ছোট আফা ফেলছে। ছোট মানুষ বুঝে নাই। তার ওপরে রাগ হইয়েন না আম্মা।
ফারজানা তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে?
জে।
তুমি কি তাকে দেখেছ ধাক্কা দিয়ে ফেলতে?
জে না। পিছনে থাইক্যা ধাক্কা দিছে। অন্য কেউও হইতে পারে।
অতিদ্রুত আন্টির শরীর খুব খারাপ করল। তিনি একেবারেই ঘুমাতে পারেন না। গাদা গাদা ঘুমের ওষুধ খান-তারপরেও জেগে থাকেন। সারাক্ষণ নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলেন। অর্থহীন এলোমেলো সব কথা! হঠাৎ হাসতে শুরু করেন। সেই হাসি কিছুতেই থামে না। আবার যখন কাঁদতে থাকেন-সেই কান্নাও চলতে থাকে।
বাবা যখন দেশে ফিরলেন তখন আন্টি পুরোপুরি উন্মাদ। কাউকেই চিনতে পারেন না। আমাকেও না। আন্টির চেহারাও খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মুখ শুকিয়ে মিসরের মমিদের মতো হয়ে গেছে। দাত বের হয়ে এসেছে। সারা শরীরে বিকট গন্ধ। বাবা হতভম্ব হয়ে গেলেন। আন্টির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হল। চিকিৎসায় কোনো লাভ হল না। ক্ৰমে ক্ৰমে তার পাগলামি বাড়তে থাকল। বাবাকে দেখলেই তিনি ক্ষেপে উঠতেন। একদিন সকালে পাউরুটি কাটার ছুরি নিয়ে তিনি বাবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যেতে পারত। ভাগ্যক্রমে ঘটে নি—শুধু বাবার পিঠ কেটে রক্তারক্তি হয়ে গেল।
আন্টিকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হল। আন্টির বাবা এসে তাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে থেকে তিনি কিছুটা সুস্থ হলেন। তখন তাঁকে আবার আমাদের এখানে আনা হল। তিনি আবারো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হল।
মাঝে মধ্যে আমি ওনাকে দেখতে যেতাম। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতেন না। কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকতেন। আন্টিদের বাড়ির কেউ চাইত না যে আমি যাই। আমি যাওয়া ছেড়ে দিলাম।
শরিফার প্রসঙ্গে আসি। শরিফার হাত থেকে আমি খুব সহজে মুক্তি পেয়ে যাই। শরিফাকে আমি এক রাতে বলি-শরিফা তোমার কি উচিত না তোমার স্বামীর সঙ্গে গিয়ে থাকা?
শরিফা বলল, জে উচিত।
তুমি তার কাছে চলে যাও।
হে কই থাকে জানি না আফা!
আমি তাকে এনে দেব?
জে আফা।
আমি শরিফার স্বামীকে খবর পাঠালাম সে যেন এসে তার সাইকেল নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর যেন আসে।
সে খুশি মনে সাইকেল নিতে এল। সাইকেলের সঙ্গে সে অন্য কিছুও নিয়ে গেল। মিসির আলি সাহেব-আপনার জন্যে বিস্ময়কর খবর হল-মাসখানেক পরে আমি খবর নিয়ে জানতে পারি শরিফার স্বামীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তার আত্মীয়স্বজনরা তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিল। ভর্তি করাতে না পেরে শহরেই তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে।
সম্বোধন কুৎসিত লাগছে
মিসির আলি সাহেব,
এই সম্বোধন বারবার করতে আমার কুৎসিত লাগছে। নামের শেষে সাহেব। আবার কী? নামের শেষে সাহেব লাগালেই মানুষটাকে অনেক দূরের মনে হয়। দূরের মানুষের কাছে কি এমন অন্তরঙ্গ চিঠি লেখা যায়? একবার ভেবেছিলাম স্যার লিখি। তারপর মনে হল-স্যার তো সাহেবের মতোই দূরের ব্যাপার। মিসির আলি চাচা লিখব? না তাও সম্ভব না। মিসির আলি এমনই এক চরিত্র যাকে চাচা বা মামা ডাকা যায় না। গৃহী কোনো সম্বোধন তাকে মানায় না। দেখলেন আপনাকে আমি কত শ্ৰদ্ধা করি? না দেখেই কোনো মানুষকে এতটা শ্রদ্ধা করা কি ঠিক?
থাকুক তত্ত্বকথা-নিজের গল্পটা বলে শেষ করি। অনেকদূর তো বলেছি—আপনি কি বুঝতে পারছেন যা বলছি সব সত্যি বলছি? অর্থাৎ আমি যা সত্যি বলে বিশ্বাস করছি তাই বলছি।
যতটুকু পড়েছেন সেখান থেকে কি বুঝতে পারছেন যে বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো না।
বাবা আমাকে পছন্দ করেন না।
কেন করেন না, আমি জানি না। আমি কখনো জিজ্ঞেস করি নি। কিন্তু বুঝতে পেরেছি। পছন্দ করেন না মানে এই না যে তিনি সারাক্ষণ ধমকাধমকি করেন। এইসব কিছুই না। মাঝে মাঝে গল্প করেন। লেজার ডিস্কে ভালো ছবি আনলে হঠাৎ বলেন, মা এস ছবি দেখি। জন্মদিনে খুব দামি গিফট দেন। যতবারই বাইরে যান আমার জন্যে কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। তারপরেও আমি বুঝতে পারি বাবা আমাকে তেমন পছন্দ করেন না। মেয়েরা এইসব ব্যাপার খুব সহজে ধরতে পারে। কে তাকে পছন্দ করছে কে করছে না–এই পর্যবেক্ষণশক্তি মেয়েদের সহজাত! এই বিদ্যা তাকে কখনো শিখতে হয় না। সে জন্মসূত্রে নিয়ে আসে। ওই যে কবিতা–
“এ বিদ্যা শিখে না নারী আসে আপনাতে”
আন্টি অসুস্থ হয়ে যাবার পর বাবা যেন কেমন কেমন চোখে আমাকে দেখতে লাগলেন। যেন আমিই আন্টিকে অসুস্থ করেছি। আমি যেন ভয়ঙ্কর কোনো মেয়ে–আমার সংস্পর্শে যে আসবে সেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
বাবার দুশ্চিন্তার কারণও আছে। ছোট মা অসুস্থ হবার পর আমার ঘরেই বেশিরভাগ সময় থাকতেন। তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আমার বিছানাতে শুয়ে মারা যান। যে রাতে তিনি মারা যান সে রাতে অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প করেন। আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর তিনি ঘুমের ওষুধ খান-একটা চিঠি লেখেন। তারপর আমার সঙ্গে ঘুমাতে আসেন। আমি ভোরবেলা জেগে উঠে দেখি তিনি কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন-চোখ আধা খোলা। চোখের সাদা অংশ চকচক করছে। মুখ খানিকটা হাঁ করা। হাত-পা হিম হয়ে আছে। আমার তখন খুব কম বয়স। তারপরেও আমি বুঝলাম তিনি মারা গেছেন। আমি ভয় পেলাম না। চিৎকার দিলাম না। শান্ত ভঙ্গিতেই বিছানা থেকে নামালাম। দরজা ভেতর থেকে ছিটিকিনি দেয়া। আমি চেয়ারে দাঁড়িয়ে ছিটিকিনি খুলে বাবার ঘরে গিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাবাকে বললাম, ছোট মা মারা গেছেন।