না।
অনেক সময় খেলতে গিয়েও এরকম হয়। হয়তো হাসতে হাসতে ধাক্কা দিয়েছসে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেছে। তোমার কোনো দোষ ছিল না।
না।
আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
ভালো।
গান কেমন হচ্ছে?
ভালো।
গান কি তুলেছি না এখনো সারে গামা করে যাচ্ছ?
একটা গান তুলেছি।
কি গান?
নজরুল গীতি।
গানের লাইনগুলি কী?
পথ চলিতে যদি চকিতে-গাইব?
না থাক। আরেকদিন শুনব।
আমি কি এখন চলে যাব?
আচ্ছা যাও।
আমি উঠে চলে এলাম। বাবা ভুরু কুঁচকে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলেন। তিনি আমাকে বিশ্বাস করেন নি এটা বোঝা যাচ্ছে। তিনি যে আমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাও বুঝতে পারছি। খুব অল্প বয়সেই আমি আসলে বেশি বেশি বুঝতে শিখেছিলাম। বেশি বুঝতে পারাটা এক ধরনের দুর্ভাগ্য। যারা কম বুঝতে পারে–এই পৃথিবীতে তারাই সবচে সুখী। বোকা মানুষরা কখনো আত্মহত্যা করে না।
বাবা আমার কথা বিশ্বাস না করলেও আন্টি করলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে নিজ থেকে তাকে আমার কিছু বলতে হল না। তিনি আপনাতেই সব বুঝতে পারলেন। ঘটনাটা এরকম-রাতে তিনি আমার সঙ্গে ঘুমাতে এসেছেন (শরিফার মৃত্যুর পর তিনি প্রতি রাতেই আমার সঙ্গে ঘুমাতেন।) বাতি নিভিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে মৃদু গলায় গল্প শুরু করলেন—তাদের গ্রামের বাড়ির গল্প। বাড়ির পেছনে একটা পেয়ারা গাছ ছিল। তিনি পাকা পেয়ারার খোঁজে। গাছে উঠেছেন। হঠাৎ দেখলেন গাছের ডাল পেঁচিয়ে একটা সাপ। সাপটার গায়ের রঙ অবিকল পেয়ারা গাছের ডালের মতো। সাপটা তাকে দেখে পালিয়ে গেল না–উলটো তার দিকে আসতে শুরু করল ….
এই পর্যায়ে আন্টি গল্প থামিয়ে দিলেন। আমি বললাম, কী হয়েছে?
আন্টি বললেন, ফোঁপাচ্ছে কে? আমি ফোঁপানির শব্দ শুনছি। তুমি কি শুনছ?
শব্দ আমিও শুনছিলাম। কেঁপাচ্ছে শরিফা। খাটের নিচে বসে মাঝে মধ্যেই সে ফোঁপানির মতো শব্দ করে। আমি আন্টির প্রশ্নের জবাব দিলাম না। চুপ করে রইলাম! আন্টি বললেন, মনে হচ্ছে খাটের নিচে কেউ বসে আছে। ফোঁপাচ্ছে। তুমি শুনতে পাচ্ছ না?
না।
আমি পরিষ্কার শুনছি—পচা গন্ধও পাচ্ছি। তুমি গন্ধ পাচ্ছ না?
না।
আন্টি উঠে বসলেন। টেবিলল্যাম্প জ্বালালেন। বিছানা থেকে নেমে তাকালেন। খাটের নিচে। আমি তাকিয়ে রইলাম আন্টির মুখের দিকে। আমি দেখলাম ভয়ে এবং আতঙ্কে হঠাৎ আন্টির মুখ ছোট হয়ে গেল। তিনি বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। কী বললেন, আমি বুঝতে পারলাম না। আন্টি ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছিলেন। তার ফর্সা গাল হয়েছে টকটকে লাল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আন্টিকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন! আন্টি চাপা গলায় বললেন–কে কে?
আম্মা আমি শরিফা।
শরিফা!
জে আম্মা। আমি এইখানে থাকি!
শরিফা!
জে আম্মা। আমি হাঁটাচলা করতে পারি না–এইখানে থাকি। আমারে বিদায় দিয়েন না আম্মা। আমার যাওনের জায়গা নাই… ।
আন্টি উঠে দাঁড়ালেন। টলতে টলতে খাটের কাছে এসে খাটে উঠলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে তৎক্ষণাৎ শুয়ে পড়লেন। আমি বললাম, কী হয়েছে?
আন্টি জড়ানো গলায় বললেন, কিছু না। তুমি ঘুমাও।
আমি বললাম, খাটের নিচে কিছু দেখেছেন আন্টি?
তিনি বললেন, না। তুমি ঘুমাও। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। আন্টি সম্ভবত সারা রাতই জেগে রইলেন। পরদিন ভোরে জেগে উঠে দেখি আন্টি হাঁটু মুড়ে বসে আছেন। ঘরে তখনো টেবিলল্যাম্প জুলছে। আন্টির চোখ জ্বলজ্বল করছে! এক রাতেই তাঁর চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে! আন্টি ক্লান্ত গলায় বললেন, ফারজানা তুমি কি রান্নাঘরে গিয়ে বলে আসবে আমাকে এক কাপ চা দিতে?
আমি বললাম, আন্টি আপনার কি শরীর খারাপ করেছে? তিনি বললেন, না। শরীর ভালো আছে।
আন্টি বিছানায় বসে চা খেলেন। তাঁকে খুব চিন্তিত মনে হল। আমাকে অবিশ্যি তিনি কিছুই বললেন না। আমি সহজ স্বাভাবিকভাবেই হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা করলাম। স্কুলে চলে গেলাম। আন্টি সারা দিন আমার ঘরেই থাকলেন। ঘর থেকে বেরুলেন না।
বাবা সে সময় দেশে ছিলেন না। বছরে একবার পাইলটদের নতুন করে কী সব শেখায়। রিভিয়্যু হয়। বাবা সেই ট্রেনিঙে তখন আমষ্টারডামে। বাড়িতে আমি আর আন্টি। আন্টি আমার ঘরেই থাকেন। তিনি রাতে একেবারেই ঘুমান না। আমার কিন্তু ঘুম পায়। আগের অনিদ্রা রোগ তখন সেরে গেছে। বিছানায় যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে বাথরুম পেলে কিংবা পানির পিপাসা পেলে ঘুম ভাঙে। আমি দেখি আন্টি মেঝেতে বসে আছেন। তার বসার ভঙ্গি শরিফার বসার ভঙ্গির মতোই। তিনি মৃদু স্বরে শরিফার সঙ্গে কথা বলেন।
শরিফা!
জে আম্মা?
কী করছ?
কিছু করনের নাই আম্মা। বইসা আছি।
এখান থেকে চলে যাও।
কই যামু? যাওনের জায়গা নাই। পথঘাটও চিনি না।
চাও কী তুমি?
কিছু চাই না! কী চামু?
দিনের বেলা তোমাকে দেখি না কেন? দিনে তুমি কোথায় যাও?
জানি না আম্মা। কী হইতেছে আমি কিছুই বুঝি না। দিশা পাই না।
তোমার ক্ষুধা হয়?
জে হয়। জবর ভুখ লাগে-কিন্তু আম্মা খাওন নাই। আমারে কে খাওনা দিব?
এখন ক্ষুধা হয়েছে?
জে হয়েছে।
বিস্কুট আছে খাবে? বিস্কুট দেব?
জে না। অ্যাফনাগো খাওন আমি খাইতে পারি না।
তুমি কি খুব কষ্টে আছ?
বুঝি না। আম্মা। কিছু বুঝি না। দিশ পাই না।
তুমি যে মারা গেছ তা কি জান?
জে জানি।
কেউ কি তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে?
জে।
কে ফেলেছে?