ক) তুমি তোমার লেখায় কোথাও তোমার খালা, মামা, চাচা, ফুফুদের কথা আন নি। তাদের সম্পর্কে কিছু লেখা নেই।
খ) তোমাদের কোনো কাজের লোকের দোতলায় ওঠার অনুমতি পর্যন্ত নেই। অথচ শরিফা নামের কাজের মেয়েকে তোমার ঘরে ঘুমাতে দেয়া হচ্ছে। কেন?
গ) শরিফার স্বামী পাগল হয়ে গেছে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে পাবনা শহরে–এই খবর তুমি জানলে কী করে? তোমার জানার কথা না।
আমি অগ্রসর হয়েছি। এই তিনটি খটকা নিয়ে। তুমি যে কাপড় বুনেছ। তার সবই ভালো শুধু তিনটা সুতা ছিঁড়ে গেছে। কেন ছিঁড়ল। ছেঁড়া সুতাগুলিকে জোড়া লাগানো যায় কীভাবে? এই তিনটি সুতার ভেতর কি কোনো সম্পর্ক আছে? তখন আমার কাছে মনে হল তোমার যদি কোনো বোরকা থাকে—সউদি বোরকা, তা হলে খটকাগুলির মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি হয়। তিনটি সুতার ভেতর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়।
তোমার কি মনে আছে তোমার বোরকাওয়ালী এক বান্ধবীর গল্প করতে গিয়ে তুমি নানান ধরনের বোরকার কথা বলেছ। মনে আছে?
নিশি বলল, মনে আছে।
বোরকা সম্পর্কে তুমি জান। তুমি হয়তো ব্যবহারও কর। এই তথ্যটা বেশ জরুরি। মিসির আলি আরেকটি সিগারেট ধরালেন। নিশির মুখ হাসি হাসি। মনে হচ্ছে সে খুব মজা পাচ্ছে। মিসির আলি বললেন–নিশি আমি এক কাজ করি। আগে তোমার সমস্যাটা বলি তারপর বরং ব্যাখ্যা করি সমস্যার কীভাবে পৌঁছেছি।
আপনার যেভাবে ভালো লাগে সেইভাবেই বলুন। তবে বোরকা পরে আমি ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াই তা কিন্তু না। শখ করে কিনেছিলাম-একদিনই পরেছি। আচ্ছা আপনি কী বলতে চাচ্ছেন বলুন।
মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, তুমি হচ্ছে তোমার বাবা-মার পালিত কন্যা। যে কারণে তোমার নিজের জগৎ ছাড়া বাইরের কারো সঙ্গে তোমার যোগাযোগ নেই। খালা, মামা, চাচা, ফুফুরা তোমার ভুবনে অনুপস্থিত। তোমার লেখায় তারা কেউ নেই।
তোমার অসম্ভব বুদ্ধি। তুমি খুব সহজেই ব্যাপারটা আঁচ করে ফেল। তোমার নিজের জগৎ লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।
তোমার নীতু আন্টি সেই লণ্ডভণ্ড জগৎ ঠিক করতে চান। তিনি হঠাৎ মনে করেন যে, তোমার একজন সাৰ্ব্বক্ষণিক সঙ্গী থাকলে ভালো হয়। তিনি সঙ্গী নিয়ে এলেন। শরিফাকে নিয়ে এলেন। সেই শরিফাকে থাকতে দেয়া হল তোমার সঙ্গে। কেন? তোমার নীতু আন্টি ভেবেছিলেন তুমি কারণটা ধরতে পারবে না। তুমি চট করে ধরে ফেলেছ। ভালো কথা, শরিফা মেয়েটিও খুব রূপবতী।
তুমি ধরে ফেললে শরিফা তোমার বোন। হতদরিদ্র এই পরিবার থেকেই একসময় তোমাকে আনা হয়েছিল। শরিফা অবিশ্যি কিছু জানল না। মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। তুমি তাকে যেতে দিলে না। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে। প্রবল অপরাধবোধ তোমাকে গ্ৰাস করল। তুমি সেই অপরাধবোধের কারণেই বোরকা পরে একদিন দেখতে গেলে বোনের স্বামীকে। কিছু একটা তুমি তার সঙ্গে করেছ–সেটা কী আমি জানি না। মনে হয় ভয়ঙ্কর কিছু। বোনের কাছ থেকে শোনা শারীরিক গল্পগুলি তোমাকে প্রভাবিত করতে পারে। তুমি নাটকীয়তা পছন্দ কর। আমার ধারণা তুমি তার সঙ্গে বড় ধরনের কিছু নাটকীয়তাও করেছ। এই মুহুর্তে আমার যা মনে হচ্ছে তা হল তুমি তোমার বোনের শাড়ি পরে–বোন সেজেই তার কাছে গিয়েছ। এমন কাজ তুমি কর। শরিফা সেজে তুমি হাসিব নামের একজনকে ভয় দেখিয়েছ। যদিও আমার ধারণা ভয় দেখানো তোমার উদ্দেশ্য ছিল না। তুমি গভীর রাতে তার কাছে উপস্থিত হতে চেয়েছিলে। তাই না?
জানি না।
ভয় পাবার পর হাসিব কী করল?
তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।
তুমি কি তার জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত সেই ঘরে ছিলে?
না। আমি চলে এসেছিলাম।
জ্ঞান ফেরার পর কী হল?
জানি না। কী হল। আমি ঘর থেকে নামি নি। দোতলা থেকে শুনেছি খুব হইচই হচ্ছে। সকালবেলা হাসিব বাসা ছেড়ে চলে যান।
কাউকে কিছু বলে যায় নি?
বাবাকে বলে গেছেন। আমাকে কিছু বলে যান নি।
তার থেকে কি আমরা ধারণা করতে পারি যে সে বুঝতে পেরেছিল শরিফা নয় গভীর রাতে তুমি তার ঘরে উপস্থিত হয়েছিলে?
নিশি চুপ করে রইল।
তুমি কি পরে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছ?
করেছি। পাই নি। যে কম্পিউটারের দোকানে তিনি কাজ করতেন। সেখানেও তিনি আর ফিরে যান নি।
তুমি যদি চাও আমি তাকে খুঁজে বের করার একটা চেষ্টা করতে পারি। হারানো মানুষ খুঁজে বের করার ব্যাপারে আমার নাম আছে। তুমি কি চাও?
না। আমি চাই না। খাটের নিচে যে আমি শরিফাকে দেখতাম সেই সম্পর্কে বলুন। আপনার ধারণাটা কী শুনি।
তুমি যে খাটের নিচে অনেক কিছু দেখতে পাও এইসব সত্যিও হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে। তোমার মাথার একটা অংশ এখন কাজ করছে না। সেই অংশ নানান ছবি তৈরি করে তোমাকে দেখাচ্ছে। তবে দেখালেও তুমি জান–এইসব মায়া। তুমি অসাধারণ বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে। তুমি বুঝতে পারবে না তা না।
আমার ছোট মা এবং বাবা এরাও কিন্তু শরিফাকে দেখেছেন?
শোন নিশি আমি তো ওদের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। আমি মাথা ঘামাচ্ছি। তোমার সমস্যা নিয়ে। তুমি কী দেখছ না দেখছ সেটা নিয়েই বিচার-বিবেচনা হবে। আমার এখন খিদে লেগেছে, আমাকে খেতে দাও।
নিশি নড়ল না, বসেই রইল।
মিসির আলি বললেন, তোমার জীবনটা কাটছে একটা তন্দ্রার মধ্যে। তুমি যা ভাবছ যা করছ তা আর কিছু না–তন্দ্ৰবিলাস। তন্দ্ৰাবিলাস নামটা খুব সুন্দর মনে হলেও তন্দ্ৰবিলাসের জগৎটা মোটেই সুন্দর না। ভয়াবহ ধরনের অসুন্দর। এই জগতের সবচে বড় সমস্যা হচ্ছে এ জগতের বাসিন্দারা মনে করে তাদের জগৎটাই সত্যি। যা আসলে সত্যি না। আমি মনেপ্ৰাণে কামনা করি–তন্দ্ৰাবিলাসের জগৎ থেকে তুমি একদিন বের হয়ে আসবে।