে যে তোমাকে সম্বোধন করা হচ্ছে তা তুমি শুরুতে বুঝতে পার নি। যখন বুঝতে পেরেছ তখনই চমকে উঠেছ। তোমার নাম কী?
আমার নাম চিত্ৰা।
আটকে রাখা হয়েছিল। সেই ঘরের জানাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল। আলোহীন একটা ঘরে দীর্ঘদিন থাকলে গায়ের চামড়া ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তোমার তাই হয়েছে। তুমি আলোর দিকে ঠিকমতো তাকাতেও পারছি না। যতবার তাকাচ্ছ ততবার চোখের মণি ছোট হয়ে আসছে। ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে। আবার জানালা থেকে তুমি চোখ ফিরিয়েও নিতে পারছি না। বারবার বিস্মিত চোখে জানোলা দিয়ে তাকাচ্ছ। কারণ অনেকদিন পরে তুমি জানালায় খোলা আকাশ দেখছি।
আরো কিছু বলবেন?
দীর্ঘদিন ধরে তুমি ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছ। যে কোনো কারণেই হোক তোমাকে মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে। স্টোরি তৈরি করতে হচ্ছে। মিথ্যা বলাটা তোমার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি কি ঠিক বলেছি?
হ্যাঁ।
তোমার হাত বাঁধা ছিল। মণিবন্ধে কালো দাগ পড়ে গেছে।
হুঁ।
তোমার ঘ্রাণশক্তি অতি প্রবল। তুমি কিছুক্ষণ পরপরই নাক কুঁচকাচ্ছ। এবং তাকাচ্ছ ঘরের দক্ষিণ দিকে। দক্ষিণ দিক থেকে নর্দমার দুৰ্গন্ধ আসছে। সেটা এত প্রবল না যে এমনভাবে নাক কুঁচকাতে হবে। এর থেকে মনে হয়-হয় তোমার ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত প্রবল আর নয়তো তোমাকে অনেক উঁচু কোনো ঘরে আটকে রাখা হয়েছে, ছ তলা-সাত তলায় যেখানে রাস্তার নর্দমার গন্ধ পৌঁছে না।
চিত্ৰ চুপ করে রইল। সে খুব একটা বিস্মিত হল বলে মনে হল না। মিসির আলি বললেন, এখন বল, তোমার ব্যাপারটা কী?
আপনি তো কিছু না জেনেই অনেক কিছু বলতে পারেন। আপনি নিজেই বলুন।
না। আমি বলতে পারছি না।
অনুমান করুন। দেখি আপনার অনুমানশক্তি আমার ঘ্রাণশক্তির মতো কি না।
আমার ধারণা তুমি অসুস্থ। অসুস্থতাটা এমন যে রোগীকে ঘরে আটকে রাখতে হয়। তুমি কোনোক্ৰমে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে এসেছি।
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে আমি পাগল তাই আমাকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল? না আমি পাগল না। সুস্থ। ছিটেফোঁটা পাগলামি যা অন্যদের মধ্যে থাকে আমার তাও নেই। তবে আমাকে ঘিরে আটকে রাখা হচ্ছিল তা ঠিক। ছবিশ দিন হল ঘরে তালাবন্ধ। আমাকে সবাই মিলে ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছে। কারণটাও খুব সাধারণ এবং আপনার মতো বুড়োর কাছে হয়তো বা হাস্যকর। কারণটা বলব?
মিসির আলি হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। মেয়েটির স্বভাব যা তাতে তিনি যদি বলেন- হ্যাঁ বল–তা হলে সে নিশ্চিতভাবেই বলবে–না বলব না। তারচে চুপ করে থাকাই ভালো।