বাবা তখন কফি খাচ্ছিলেন। তিনি খুব ভোরবেলা ওঠেন। নিজেই কফি বানিয়ে খান। তিনি মনে হল আমার কথা বুঝতে পারলেন না, কাপ নামিয়ে রেখে বললেন-মা কী বললে?
আমি আবারো বললাম, ছোট মা মারা গেছেন।
বাবা দ্বিতীয় শব্দ উচ্চারণ করলেন না।
আমার ঘরে এসে ঢুকলেন। এক পলক ছোট মাকে দেখলেন।
তাঁর কপালে হাত রাখলেন। তারপর রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।
ছোট মার পর শরিফা মারা গেল। সেও থাকত আমার ঘরে। সেও কি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল? আমরা যদি ধরে নেই কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নি, তা হলে বুঝতে হবে শরিফা নিজেই ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে। যে মেয়ে পরদিন স্বামীর কাছে যাবে সে এই কাণ্ড কখন করবে? মানসিকভাবে অসুস্থ হলেই করবে। শরিফাও তা হলে অসুস্থ ছিল।
আন্টির অসুস্থতাতো চোখের সামনে ঘটল। আমার ঘরেই তার শুরু। কাজেই বাবা যদি ভেবে থাকেন প্রতিটি অসুস্থতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে তা হলে বাবাকে খুব একটা দোষ দেয়া যায় না।
এক রাতে, খাবার টেবিলে তিনি বললেন-নিশি, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। আমি বললাম, বল।
বাবা বললেন, খাবার টেবিলে বলতে চাচ্ছি না, খাওয়া শেষ করে আমার ঘরে আসা। দুজন কথা বলি।
আমি বললাম, আচ্ছা!
তোমার বয়স এখন কত?
আমি বললাম, অক্টোবরে পনের হবে।
তা হলে তো তুমি অনেক বড় মেয়ে! তোমার বয়স পনের হতে যাচ্ছে তা বুঝতে পারি নি।
আমি হাসলাম। বাবা বললেন, তুমি যে খুব সুন্দর হয়েছ তা কি তুমি জান?
না।
কেউ তোমাকে বলে নি? তোমার বন্ধুবান্ধবরা?
না। আমার কোনো বন্ধুও নেই!
নেই কেন?
কারো সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয় না।
হয় না কেন?
আমি তো জানি না কেন হয় না। মনে হয়। আমাকে কেউ পছন্দ করে না।
তোমাকে পছন্দ না করার তো কোনো কারণ নেই।
তুমি নিজেই আমাকে পছন্দ কর না। অন্যদের দোষ দিয়ে কী হবে?
আমি তোমাকে পছন্দ করি না?
তোমার এই ধারণা হল কেন?
আমি চুপ করে রইলাম। বাবাও চুপ করে গেলেন। মনে হচ্ছে তিনি খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন। অস্বস্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিস্ময়বোধ। অতি কাছের একজনকে নতুন করে আবিষ্কারের বিস্ময়।
রাত দশটার দিকে বাবার ঘরে গেলাম। ইচ্ছে করে খুব সেজোগুজে গেলাম। লাল পাড়ের হালকা সবুজ একটা শাড়ি পারলাম। কপালে টিপ দিলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চমকে গেলাম-কী সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে বিয়েবাড়ির মেয়ে। কনের ছোট বোন।
বাবা আমার সাজগোজ দেখে আরো ভড়কে গেলেন। বিব্রত গলায় বললেন, মা বোস। তোমাকে তো চেনা যাচ্ছে না।
আমি বসতে বসতে বললাম, তোমার জরুরি কথা শুনতে এসেছি।
বাবা বললেন, এত সেজেছ কেন?
এমনি সজলাম। মাঝে মাঝে আমার সাজতে ইচ্ছা করে।
আমি আগে কখনো তোমাকে সাজতে দেখি নি।
আমাকে কি সুন্দর লাগছে না বাবা?
অবশ্যই সুন্দর লাগছে। কপালের টিপটা কি নিজেই এঁকেছ?
আমি বললাম, বাবা তুমি নানান কথা বলে সময় নষ্ট করছ। কী বলবে সরাসরি থলে ফেল। অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই।
অস্বস্তি বোধ করার কথা আসছে কেন?
তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তুমি অস্বস্তি বোধ করছ। তুমি বরং এক কাজ কর, দুই পেগ হুইস্কি খেয়ে নাও-এতে তোমার ইনহিবিশন কাটবে। যা বলতে চাচ্ছ সরাসরি বলে ফেলতে পারবে।
হুইঙ্কি খেলে ইনহিবিশন কাটে এই তথ্য জানলে কোত্থেকে?
গল্পের বই পড়ে। তোমার কাছ থেকে আমার গল্পের বই পড়ার অভ্যাস হয়েছে। আমিও দিনরাত বই পড়ি।
এটা একটা ভালো অভ্যাস।
বাবা তোমার কথাটা কী?
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ দুম করে বললেন, তোমার ভেতর কিছু রহস্য আছে। রহস্যটা কী?
আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। বাবা। তুমি কোন রহস্যের কথা বলছি? সব মানুষের মধ্যেই তো রহস্য আছে।
বাবা বললেন, সব মানুষের মধ্যে রহস্য আছে ঠিকই। তবে সেই সব রহস্য ব্যাখ্যা করা যায়। তোমার রহস্য ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। আমি সেটাই জানতে চাচ্ছি।
আমি এখনো তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। আলমারি খুলে হুইঙ্কির বোতল বের করলেন।
মিসির আলি সাহেব আপনাকে এতক্ষণ একটা কথা বলা হয় নি। লজ্জা লাগছিল বলেই বলতে পারি নি—আমার বাবা প্রচুর মদ্যপান করেন। এটা তাঁর অনেক দিনের অভ্যাস। আমার ধারণা মা যে মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। তার কারণ মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে বাবা অ্যাকসিডেন্ট করেন। আমি অবিশ্যি এসব নিয়ে বাবাকে কখনো কোনো প্রশ্ন করি নি। আরেকটা কথা আপনাকে বলা হয় নি-ছোট মা বাবার কাছ থেকে মদ্যপানের অভ্যাস করেছিলেন। এই অংশটি এতক্ষণ গোপন রাখার জন্যে আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন।
বাবা বললেন, নিশি শোন। নিজের সম্পর্কে তোমার কী ধারণা? তুমি নিজে কি মনে করা তোমার চরিত্রে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে?
না।
তুমি নিশ্চিত যে তোমার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।
আমি নিশ্চিত।
তোমার আশপাশে যারা থাকে তারা অস্বাভাবিক আচরণ করে কেন?
আমি জানি না। তুমিও তো আমার আশপাশেই থাক–তুমি তো অস্বাভাবিক আচরণ কর না।
তুমি আমার সঙ্গে তর্ক করছ কেন?
তৰ্ক করছি না। তুমি প্রশ্ন করছি আমি তার জবাব দিচ্ছি।
আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে তোমাকে দেখাতে চাই।
বেশ তো দেখাও।
আগামী সপ্তাহে আমি মেরিল্যান্ডে যাচ্ছি। আমাদের সুপারসনিকের ওপর শর্ট ট্রেনিং হবে। তুমিও চল। সাইকিয়াট্রিস্ট তোমাকে দেখবে।