আচ্ছা।
মা ঠিক করে বল, তোমার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই?
না।
তুমি তোমার ছোট মাকে মাঝে মাঝে দেখতে পাও এটা কি সত্যি? তোমার আন্টি আমাকে বলেছিল।
হ্যাঁ সত্যি।
তুমি শরিফা মেয়েটিকেও দেখতে পাও।
আগে পেতাম। এখন পাই না।
তোমার কাছে কি মনে হয় না–এই ব্যাপারগুলি অস্বাভাবিক?
না। কারণ শরিফাকে নীতু আন্টিও দেখেছেন।
হ্যাঁ সে আমাকে বলেছে। শরিফাকে এখন আর তুমি দেখতে পাও না?
না সে তার স্বামীর কাছে চলে গেছে। তবে আমি চাইলে সে আবার চলে আসবে।
বুঝিয়ে বল।
আমি স্বপ্নে যা দেখি তাই হয়। স্বপ্নে কী দেখতে চাই এটাও আমি ঠিক করতে পারি। কাজেই আমি যদি ভাবি স্বপ্নে দেখছি শরিফা চলে এসেছে তা হলে সে চলে আসবে। এবং তখন তুমি চাইলে তুমিও তাকে দেখতে পাবে।
এ ব্যাপারটাও তোমার কাছে নরমাল মনে হয়? অস্বাভাবিক মনে হয় না?
না, আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় না। আমার মনে হয় সব মানুষেরই ইচ্ছাপূরণ ধরনের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা আছে। কী করে সেই স্বপ্নটা দেখতে হয় তা তারা জানে না বলে স্বপ্ন দেখতে পারে না।
নিশি!
জি।
তুমি এক কাজ কর। শরিফা মেয়েটিকে নিয়ে এস আমি তাকে দেখতে চাই।
আচ্ছা।
কদিন লাগবে তাকে আনতে?
বেশি দিন লাগবে না। স্বপ্নটা দেখতে পেলেই সে চলে আসবে।
যত তাড়াতাড়ি পার তাকে নিয়ে এস কারণ মেরিল্যান্ড যাবার আগে আমি তাকে দেখতে চাই।
আচ্ছা।
তোমার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
খুব ভালো হচ্ছে।
গান শেখা কেমন হচ্ছে?
গান শেখাও ভালো হচ্ছে। তোমার গানের স্যারের সঙ্গে কদিন আগে কথা হল। তিনি তোমার গানের গলার খুব প্রশংসা করলেন। তোমার নাকি কিন্নর কণ্ঠ।
সব গানের স্যাররাই তাদের ছাত্রছাত্রীদের গানের গলা সম্পর্কে এ জাতীয় কথা থলে। আমার গানের গলা ভালো না।
আমি তোমার গান একদিন শুনতে চাই।
এখন গাইব?
এখন গাইতে হবে না।
তোমার জরুরি কথা বলা কি শেষ হয়েছে বাবা?
হুঁ।
আমি চলে যাব?
হ্যাঁ যাও। শরিফা মেয়েটি এলে আমাকে খবর দিও।
আচ্ছা।
আমি আমার ঘরে এসে ঘড়ি দেখলাম, এগারটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। আমি য়াত সাড়ে এগারটার সময় আবার বাবার ঘরে গেলাম। তিনি সম্ভবত ক্ৰমাগতই মদ্যপান করে যাচ্ছেন। তাঁর চোখ খানিকটা লাল। মুখে বিবৰ্ণ ভাব। এমনিতে তিনি সিগারেট খান না-আজ খুব সিগারেট খাচ্ছেন। ঘর ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে আছে। বাবা আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার মা?
আমার ঘরে এস।
কেন?
শরিফাকে দেখতে চেয়েছিলে শরিফ এসেছে।
তুমি না ডাকতেই চলে এসেছে? আমি চুপ করে রইলাম।
বাবা বললেন, শরিফা সত্যি এসেছে?
হ্যাঁ।
কী করছে?
আমার খাটের নিচে বসে আছে।
বাবা হাসলেন। অবিশ্বাসী মানুষের হাসি। বাবা বললেন, তুমি কি তার সঙ্গে কথাও বল?
হ্যাঁ বলি।
সে কি আমার সঙ্গে কথা বলবে?
জানি না। বলতেও পারে।
আমার ধারণা সে আমার সঙ্গে কথা বলবে না। আমি তাকে দেখতেও পাব না। কারণ শরিফা নামের মেয়েটি খাটের নিচে বসে নেই। তোমার মাথার ভেতর একটা ঘর আছে, যে ঘর অবিকল তোমার শোবার ঘরের মতো। সেই ঘরের খাটের নিচে সে বসে আছে। কাজেই তাকে দেখতে পাবার কোনো কারণ নেই। বুঝতে পারছ?
পারছি।
কাজেই মেয়েটিকে দেখতে যাওয়া অর্থহীন।
তুমি যাচ্ছ না?
না।
আমি ফিরে আসছি। বাবা পেছন থেকে ডাকলেন–নিশি দাঁড়াও আসছি। আমি দাঁড়ালাম। বাবার মদ্যপান আজ মনে হয় একটু বেশিই হয়েছে। তিনি সহজভাবে হাঁটতেও পারছেন না। সামান্য টলছেন। আমি বললাম, বাবা তোমার হাত ধরব? তিনি বললেন, না। আই অ্যাম জাস্ট ফাইন।
বাবা আমার ঘরে ঢুকলেন। ঘরে টেবিলল্যাম্প জ্বলছে-মোটামুটি আলো আছে। বাবা নিচু হয়ে খাটের নিচে তাকালেন। আমি তাকিয়ে রইলাম। বাবার দিকে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম–বাবার শান্ত ভঙ্গি বদলে যাচ্ছে–তার চোখে ভয়ের ছায়া। সেই ছায়া গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। তিনি হতভম্ব চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন খাটের নিচে। তার চোখে পলক পড়ছে না। আমি বললাম, বাবা কিছু দেখতে পাচ্ছ?
তিনি হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ করতে লাগলেন। যেন তার বুকে বাতাস আটকে গেছে তিনি তা বের করতে পারছেন না। খুব যারা বুড়ো মানুষ তারা এ ধরনের শব্দ করে। তবে নিজেরা সেই শব্দ শুনতে পায় না। অন্যরা শুনতে পায়।
আমি বাবাকে হাত ধরে টেনে তুললাম। তাঁকে ধরে ধরে তার ঘরে নিয়ে গেলাম। তিনি প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বললেন—প্রচুর মদ্যপান করেছি। আমার আবার লিমিট পাঁচ পেগ সেখানে আট পেগ খেয়েছি তো-তাই হেলুসিনেশন হচ্ছে। খাটের নিচে কিছুই ছিল না। কিছুই না। অন্ধকার তো, আলো-ছায়াতে মানুষের মতো দেখাচ্ছে। টর্চ লাইট নিয়ে গেলে কিছুই দেখব না।
টর্চ লাইট নিয়ে দেখতে চাও বাবা?
তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন—না।
পরের সপ্তাহে আমি বাবার সঙ্গে মেরিল্যান্ড চলে গেলাম। মিসেস জেন ওয়ারেন। নামের এক মহিলা সাইকিয়াট্রিস্ট আমার চিকিৎসা শুরু করলেন। মিসেস জেন ওয়ারেন এম ডি-র বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। আমেরিকান বৃদ্ধ মহিলারা খুব সাজগোজ করেন। ঠোটো কড়া করে লিপস্টিক দেন, চুল পার্ম করেন, কানে রঙচঙে প্লাস্টিকের দুল। পরেন। হাঁটুর উপরে খুব রঙিন—ঝলমলে স্কার্ট পরেন। তাঁদের দেখেই মনে হয় তাঁরা খুব সুখে আছেন।
মিসেস জেন ওয়ারেনও তার ব্যতিক্রম নন। এত নাম করা মানুষ কিন্তু কেমন খুকি সেজে ছটফট করছেন। আহ্লাদী ভঙ্গিতে কথা বলছেন।