না ঠিক না। তবে তোমার ক্ষেত্রে আমি ভুল করি নি।
একটা জিনিস শুধু জানতে চাচ্ছি-আমি যে খাটের নিচে শরিফাকে দেখতে পাই এবং এখনো দেখতে পাই তা কি আপনি বিশ্বাস করেন?
করি।
আপনি কি শরিফাকে দেখতে চান?
না চাই না। অস্বাভাবিক কিছু আমার দেখতে ভালো লাগে না। আমি স্বাভাবিক মানুষ। আমি আমার চারপাশে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড দেখতেই আগ্রহী।
পৃথিবীতে সব সময়ই কি স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ঘটে?
না ঘটে না।
আচ্ছা। আপনি আসুন।
কখন আসব।
আজই আসুন। রাতে আমার সঙ্গে খাবেন। আমি নিজে আপনার জন্যে রান্না করব।
তুমি রাঁধতে জান?
সহজ রান্নাগুলি জানি। যেমন ডিম ভাজতে পারি। ডাল চচ্চড়ি পারি। ভাত রাঁধতে অবিশ্যি পারি না। হয় ভাত নরম জাউ জাউ হয়ে যায়। আর নয়তো চালের মতো শক্ত থাকে। আমি আপনাকে গরম গরম ডিম ভেজে দেব। ডিম ভাজা কি আপনার পছন্দের খাবার?
হ্যাঁ খুব পছন্দের খাবার।
আপনি কি আইসক্রিম পছন্দ করেন?
হ্যাঁ করি।
আমিও খুব আইসক্রিম পছন্দ করি। বাবা পরশু, হংকং থেকে দু লিটারের একটা আইসক্রিম এনেছেন। বিমানের ক্যাপ্টেন হবার অনেক সুবিধা! প্লেনের ফ্রিজে করে নিয়ে এসেছেন -এত ভালো আইসক্রিম আমি অনেক দিন খাই নি। কালো রঙের আইসক্রিম। আপনাকে খাওয়াব।
আচ্ছা। আমি কি টেলিফোন রাখব।
জি না আরেকটু ধরে রাখুন। আচ্ছা শুনুন। এই দীর্ঘ সময় যে টেলিফোন করছেন–দোকানের মালিক বিরক্ত হন নি?
না হন নি। দোকানের মালিক আমাকে খুব পছন্দ করেন।
খুব যদি পছন্দ করে তা হলে আপনাকে দাওয়াত করেন নি কেন? আসলে আমার খুব রাগ লাগছে। আচ্ছা ভদ্রলোকের যে মেয়েটির বিয়ে হয়েছে তার নাম কী?
নাম তো জানি না?
নাম জিজ্ঞেস করে দেখুন। আমার ধারণা মেয়েটির নাম লায়লা!
তুমি জান কী করে? আমি জানি না। আমি অনুমান করছি। আমার অনুমানশক্তি ভালো। আপনি জিজ্ঞেস করে দেখুন।
আচ্ছা জিজ্ঞেস করব। তোমার সঙ্গে কথা শেষ হবার পর জিজ্ঞেস করব।
জিজ্ঞেস করতে আবার ভুলে যাবেন না যেন।
না ভুলব না। এখন টেলিফোন রাখি?
এক মিনিট ধরে রাখুন। কোনো কথা বলতে হবে না। শুধু ধরে রাখুন। এক মিনিট পার হবার পর রিসিভার রেখে দেবেন।
আচ্ছা!
এক মিনিট শুধু শুধু টেলিফোন ধরে রাখতে বলছি কেন জানেন?
না।
আচ্ছা থাক জানতে হবে না।
মিসির আলি ঘড়ি ধরে এক মিনিট টেলিফোন রিসিভার কানে রাখলেন, তারপর রিসিভার নামালেন। মিতা স্টোরের মালিক ইদ্রিস উদ্দিন হাসিমুখে বললেন–টেলিফোন শেষ হয়েছে?
জি।
আপনার জন্যে চা বানাতে বলেছি। চা খেয়ে যান। চায়ে চিনি খান তো?
জি খাই।
মিসির আলি বললেন, আপনার যে মেয়েটির বিয়ে হল তার নাম কী?
তার নাম আফরোজা বানু। আমরা লায়লা বলে ডাকি। মেয়ের বিয়েতে আপনাকে বলার খুব শখ ছিল। আপনার ঠিকানা জানি না। কার্ড দিতে পারি নি। আপনাকে একদিন বাসায় নিয়ে যাব। মেয়ে এবং মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। আপনাদের দোয়ায় ছেলে ভালো পেয়েছি। অতি ভদ্র। কাস্টমসে আছে।
যাব একদিন আপনাদের বাসায়। আপনার মেয়ে এবং মেয়ে-জামাই দেখে আসব।
বাড়ির সামনে লোহার গেট
বাড়ির সামনে লোহার গেট। গেটের পেছনে খাকি পোশাক পরা দারোয়ান। কিন্তু সব কেমন অন্ধকার। গেটে বাতি জ্বলছে না, পোর্চেও জুলছে না। দারোয়ানকে দেখে মনে হচ্ছে সে অন্ধকার পাহারা দিচ্ছে। বাড়ির সামনে বাগানের মতো আছে। স্ট্রিট লাইটের আলোয় সেই বাগানকে খুব অগোছালো বাগান বলে মনে হচ্ছে! মনে হচ্ছে এই প্ৰকাণ্ড বাড়ির জন্যে কোনো মালি নেই। মিসির আলি গাছপালা চেনেন না-বোগেনভিলিয়া চিনতে পারছেন। গাছ ভরতি ফুল তাও বোঝা যাচ্ছে। অন্ধকারের জন্যে মনে হচ্ছে গাছ ভরতি কালো ফুল ফুটেছে।
মিসির আলি গেটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। দারোয়ান টুল ছেড়ে উঠে এল। মিসির আলি বললেন, আমার নাম মিসির আলি। আমি নিশির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
দারোয়ান কোমর থেকে চাবির গোছা বের করে গেট খুলল। একটা কথাও বলল না। মানুষদের অনেক অদ্ভুত স্বভাবের একটি হচ্ছে অন্ধকারে তারা কম কথা বলে। মানুষ ছাড়া অন্য সব জীবজন্তু অন্ধকারেই সাড়াশব্দ বেশি করে।
নিশি কি আছে?
দারোয়ান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তার গলার স্বর কেমন—মিসির আলির শোনার আগ্রহ ছিল, কিন্তু সে মনে হয় কথা বলবে না।
বেল টেপা হয়েছে-কেউ সদর দরজা খুলছে না। মিসির আলি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে পাঁচটা গোলাপ। ঢাকা শহরে এখন গোলাপ চাষ হচ্ছে। সুন্দর সুন্দর গোলাপ পাওয়া যায়। পঁচিশ টাকায় যে পাঁচটা গোলাপ কিনেছেন সেই গোলাপগুলির দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। ফুলের দোকানদার গোলাপের কাঁটা ফেলে দিতে চেয়েছিল–তিনি ফেলতে দেন নি। কাঁটা হচ্ছে গোলাপের সৌন্দর্যের একটা অংশ। কাঁটা ছাড়ানো গোলাপকে তাঁর কাছে নগ্ন বলে মনে হয়।
দারোয়ান আরো একবার বেল টিপে তার টুলে গিয়ে বসল। সে মনে হয় আর বেল টিপবে না। বাকি রাতটা টুলে বসে পার করে দেবে।
ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। ঢাকা শহরে ঝিঁঝির ডাক শোনা যায় না। এই পোকাটা কি মনের ভুলে এদিকে চলে এসেছে? ঝিঁঝি পোকার ডাক, জোনাকির আলো, শেয়ালের প্রহর যাপন ধ্বনি কিছুই আর শোনা হবে না। সব চলে যাবে। প্রাণের বিবর্তনের মতো হবে শব্দের বিবর্তন।
পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। চটি পায়ে কে যেন আসছে। নিশি? হতে পারে। বসার ঘরের বাতি জ্বলল। দরজার ফাঁক দিয়ে সেই আলো এসে পড়ল মিসির আলির গায়ে। ফটা বাজছে দেখার জন্যে মিসির আলি তার পাঞ্জাবির হাতা গুটালেন। হাতে ঘড়ি নেই। ঘড়ি নষ্ট বলে ফেলে রেখেছেন। নতুন ঘড়ি কেনা হচ্ছে না। তিনি নিদারুণ অর্থ সংকটে আছেন। পাঁচটা গোলাপ কেনার সময়ও বুকের ভেতর খচখচ করছিল।