জি আচ্ছা।
মেরিল্যান্ডে দেখার মতো সুন্দর সুন্দর জিনিস অনেক আছে। তুমি কি দেখেছ?
জি না।
কাল আমি তোমাকে লিস্ট করে দেব। দেশে যাবার আগে তুমি দেখে যাবে।
আচ্ছা।
তুমি কি জান যে তুমি খুব ভালো মেয়ে?
জানি।
ভদ্রমহিলা আমার সঙ্গে আরো তিন দিন সিটিং দিলেন। আমি তাঁকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করলাম। তাঁকে যা বিশ্বাস করাতে চাইলাম তিনি তাই বিশ্বাস করলেন এবং খুব আনন্দিত হলেন এই ভেবে যে তিনি বিদেশিনী এক কিশোরী মেয়ের জীবনের সমস্ত জটিলতা দূর করে ফেলেছেন। তার অন্ধকার ঘরে এক হাজার ওয়াটের বাতি জ্বেলে দিয়েছেন।
আমার সম্পর্কে তিনি যা ধারণা করলেন তা হচ্ছে—
১) আমি খুব ভালো একটা মেয়ে, সরল, বুদ্ধি কম, জগতের জটিলতা কিছু জানি না। (খুব ভুল ধারণা।)
২) আমি নিঃসঙ্গ একটি মেয়ে। আমার সবচে বড় শত্রু আমার নিঃসঙ্গতা। (ভুল ধারণা। আমি নিঃসঙ্গ নই। আমি কখনো একা থাকি না। নিজের বন্ধুবান্ধব নিজে কল্পনা করে নেই। কল্পনাশক্তিসম্পন্ন মানুষ কখনো নিঃসঙ্গ হতে পারে না।)
৩) আমি খুব ভীতু ধরনের মেয়ে। (আবারো ভুল। আমার মধ্যে আর যাই থাকুক ভয় নেই। যখন আমার সাত আট বছর বয়স তখনো রাতে ঘুম না এলে আমি একা এক ছাদে চলে যেতাম।)
৪) বাবাকে আমি অসম্ভব ঘৃণা করি। (খুব ভুল কথা। বাবা চমৎকার মানুষ। আমার ক্ষুদ্র জীবনে যে কজন ভালো মানুষ দেখেছি তিনি তাদের একজন।)
আমি ভদ্রমহিলার মাথায় এইসব ভুল ঢুকিয়ে দিয়েছি। তিনি খুশি মনে ভুলগুলি গ্ৰহণ করেছেন।
মানুষ কী অদ্ভুত দেখেছেন? মানুষ কত সহজেই না ‘ভুল’—সত্যি ভেবে গ্ৰহণ করে।
আমেরিকান মহিলা মনস্তত্ত্ববিদ
আমেরিকান মহিলা মনস্তত্ত্ববিদ বাবাকে কী বলেছিলেন আমি জানি না। বাবাকে আমি জিজ্ঞেস করি নি। তবে অনুমান করতে পারি যে তিনি বাবাকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। বাবা দেশে ফিরেই সেই উপদেশমতো চলতে শুরু করলেন। প্রথমেই আমার শোবার ঘর বদলে দিলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন শোবার ঘর বদলানোর ব্যাপারে। আমি খুব। আপত্তি করব। নানান ভণিতা করে তিনি বললেন-মা তোমার এই ঘরটা খুব ছোট। তুমি বড় হয়েছ তোমার আরো বড় ঘর দরকার। তা ছাড়া আমি ভাবছি তোমাকে একটা কম্পিউটার কিনে দেব…কম্পিউটার টেবিল সেট করার জন্যেও জায়গা লাগবে……
আমি তাঁকে কথা শেষ করতে দিলাম না, তার আগেই বললাম-বাবা আমাকে তুমি একটা বড় ঘর দাও! এই ঘরটা আসলেই ছোট।
তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, নতুন ঘরে যখন যাচ্ছ তখন এক কাজ করা যাক। নতুন ঘরের জন্যে আলাদা করে ফার্নিচার কেনা যাক।
আমি বললাম, আচ্ছা। বাবা বললেন, আমার পাশের ঘরটা তুমি নিয়ে নাও। বাবা-মেয়ে পাশাপাশি থাকব, কী বল? ভালো হবে না?
খুব ভালো হবে বাবা।
আমার ঘর বদল হল। নতুন ফার্নিচার এল। যা ভেবেছিলাম। তাই হল, পুরোনো খাট বদলে কেনা হল আধুনিক বক্স খাট। যার নিচে বসার উপায় নেই। সাইকিয়াট্রিস্ট নিশ্চয়ই বাবাকে এই বুদ্ধি দিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন কলেজ থেকে ফিরে দেখিআমার আগের শোবার ঘরের কোনো ফার্নিচার নেই। সব ফার্নিচার কোথায় যেন পাচার করা হয়ে গেছে। বাবার পাশের ঘরটা সুন্দর করে সাজানো। নতুন ফার্নিচার। একটা টেবিলে ঝকঝকে কম্পিউটার।
কম্পিউটার কিনে দেবার কথাও হয়তো সাইকিয়াট্রিস্ট বাবাকে বলে দিয়েছিলেন। কম্পিউটারে নানা ধরনের খেলা নিয়ে আমি ব্যস্ত থাকব। খাটের নিচে কে বসে আছে তা নিয়ে মাথা ঘামাব না।
নতুন ঘরে থাকতে এলাম। বাবা আমার ঘরের দরজায় লাল ফিতা দিয়ে রেখেছেন। ফিতা কেটে ঢুকতে হবে। গৃহ-প্রবেশের মতো ঘর-প্রবেশ অনুষ্ঠান।
বাবা বললেন, এসএসসিতে তুমি খুব ভালো রেজাল্ট করেছ বলে এই কম্পিউটার। আমি বললাম, থ্যাংক য়্যু।
নতুন যুগের কম্পিউটার—খুব পাওয়ারফুল। টু গিগা বাইট মেমোরি। এই কম্পিউটার দিয়ে তুমি অনেক কিছু করতে পারবে।
অনেক কিছু মানে কী?
কম্পিউটার গ্রাফিকাস করা যাবে। এনিমেশন করা যাবে। ইচ্ছে করলে ডিজনীর মতো–লিটল মারমেইড জাতীয় কার্টুন ছবিও বানিয়ে ফেলতে পার। তোমার যা বুদ্ধি, ভালো কম্পিউটার পেলে তুমি অনেক কিছু করতে পারবে।
আমার যে খুব বুদ্ধি তা তুমি বুঝলে কী করে?
তোমার রেজাল্ট দেখে বুঝেছি! আমি তো কল্পনাও করি নি তুমি এত ভালো রেজাল্ট করবে।
মিসির আলি সাহেব, প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা নিয়েও আমি খুব ভালো রেজাল্ট করি। কেমন ভালো জানেন? সব পত্রিকায় আমার ছবি ছাপা হয়। আমার প্রিয় লেখক কে, প্রিয় গায়ক কে, প্রিয় খেলোয়াড় কে এইসবও ছাপা হয়।
ওই প্রসঙ্গ থাক। কম্পিউটার প্রসঙ্গে চলে আসি। বাবা শুধু যে আমাকে কম্পিউটার কিনে দিলেন তাই না-আমাকে সবকিছু শেখানোর জন্যে একজন ইন্সট্রাকটার রেখে দিলেন। ইন্সট্রাকটারের নাম-হাসিবুর রহমান। লোকটা লম্বা, রোগী। ইটে চাপা পড়ে থাকা ঘাসের মতো চেহারা। বয়স এই ধরুন পীচিশ-ছাব্বিশ। দেখতে ভালো। মেয়েদের মতো টানা টানা চোখ। একটা ভুল কথা বলে ফেললাম। সব মেয়েদের তো আর টানা টানা চোখ থাকে না।
কম্পিউটারের সব বিষয়ে হাসিবুর রহমানের জ্ঞান অসাধারণ। কিন্তু লোকটি হতদরিদ্র। তার থাকার জায়গা পর্যন্ত নেই। রাতে সে ঘুমায় একটা কম্পিউটারের দোকানে। তাকে অতি সামান্য কিছু টাকা সেই দোকান থেকে দেয়া হয়-এতে তার দুবেলা খাওয়াও বোধহয় হয়। না, তবে এতেই সে খুশি। এত অল্পতে কাউকে খুশি হতেও আমি দেখি নি।