বাবা আমাদের বাড়িতে তাকে থাকতে দিলেন। আমাদের গ্যারেজে তিনটা কামরা আছে। একটা দারোয়ানের, একটা ড্রাইভারের। একটা কামরা খালি। সেই খালি কামরাটায় তাকে থাকতে দেয়া হল। সে মহা খুশি। সারা দিন ঘষামাজা করে ঘর সাজাল। আমার কাছে এসে ক্যালেন্ডার চাইল-দেয়ালে সাজাবে।
তার পড়াশোনা সামান্য। এসএসসি সেকেন্ড ডিভিশন। টাকা পয়সার অভাবে এসএসসি-র বেশি সে পড়তে পারে নি। কম্পিউটারের দোকানে কাজ নিয়েছে। নিজের আগ্রহে কম্পিউটার শিখেছে।
ভদ্রলোককে আমার কয়েকটি কারণে পছন্দ হল। প্রথম কারণ তিনি আমাকে অত্যন্ত সম্মান করেন। আমাকে দেখামাত্র লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ান। দ্বিতীয় কারণ আমার প্রতিটি কথা তিনি বিশ্বাস করেন।
যেহেতু তিনি আমাকে কম্পিউটার শেখাতে এসেছেন প্রথম দিনই আমি তাকে স্যার ডাকলাম। তিনি খুবই লজ্জা পেয়ে বললেন, ম্যাডাম আপনি আমাকে স্যার ডাকবেন না। আমার খুবই লজ্জা লাগছে।
আপনাকে তা হলে কী ডাকব?
নাম ধরে ডাকবেন। আমার নাম হাসিব।
আপনাকে হাসিব ডাকব?
জি।
আচ্ছা বেশ তাই ডাকব।
আমি সহজ ভাবেই তাকে হাসিব ডাকা শুরু করলাম। ভদ্রলোক আমার কম্পিউটারের টিচার হলেও তার সঙ্গে আমার কথাবাতাঁর ধরন ছিল মুনিব-কন্যা এবং কর্মচারীর মতো। আমার তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। ওনারও হচ্ছিল না। স্যার ডাকলেই হয়তো অনেক বেশি অসুবিধা হত।
কম্পিউটারের নানান বিষয় আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শিখতে লাগলাম। উনিও খুব আগ্রহ নিয়ে শেখাতে লাগলেন। বুদ্ধিমতী আগ্ৰহী ছাত্রীকে শেখানোর মধ্যেও আনন্দ আছে। সেই আনন্দ তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠত। রাত জেগে জেগে তাঁর সঙ্গে আমি 3D STUDIO এবং MICRO MEDIA DIRECTOR এই দুটি প্রোগ্রাম শিখছি। একটা সফটওয়্যার তৈরি করছি। যে সফটওয়্যারে কম্পিউটারের পর্দায় শরিফ এসে উপস্থিত হবে। তাকে প্রশ্ন করলে সে প্রশ্নের জবাব দেবে। সহজ প্রশ্ন কিন্তু অদ্ভুত জবাব। যেমন,
প্রশ্ন : আপনার নাম?
উত্তর : আমার কোনো নাম নেই, আমি হচ্ছি ছায়াময়ী। ছায়াদের কি নাম থাকে?
প্রশ্ন : আপনার পরিচয় কী?
উত্তর : আমার কোনো পরিচয়ও নেই। পরিচয় মানেই তো ব্যাখ্যা ও বর্ণনা। আমাকে ব্যাখ্যা ও বর্ণনায় ধরা যাবে না।
পর্দায় প্রশ্নের উত্তরগুলি লেখা হবে না। পর্দায় ভাসবে শরিফার বিচিত্র সব ছবি এবং উত্তরগুলি ধাতবকণ্ঠে শোনা যাবে।
হাসিব একদিন জিজ্ঞেস করলেন। (খুব ভয়ে ভয়ে। আমাকে যে কোনো প্রশ্নই খুব ভয়ে ভয়ে করেন। ভাবটা এরকম যেন প্রশ্ন শুনলেই আমি রেগে যাব)-
শরিফা কে?
আমি বললাম শরিফা একটি মৃতা মেয়ে।
ও আচ্ছা।
আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন?
জি করি। করব না কেন?
ভূত দেখেছেন কখনো?
জি না।
আপনি যদি শরিফাকে দেখতে চান আমি তাকে দেখতে পারি। ওর সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় আছে। আমি বললেই সে আসবে।
জি না দেখতে চাই না। আমি খুব ভীতু।
আমি ডাকলেই শরিফা চলে আসবে। আপনি এটা বিশ্বাস করলেন?
বিশ্বাস করব না কেন? আপনি তো আর শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলবেন না। আপনি সেই ধরনের মেয়ে না।
আমি কোন ধরনের মেয়ে?
খুব ভালো মেয়ে।
আপনি কম্পিউটারের মতো আধুনিক জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, আবার ভূতও বিশ্বাস করেন?
জি ভূত বিশ্বাস করি, জিনও বিশ্বাস করি। কুরআন শরিফে জিনের কথা আছে। একটা সুরা আছে-সুরার নাম হল—সুরায়ে জিন।
তাই বুঝি?
জি।
আপনি আমাকে একটা ভূতের গল্প বলুন তো!
ম্যাডাম আমি ভূতের গল্প জানি না।
কিছু না কিছু নিশ্চয়ই জানেন মনে করে দেখুন। ছোটবেলায় ভয় পেয়েছিলেন। এমন কিছু।
খুব ছোটবেলায় একবার শ্মশান-কোকিলের ডাক শুনেছিলাম।
কিসের ডাক শুনেছিলেন?
শ্মশান–কোকিল। ভয়ঙ্কর ডাক। কেউ যদি শ্মশান–কোকিলের ডাক শোনে তার নিকটাত্মীয় মারা যায়।
আপনার কি কেউ মারা গিয়েছিল?
আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন।
মৃত্যুর পর তাঁকে কখনো দেখেছেন?
প্রায়ই স্বপ্নে দেখি।
স্বপ্রের কথা বলছি না। জাগ্ৰত অবস্থায় তাঁকে কখনো দেখেছেন?
জি না।
শ্মশান-কোকিল পাখিটা দেখতে কেমন?
দেখতে কেমন জানি না। ম্যাডাম। শশানের আশপাশে থাকে। কেউ দেখে না।
আপনাদের গ্রামে শ্মশান আছে?
জি আছে। মহাশ্মশান। খুব বড়।
আমার শ্মশান দেখতে ইচ্ছে করছে। আপনি কি আমাকে আপনাদের গ্রামে নিয়ে যাবেন।
উনি হতভম্ব গলায় বললেন, থাকবেন কোথায়?
কেন আপনাদের গ্রামের বাড়িতে।
অসম্ভব কথা বলছেন ম্যাডাম। আমরা খুবই গরিব। খড়ের চালা ঘর। মাটির দেয়াল।
হাসিব খুবই নাৰ্ভাস হয়ে গেলেন। তার ভাবটা এরকম যেন এখনই তাকে নিয়ে আমি তাদের গ্রামের বাড়িতে রওনা হচ্ছি। মানুষের সারল্য যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে তা তাকে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। তবে হাসিব বোকা ছিলেন না। আমাদের ধারণা সরল মানুষ মানেই বোকা মানুষ এই ধারণা সত্যি নয়।
মিসির আলি সাহেব আপনার কি ধারণা আমি এই মানুষটার প্রেমে পড়েছি? আমার মনে হয় না। মানুষটাকে আমি করুণা করতাম। প্রেম এবং করুণা এক ব্যাপার নয়। প্ৰেম সৰ্ব্বগ্রাসী ব্যাপার। প্রেমের ধর্ম হচ্ছে অগ্নি। আগুন যেমন সব পুড়িয়ে দেয় প্রেমও সব ছারখার করে দেয়। হাসিব নামের মানুষটির প্রতি প্ৰবল করুণা ছাড়া আমি কিছু বোধ করি নি।
তার সঙ্গে আমার কথা বলতে ভালো লাগত–এই পর্যন্তই। আমি নিঃসঙ্গ একটা মেয়ে, কারো সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা হওয়াটাকে আপনি নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক বলবেন না। ছোটবেলা থেকেই আমার অনেক খেলনা ছিল। খেলনা নিয়ে খেলতে ভালো লাগত। হাসিবের সঙ্গে আমার ব্যাপারটাও সেরকম। সে ছিল আমার কাছে মজার একটা খেলনার মতো।