সাইকিয়াট্রিস্টদের অনেক ব্যাপার। আমি লক্ষ করেছি। তারা প্রথম যে কাজটি করেন। তা হচ্ছে রোপীর সঙ্গে অত্যন্ত পরিচিত ভঙ্গিতে কথা বলেন। যেন রোগী তার অনেক দিনের চেনা প্রায় বন্ধু স্থানীয়। মিসেস জেন ওয়ারেন এই কাজটা ভালোই করেন। আমাকে দেখে প্রায় চেঁচিয়ে যে কথাটা বললেন তা হল-ও ডিয়ার, তোমাকে আজ এত সুন্দর লাগছে কেন? ভাবটা এরকম যেন তিনি আমাকে আগেও দেখেছেন তখন এত সুন্দর লাগে নি। বিদেশীরা গায়ে হাত দিয়ে কথা বলে না-ইনি প্রথমবারেই গায়ে হাত রাখলেন।
তোমার নাম হল নিশি। আমার উচ্চারণ ঠিক হয়েছে?
হয়েছে।
নিশি অর্থ হল Night
হ্যাঁ।
মুন লিট নাইট?
জানি না!
অফকোর্স মুন লিট নাইট। তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তোমার জীবন আলোময়।
থ্যাংক য়্যু।
তোমার বয় ফ্রেন্ডের নাম কী?
আমার কোনো বয় ফ্রেন্ড নেই।
এমন রূপবতী কন্যার বয় ফ্রেন্ড থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে। তুমি বলতে চাচ্ছ না? এইসব চলবে না-তোমার বয় ফ্রেন্ডের নাম বল, তার ছবি দেখাও।
ভদ্রমহিলা আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছেন, আমিও কিন্তু তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করছি। আমি যে তাকে বুঝতে চেষ্টা করছি সেটা মনে হয় তিনি ধরতে পারছেন না। বেশিরভাগ মানুষ নিজেদেরকে অন্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান মনে করে। মিসেস জেনও তাই করছেন। আমাকে কিশোরী একটা মেয়ে ভেবে কথা বলছেন, মন জয় করার চেষ্টা করছেন। আমি এমন ভাব করছি যেন ভদ্রমহিলার কথাবার্তায় অভিভূত। আমি তাঁর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। ঠিক যে জবাবগুলি তিনি শুনতে চাচ্ছেন—সেই জবাবগুলিই দিচ্ছি! কোনো মানুষ যখন প্রশ্ন করে তখন সে যে জবাব শুনতে চায় সেই জবাবটা কিন্তু প্রশ্নের মধ্যেই থাকে।
জেন ওয়ারেন বললেন, আচ্ছা নিশি বাবাকে কি তুমি খুব ভালবাস?
প্রশ্ন করার মধ্যেই কিন্তু যে জবাবটা তিনি শুনতে চাচ্ছেন সেটা আছে। তিনি শুনতে চাচ্ছেন যে বাবাকে আমি মোটেই ভালবাসি না। এই জবাব শুনলে হয়তো তার রোগ ডায়াগনেসিসে সুবিধা হয়। কাজেই তাঁর এই প্রশ্নের জবাবে আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম এবং খুব অনিচ্ছার ভঙ্গিতে হাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম।
ভদ্রমহিলা দারুণ খুশি হয়ে গেলেন।
শোন নিশি-ইয়াং লেড়ি। যদিও তুমি এফারমেটিভ ভঙ্গিতে মাথা নেড়েছ তারপরে মনে হয় তুমি সত্যি কথা বলছি না। আমরা বন্ধু-একজন বন্ধু অন্য বন্ধুকে অবশ্যই সত্যি কথা বলবে তাই না! এখন বল-ভূমি কি তোমার বাবাকে খুব ভালবাস?
আমি হ্যাঁ-না কিছুই বললাম না।
ভদ্রমহিলা আমার আরো কাছে ঘেঁষে এসে বললেন, তুমি কি বাবাকে পছন্দ কর না?
আমি আবারো চুপ করে রইলাম। ভদ্রমহিলা এবার প্রায় ফিসফিস করে বললেনতুমি কি তোমার বাবাকে ঘৃণা করা? আচ্ছা ঠিক আছে মুখে বলতে না চাইলে এখানে দুটা কাগজ আছে একটাতে লেখা Yes এবং একটাতে No, যে কোনো একটা কাগজ তুলে নাও। প্রশ্নটা মন দিয়ে শোন—
তুমি কি তোমার বাবাকে ঘৃণা কর?
আমি Yes লেখা কাগজটা তুললাম। এবং এমন ভাব করলাম যে লজ্জায় দুঃখে। আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। আমার চোখে পানি চলে এল। আমি এমন ভাব করছি যেন চোখের জল সামলাতে আমার কষ্ট হচ্ছে। একসময় হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। বিদেশীরা চোখের পানি কম দেখে বলে চোখের পানিকে তারা খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। বাঙালি মেয়েরা যে অতি সহজে চোখের পানি নিয়ে আসতে পারে এই তথ্য তারা জানে না। তা ছাড়া আমি যে কত বড় অভিনেত্রী তাও তিনি জানেন না। তিনি ছুটে গিয়ে টিসু পেপার নিয়ে এলেন। নিজেই চোখ মুছিয়ে দিলেন। করুণা বিগলিত গলায় বললেন, শোন মেয়ে তোমার লজ্জিত বা দুঃখিত হবার কিছু নেই। আমেরিকান স্ট্যাটিসটিকস বলছে শতকরা ২৮.৬০ ভাগ আমেরিকান পুত্ৰ-কন্যারা তাদের বাবাকে ঘৃণা করে। তুমি আমাকে যা বলেছ তোমার বাবা তা কোনো দিন জানবেন না। এই বিষয়ে তোমাকে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এখন একটু শান্ত হও। কফি খাবে?
আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম, খাব।
আমরা কফি খেলাম। ভদ্রমহিলা আনন্দিত গলায় বললেন–আমার ধারণা তোমার সমস্যা আমি ধরতে পারছি। সেই সমস্যার সমাধান করা এখন আর কঠিন হবে না। অবিশ্যি তুমি যদি আমাকে সাহায্য কর। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?
ভেরি গুড। আমরা দুজনে মিলে তোমার সমস্যা সমাধান করব। কেমন?
আচ্ছা।
তোমার বাবাকে তুমি কেন ঘৃণা কর?
বাবা মদ খায়।
শুধু মদ্যপান করে বলেই ঘৃণা কর?
মাতাল হয়ে তিনি একদিন পাড়ি চালাচ্ছিলেন তখন অ্যাকসিডেন্ট হয়। সেই অ্যাকসিডেন্টে আমার মা মারা যান।
তোমার বাবা আমাকে তোমার মার মৃত্যুর কথা বলেছেন। কিন্তু কীভাবে মারা গেছেন তা বলেন নি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
জেন ওয়ারেন সিগারেট ধরালেন। তিনি বেশ কায়দা করে সিগারেট টানছেন।
নিশি, সিগারেটের ধোঁয়ায় তোমার অসুবিধা হচ্ছে না তো?
জি না।
আমি সিগারেট ছাড়ার চেষ্টা করছি পারছি না। যে কোনো ভালো অভ্যাস সামান্য চেষ্টাতেই ছেড়ে দেয়া যায়–খারাপ অভ্যাস হাজার চেষ্টাতেও ছাড়া যায় না। ঠিক না?
ঠিক।
এখন বল তুমি নাকি তোমার মাকে দেখতে পাও এটা কি সত্যি?
না, সত্যি না।
তা হলে বল এই মিথ্যা কথাটা কেন বলতে?
বাবাকে ভয় দেখাবার জন্যে বলতাম।
বাবাকে ভয় দেখানোর জন্যে তুমি তা হলে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথাই বলেছি?
জি।
যা বলেছ তোমার বাবা তাই বিশ্বাস করেছেন?
জি।
আচ্ছা আজকের মতো তোমার সঙ্গে আমার কথা শেষ। কাল আবারো আমরা বসব। কেমন?