আসুন ভেতরে আসুন।
দরজা ধরে নিশি দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির পরনে কালো সিঙ্কের শাড়ি। সে খুব সেজেছে। কপালে টিপ। চোখে কাজল। গয়নাও পরেছে। গলায় সরু চেইনের লকেট। লকেটের মাথায় লাল একটা পাথর। সেই পাথর আধো অন্ধকারেও কেমন ঝলমল করছে। কী পাথর এটা? জিরকণ? একমাত্র জিরকণই এমন কড়া লাল হয়–এমন দ্যুতিময় হয়।
নিশি তোমার জন্যে কিছু গোলাপ এনেছি।
থ্যাংক য়্যু।
সাবধানে ধর। কাঁটা সরানো হয় নি।
নিশি ফুল হাতে নিয়ে হাসল। মিসির আলি মনে মনে বললেন-বাহ কী সুন্দর মেয়ে। সৃস্টিকর্তা রূপের কলস মেয়েটির গায়ে ঢেলে দিয়েছেন।
বাবা বাড়িতে নেই। মাত্র বিশ মিনিট আগে চলে গেছেন। জরুরি কল পেয়ে তাকে যেতে হয়েছে। পাইলটদের এই সমস্যা–মজা করে ছুটি কাটাচ্ছে হঠাৎ ইমার্জেন্সি কল। আপনি কি ড্রয়িং রুমে বসবেন না স্টাডিতে বসবেন?
এক জায়গায় বসলেই হল।
আসুন স্টাডিতে বসি। আমাদের ড্রয়িং রুমটা এমন যে কেউ বসে স্বস্তি পায় না। আমি কিন্তু আপনার জন্যে রান্না করেছি। ভাত, ডাল, চচ্চড়ি আর ডিম ভাজা।
থ্যাংক য়্যু।
ডিম ভাজা এখনো হয় নি। ডিম ফেটে রেখেছি।–খেতে বসবেন আর আমি ভেজে দেব
আচ্ছা
আপনার যখন খিদে হবে বলবেন ভাত দিয়ে দেব।
তোমাদের বাড়িতে কি আর লোকজন নেই?
এই মুহূর্তে শুধু আমি আর দারোয়ান ভাই আছি। আমাদের একজন কাজের মেয়ে আছে—কিসমতের মা। তার জলবসন্ত হয়েছে তাকে ছুটি দিয়েছি। সে দেশের বাড়িতে চলে গেছে। সে কবে আসবে কে জানে। মনে হয় আসবে না। আমাদের বাড়িতে যারা কাজ করে তারা ছুটিতে গেলে আর ফিরে আসে না।
নিশি মিসির আলিকে স্টাডিতে নিয়ে বসাল। মাঝারি আকৃতির ঘর। হালকা সবুজ কার্পেটে মেঝে মোড়া। দুটা চেয়ার মুখোমুখি বসানো। একটা চেয়ারের পাশে অ্যাশট্রে।
আপনি যেভাবে বসেন, সেইভাবে আরাম করে বসুন। পা তুলে বসুন। আজ আপনি আসুন আমি তা চাচ্ছিলাম না। কেন বলুন তো?
বলতে পারছি না।
আমি আপনাকে খুব ভালো করে খাওয়াতে চাচ্ছিলাম। কাজের মেয়েটি নেই ভালো কিছু খাওয়াতে পারব না। তবে আমি আপনাকে বাইরের খাবার খাওয়াতে চাচ্ছিলাম না। যা পেরেছি। রেঁধেছি।
আমার জন্যে খাবার তেমন জরুরি না। অনেকে খাবার জন্যে বেঁচে থাকেন। আমি বাঁচার জন্যে খাই।
কফি খাবেন?
হ্যাঁ খাব।
বসুন কফি বানিয়ে আনি। কফি খেতে খেতে গল্প করি। আপনার কি গরম লাগছে?
না গরম লাগবে কেন?
বন্ধ ঘর তো। হালকা করে ফ্যান ছেড়ে দি?
দাও।
আপনি পা উঠিয়ে আরাম করে বসুন।
মিসির আলি পা উঠিয়ে বসলেন। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। একটু শীত শীত লাগছে। তাই ভালো। শীতের রাতে শীত না লাগলে ভালো লাগে না।
কফি নিন।
মিসির আলি কফি নিলেন। গন্ধ থেকেই বলে দেয়া যায়-কফি খুব ভালো হয়েছে।
ব্রাজিলের কফি বিনের কফি। আমার বাবার খুব প্রিয়।
কফি ভালো হয়েছে।
আমাকে কেমন দেখাচ্ছে তা তো বললেন না।
তোমাকে অপূর্ব লাগছে!
আপনি আসবেন এই জন্যেই সন্ধ্যা থেকে সাজ করছি। আপনি যখন বেল টিপলেন তখন আমার টিপ দেয়া শেষ হয় নি। এই জন্যেই দরজা খুলতে দেরি হল। কালো রঙ কি আপনার পছন্দ?
হ্যাঁ পছন্দ। খুব পছন্দ।
আমাকে দেখে কি আপনার শীত শীত লাগছে না?
কেন বল তো?
শীতকালে সিল্কর শাড়ি পরা কাউকে দেখলে শীত শীত লাগে। যে শাড়ি পরে আছে তার শীতটা যে দেখছে তার গায়ে চলে আসে।
তোমার পর্যবেক্ষণ শক্তি ভালো।
আপনার চেয়েও কি ভালো?
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন—আমি যে সবকিছু খুব খুঁটিয়ে দেখি তা কিন্তু না। এই কাজটা লেখকরা করেন। সবকিছু দেখেন ক্যামেরার চোখে। যা দেখছেন তারই ছবি তুলে ফেলছেন।
আপনি কীভাবে দেখেন?
আমি আর দশটা মানুষ যেভাবে দেখে সেভাবেই দেখি। দেখতে দেখতে কোনো একটা জায়গায় খটকা লাগে। তখন খটকার অংশটা ভালো করে দেখি। বারবার দেখি।
বুঝিয়ে বলুন।
মনে কর এক টুকরা কাপড় আমাকে দেয়া হল। আমি কাপড়টা দেখব। তার ডিজাইন দেখব, রঙ দেখব, বুনন দেখব। অন্যরা যেভাবে দেখবে সেইভাবেই দেখব। দেখতে গিয়ে হঠাৎ যদি চোখে পড়ে একটা সুতা ছেড়া তখন সকল নজর পড়বে ওই ছেঁড়া সুতায়। তখন দেখব সুতাটা কোথায় ছিঁড়েছে, কেন ছিঁড়েছে।
আমি যে আপনার কাছে আমার পাণ্ডুলিপি দিলাম। সেখানেও কি আপনি ছেড়া সুতা পেয়েছেন?
হ্যাঁ।
বলুন শুনি।
নিশি একটু ঝুঁকে এল। তার মুখ ভরতি হাসি। মনে হচ্ছে সে খুব মজা পাচ্ছে। মিসির আলি বললেন—তার আগে তুমি বল তোমার কি কোনো বোরকা আছে? সউদি বোরকা যেখানে শুধু চোখ বের হয়ে থাকে।
নিশি শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ আছে।
মিসির আলি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন–তা হলে বলা যেতে পারে তোমার সমস্যার সমাধান আমি করেছি।
বলুন আপনার সমাধান।
সমাধান বলা ঠিক হবে না। আমি সমস্যা ধরতে পেরেছি। সমাধান তোমার হাতে।
আপনি সমস্যাটা কীভাবে ধরলেন বলুন। গোড়া থেকে বলুন। আপনার সমস্যার মূলে পৌঁছার প্রক্রিয়াটা জানার আমার খুব আগ্ৰহ। ধরে নিন আমি আপনার একজন ছাত্রী। আপনি আমাকে বুঝাচ্ছেন। আমি আপনার কাছে শিখছি–
মিসির আলি কয়েক মুহুর্ত চুপ করে রইলেন-তারপর সহজ স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন। তার বলার ভঙ্গিটি আন্তরিক। মনে হচ্ছে তিনি তাঁর ছাত্রীকেই বুঝাচ্ছেন–
নিশি আমি যা করলাম তা হচ্ছে তোমার লেখা পড়ে গেলাম। খটকার অংশগুলি বের করলাম। যেসব জায়গায় আমার খটকা লাগল। সেগুলি হচ্ছে–