তাকে আমি ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর গল্প বলে ভয় দেখতাম। শরিফার গল্প। আমার ছোট মার গল্প। মানুষটা ভয়ে আতঙ্কে অস্থির হয়ে যেত। দেখে আমার এমন মজা লাগত।
আমি তখন একটা অন্যায় করলাম। খুব বড় ধরনের অন্যায়। একটা নির্দোষ খেলাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবার অন্যায়। আমি তাঁকে ভয় দেখলাম। কীভাবে ভয় দেখলাম জানেন? শরিফা সেজে ভয় দেখলাম।
তিনি সে রাতে আমাকে কম্পিউটার শেখানো শেষ করে তাঁর ঘরে ঘুমাতে যাবেন, আমি বললাম, আপনি কি ভাত খেয়েছেন?
তিনি বললেন, জি না। ভাত রাধব তারপর খাব।
আমি বললাম, এত রাতে ভাত রোধে খেতে হবে না। আমি বুয়াকে বলে দিচ্ছি–আপনাকে খাইয়ে দেবে। একেবারে খাওয়াদাওয়া করে তারপর ঘুমাতে যান।
তিনি সুবোধ বালকের মতো মাথা নাড়লেন।
হাসিব যখন ভাত খাচ্ছিলেন তখন আমি গ্যারেজে তার ঘরে উপস্থিত হলাম। কেউ আমাকে দেখল না। দারোয়ান দুজনই ছিল গেটে। ড্রাইভার বাইরে। আমি কয়েক সেকেন্ড ভাবলাম তারপর হুট করে তাঁর ঘরে ঢুকে গেলাম! ঠিক করে রাখলাম অনেক রাত পর্যন্ত খাটের নিচে বসে থাকব। তিনি খাওয়া শেষ করে ঘরে ঢুকবেন। দরজা লাগাবেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়বেন। তখন হাসির শব্দ করে তাঁর ঘুম ভাঙাব। ঘুম ভাঙতেই তিনি শব্দ শুনে খাটের নিচে তাকাবেন-আধো আলো আধো অন্ধকারে এলোমেলো চুলে শরিফা বসে আছে…সম্পূর্ণ নগ্ন এক ভয়ঙ্কর তরুণী। তাঁর কাছে কী ভয়ঙ্করই না লাগবে! ভাবতেও আনন্দ!
আমার নাম মিসির আলি\
কে বলছেন?
আমার নাম মিসির আলি।
স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
কে কথা বলছ-নিশি?
জি। তুমি ভালো আছ?
জি।
আরো আগেই টেলিফোন করতাম–আমার নিজের টেলিফোন নেই। আমি সাধারণত একটা পরিচিত দোকান থেকে ফোন করি। সেই দোকান গত এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ।
বন্ধ কেন?
জানি না কেন। খোজ নেই নি।
একটা দোকান এক সপ্তাহ হল বন্ধ। আর আপনি হলেন বিখ্যাত মিসির আলি। আপনি খোজ নেবেন না?
খোঁজ নেয়াটা তেমন জরুরি মনে করি নি।
আমার তো ধারণা ব্যাপারটা খুবই জরুরি। বড় ধরনের কোনো কারণ ছাড়া কেউ এক সপ্তাহ ধরে দোকান বন্ধ রাখে না। আজ কি আপনি সেই দোকান থেকে টেলিফোন করছেন?
হুঁ।
ওরা দোকান বন্ধ রেখেছিল কেন?
দোকানের মালিকের মেয়ের বিয়ে ছিল। তিনি দোকানের সব কর্মচারীদের নিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়েছিলেন।
ও আচ্ছা। মেয়ের বিয়োতে আপনাকে দাওয়াত দেয় নি?
না। আমার সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই।
কম পরিচয় থাকলেও তো আপনাকে দাওয়াত দেয়ার কথা। আপনি এত বিখ্যাত ব্যক্তি। বিখ্যাত মানুষরা খুব দাওয়াত পায়। সবাই চায় তাদের অনুষ্ঠানে বিখ্যাতরা আসুক।
তুমি যত বিখ্যাত আমাকে ভাবছ। আমি তত বিখ্যাত নই।
আপনি কি আমার লেখাটা পড়েছেন?
হ্যাঁ।
পুরোটা পড়েছেন?
না পুরোটা পড়ি নি।
কতদূর পড়েছেন?
তুমি হাসিব সাহেবকে ভয় দেখানোর জন্যে খাটের নিচে বসে রইলে পর্যন্ত।
বাকিটা পড়েন নি কেন?
আমার যতটুকু পড়ার পড়ে নিয়েছি। বাকিটা পড়ার দরকার বোধ করছি না। আমার মনে হচ্ছে সবটা পড়ে ফেললে কনফিউজড হয়ে যাব। আমি কনফিউজড হতে চাচ্ছি না। তোমার লেখার প্রধান লক্ষ্য মানুষকে কনফিউজ করা, বিভ্ৰান্ত করা।
আপনি একটু ভুল করছেন। এই লেখাগুলি আমি আপনার জন্যে লিখেছি–মানুষকে বিভ্ৰান্ত করার জন্যে লিখি নি।
তা ঠিক। হ্যাঁ আমাকে বিভ্ৰান্ত করা তোমার প্রধান লক্ষ্য ছিল।
আমার ধারণা ছিল আপনি পুরো লেখাটা পড়বেন তারপর টেলিফোন করবেন।
তোমার সব ধারণা যে সত্যি হবে তা মনে করা কি ঠিক?
সাধারণত আমার সব ধারণাই সত্যি হয়।
শোন নিশি আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
কথা তো বলছেন।
এভাবে না। মুখোমুখি বসে কথা বলতে চাই। তোমার পাণ্ডুলিপিও নিশ্চয়ই তুমি ফেরত চাও। চাও না?
আমার কাছে তোমার কিছু জিনিসপত্রও আছে। হ্যান্ডব্যাগ, সুটকেস। বেশ কিছু টাকা।
ওগুলি আমি নেব না।
টাকা নেবে না?
টাকাটা আপনি রেখে দিন। আপনি রহস্য সমাধানের জন্যে অনেক কর্মকাণ্ড করেন। আপনার টাকার দরকার হয়। যেমন ধরুন আমার ছোট মার মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল। কেইস কি দেয়া হয়েছিল? পোষ্টমাটেম রিপোর্ট কী ছিল তা জানার জন্যে আপনি টাকা খরচ করেন নি?
করেছি। অতি সামান্যই করেছি।
আচ্ছা একটা কথা-আমাদের বাড়ির ঠিকানা কি আপনি আমার লেখা পড়ে জেনেছেন না। আগেই জেনেছেন?
আগেই জেনেছি। থানা থেকে জেনেছি।
আপনি পুরোনো পত্রিকা ঘাটেন নি?
ঘেটেছি। আমি নিজে ঘাটি নি-একজনকে ঠিক করেছিলাম। সে ঘেঁটেছে। তবে সেখান থেকে বাড়ির ঠিকানা পাই নি।
আপনি যে এইসব কর্মকাণ্ড করবেন তা কিন্তু আমি জানতাম।
তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে।
আপনি কি আন্টির সঙ্গে দেখা করেছেন-নীতু আন্টি। তিনি তো এখন মোটামুটি সুস্থ।
ওনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। উনি দেখা করেন নি। শোন নিশি আমি কি এখন আসব?
না আজ না।
আজ না কেন?
বাবা বাড়িতে আছেন এই জন্যে আজ না। যদিও বাবা আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করেন। বাবার ধারণা আপনি সাধারণ মানুষ নন। আপনি মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ। আপনার ওপর লেখা বইগুলি বাবাই আমাকে প্রথম পড়তে দেন।
তোমার বাবার সঙ্গে তা হলে তো দেখা করাটা খুবই জরুরি।
জরুরি কেন?
তোমার বাবা যাতে বুঝতে পারেন যে আমি মহাপুরুষ পর্যায়ের কেউ নই-আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ।
আপনি আমার সমস্যার সমাধান করেছেন?
হ্যাঁ।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আপনি কথা বলছেন, এত আত্মবিশ্বাস থাকা কি ঠিক?