মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন। তাঁর কিছুই শুনতে ইচ্ছা করছে না। মাথার যন্ত্রণা এবং শীত ভাব দুইই বাড়ছে। গায়ে পাতলা একটা চাদর দিয়ে শীত ভাবটা কমানো যেত। চাদরটা ধুপিখানায় দিয়েছেন। ধোয়া নিশ্চয়ই হয়ে গেছে, ক্লিপের অভাবে আনতে পারছেন না। ক্লিপটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না। কড়া এক কাপ চা খেলেও শীতটা কমত। ঘরে চায়ের পাতা আছে, চিনি, দুধও আছে। গতকালই কিনে এনেছেন। কিন্তু গ্যাসের চুলায় কী একটা সমস্যা হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগুন জ্বলেই হস করে নিভে যায়। মিন্ত্রি ডাকিয়ে চুলা ঠিক করা দরকার। গ্যাস মিস্ত্রিরা কোথায় থাকে কে জানে?
সায়রা বানু মেয়েটি হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছে, তার কথা তিনি মন দিয়ে শুনছেন না। মাথায় দুশ্চিন্তা নিয়ে অন্য কিছুতে মন বসানো বেশ কঠিন। তবে মাছিটা এখন শান্ত হয়েছে। টেবিলের উপর চুপ করে বসে আছে। ডিম পাড়ছে না তো?
আমার সাদা বাঘিনী টাইটেল পাওয়ার ঘটনাটা খুব ইন্টারেস্ট্রিং। শুনলে আপনি খুব মজা পাবেন! বলব?
মিসির আলি কিছুই বললেন না। তিনি খুব ভালো করেই জানেন মেয়েটি তার গল্প বলবেই। তিনি বলতে বললেও বলবে, বলতে না বললেও বলবে।
হয়েছে কী শুনুন-সায়েন্স ল্যাবরেটরির সামনে দিয়ে আমি যাচ্ছি। আমার সঙ্গে আমার এক বন্ধু, রাকা। রাকা হচ্ছে বোরকাওয়ালী। বোরকা পরে। সউদি বোরকা। বেশ কয়েক টাইপ বোরকা পাওয়া যায় তা কি আপনি জানেন? সউদি বোরকা, পাকিস্তানি বোরকা। সউদি বোরকা ভয়াবহ, শুধু চোখ দুটো বের হয়ে থাকে। এমনিতে সে অবিশ্যি খুব স্ট্রাইলিস্ট। বোরকার নিচে ক্লিভলেস ব্লাউজ পরে। যাই হোক বোরকাওয়ালী রাকা হঠাৎ বলল, সে একটা পেনসিল কিনবে। আমি তাকে নিয়ে একটা দোকানে ঢুকলাম পেনসিল কিনতে। স্টেশনারির দোকান তবে তার সঙ্গে কনফেকশনারিও আছে। চা বিক্রী হচ্ছে। কেক বিক্রি হচ্ছে। দোকানটায় বেশ ভিড়। ভিড়ের সুযোগ নিয়ে এক লোক করল কী বোরকাওয়ালীর গায়ে হাত দিল। গায়ে মানে কোথায় তা আপনাকে বলতে পারব না। আমার লজ্জা লাগবে। বোরকাওয়ালী এমন ভয় পেল যে প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে যাচ্ছিল। আমি বোরকাওয়ালীকে ধরে ফেললাম। তারপর বদমাশ লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি ওর গায়ে হাত দিলেন কেন? ষণ্ডাগণ্ডা টাইপের লোক। লাল চোখ। গরিলাদের মতো লোম ভরতি হাত। সে এমন ভাব করল যে আমার কথাই শুনতে পায় নি। দোকানদারের দিকে তাকিয়ে হাই তুলতে তুলতে বলল—দেখি একটা লেবু চা। তখন আমি খপ করে তার হাত ধরে ফেললাম। সে ঝটিকা দিয়ে তার হাত ছড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার আগেই আমি তার হাত কামড়ে ধরলাম। যাকে বলে কচ্ছপের কামড়। কচ্ছপের কামড় কী তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন। কচ্ছপ একবার কামড়ে ধরলে আর ছাড়ে না, আমিও ছাড়লাম না। আমার মুখ রক্তে ভরে গেল। লোকটা বিকট চিৎকার শুরু করল। ব্যাপারস্যাপার দেখে বোরকাওয়ালী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এর পর থেকে আমার টাইটেল হয়েছে সাদা বাঘিনী।
গল্প শেষ করে সায়রা বানু খিলখিল করে হাসছে। মিসির আলি মেয়েটির হাসির মাঝখানেই বললেন, তুমি আমার কাছে কেন এসেছ?
গল্প করার জন্যে এসেছি। বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে গল্প করতে আমার খুব ভালো লাগে।
আমি বিখ্যাত মানুষ?
অবশ্যই বিখ্যাত। আপনাকে নিয়ে কত বই লেখা হয়েছে। আমি অবিশ্যি একটা মাত্র বই পড়েছি। ওই যে সুধাকান্ত বাবুর গল্প। একটা মেয়ে খুন হল আর আপনি কেমন শার্লক হোমসের মতো বের করে ফেললেন–সুধাকান্ত বাবুই খুনটা করেছেন। বই পড়ে মনে হচ্ছিল। আপনার খুব বুদ্ধি কিন্তু আপনাকে দেখে সেরকম মনে হচ্ছে না।
আমাকে দেখে কেমন মনে হচ্ছে?
খুব সাধারণ মনে হচ্ছে। আপনার মধ্যে একটা গৃহশিক্ষক গৃহশিক্ষক ব্যাপার আছে। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি নিয়মিত বেতন পান মা এমন একজন অংকের স্যার। আপনি রোজ ভাবেন আজ বেতনের কথাটা বলবেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহস করে বলতে পারেন না। আচ্ছা। আপনি এমন গভীর মুখে বসে আছেন কেন? মনে হচ্ছে আপনি আমার কথা শুনে মজা তো পাচ্ছেনই না উল্টো বিরক্ত হচ্ছেন! সত্যি করে বলুন আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?
কিছুটা হচ্ছি।
মাছিটা তো এখন আর বিরক্ত করছে না। কেমন শান্ত হয়ে টেবিলে বসে আছে। তারপরেও আপনি এত বিরক্ত কেন বলুন তো?
তুমি অকারণে কথা বলছ এই জন্যে বিরক্ত হচ্ছি। অকারণ কথা আমি নিজেও বলতে পারি না অন্যের অকারণ কথা শুনতেও ভালো লাগে না।
আপনার সঙ্গে কথা বলতে হলে সব সময় একটা কারণ লাগবে? তা হলে তো আপনি খুবই বোরিং একটা মানুষ। এত কারণ আমি পাব কোথায় যে আমি রোজ রোজ আপনার সঙ্গে কথা বলব?
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি রোজ রোজ আমার সঙ্গে কথা বলবে?
হুঁ।
সে কী, কেন?
সায়রা বানু খুব সহজ ভঙ্গিতে হাই তুলতে তুলতে বলল, এক বাড়িতে থাকতে হলে কথা বলতে হবে না?
এক বাড়িতে থাকবে মানে? আমি বুঝতে পারছি না।
আমি আপনার সঙ্গে কয়েকটা দিন থাকব। কদিন এখনো বলতে পারছি না। দু দিনও হতে পারে আবার দু মাসও হতে পারে। আবার দু বছরও হতে পারে। সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আপনার উপর।
মিসির আলি চেয়ার থেকে পা নামিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালেন। হচ্ছেটা কী? এই যুগের টিনএজার মেয়েদের ভাবভঙ্গি, কাণ্ডকারখানা বোঝা মুশকিল। তারা যে কোনো উদ্ভট কিছু হাসিমুখে করে ফেলতে পারে। মেয়েটি হয়তো অতি তুচ্ছ কারণে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। কিংবা তাকে ভড়কে দেবার জন্যে গল্প ফেঁদেছে। পরে কলেজে বন্ধুদের কাছে এই গল্প করবে। বন্ধুরা মজা পেয়ে একে অন্যের গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়বে।–ও মাগো বুড়োটাকে কী বোকা বানিয়েছি! সে বিশ্বাস করে ফেলেছিল যে আমি থাকতে এসেছি।