না। আপনি তা বলবেন না। মানুষের যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা থাকতে পারে এইসব আপনি বিশ্বাস করেন না। আপনার কাছে মানুষ যন্ত্রের মতো। একটা ছেলে যদি একটা মেয়েকে ভালবাসে তা হলে আপনি ধরেই নেবেন–ব্যাপারটা আর কিছুই না। একজন আরেকজনের প্রতি শারীরিক আকর্ষণ বোধ করছে। শারীরিক আকর্ষণ যেহেতু নোংরা। একটা ব্যাপার কাজেই ভালবাসা নামক মিষ্টি একটা শব্দ ব্যবহার করছে। কুইনাইনকে সুগার কোটেড করা হচ্ছে। আমি কি ভুল বললাম?
আমি ভুল বলি নি। আপনি যাই ভাবেন-কিন্তু শুনুন স্বপ্ন তৈরি করার ক্ষমতা আমার আছে। এবং আমি এখনো পারি। ঘটনা বলি। ঘটনা বললেই আপনি বুঝবেন।
শরিফা তো বাড়ি থেকে চলে গেল। ওর বিয়ে হবার কথা। বিয়ে হলে আর ফিরবে: না। আমি একদিন স্বপ্ন দেখলাম ওর বিয়ে হচ্ছে। চেংড়া টাইপের ছেলে। পান খেয়ে দাত লাল করে আছে–আর ভ্যাক ভ্যাক করে হাসছে। স্বপ্ন দেখে খুব মেজাজ খারাপ হল। তখন ভাবলাম, বিয়ে হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু বরের সঙ্গে ওর খুব ঝগড়া হয়েছে, ও চলে এসেছে আমাদের বাড়িতে। যেরকম ভাবলাম অবিকল সেরকম স্বপ্ন দেখলাম! হলেও তাই। এক সন্ধ্যাবেলা শরিফা উপস্থিত। তার বিয়ে হয়ে গেছে কিন্তু বর তাকে নিচ্ছে না। বিয়ের সময় কথা হয়েছিল বরকে একটা সাইকেল এবং নগদ পোচ হাজার এক টাকা দেয়া হবে। কোনোটাই দেয়া হয় নি বলে তারা কিনে উঠিয়ে নেবে না। যেদিন সাইকেল এবং টাকা দেয়া হবে সেদিনই মেয়ে তুলে নেবে। আমি শরিফাকে বললাম, তোমার কি মন খারাপ?
শরিফা বলল, মন খারাপ কইরা লাভ আছে আফা?
তোমাকে যে তুলে নিচ্ছে না তোমার রাগ লাগছে না?
না। সাইকেল আর টেকা দিব বইল্যা দেয় নাই। তারার তো আফা কোনো দোষ নাই। একটা জিনিস দিবেন বলবেন, তারপরে দিবেন না—এইটা কেমন কথা?
তোমার বর পছন্দ হয়েছে?
হুঁ।
তোমার সঙ্গে তোমার বরের কথা হয়েছে?
ওমা কথা আবার হয় নাই? এক রাইত তার লগে ছিলাম না?
রাতে তোমরা কী করলে?
কওন যাইব না আফা। বড়ই শরমের কথা। লোকটার কোনো লজ্জা নাই। এমন বেহায়া মানুষ জন্মে দেখি নাই। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
না, বল আমি শুনব।
অসাম্ভাব কথা আফা। ছিঃ!
তুমি বলবে না?
জীবন থাকতে না।
আমি নিষিদ্ধ কথা শোনার জন্যে ছটফট করছিলাম। এবং আমি জানি শরিফাও নিষিদ্ধ কথাগুলি কলার জন্যে ছটফট করছিল।
দেখলেন তো স্বপ্ন পাল্টে কীভাবে শরিফাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম? আপনি বলবেন, কাকতালীয়। মোটেই না, শরিফার বরকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করল, কাজেই একদিন খুব ভাবলাম, শরিফার বর এসেছে। যেমন ভাবলাম, ঠিক সেরকম স্বপ্ন দেখলাম। শরিফার বর চলে এল। নীল রঙের একটা লুঙ্গি। রবারের জুতা। সিঙ্কের চক্রবক্র একটা শার্ট। এসেই বাসার সবাইকে পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলল। এমনকি আমাকেও। শরিফার বরের নাম সিরাজ মিয়া। সে নারায়ণগঞ্জে একটা লেদ মেশিনের হেল্পার।
আন্টি তাকে খুব বকা দিলেন। কঠিন গলায় বললেন, তুমি পেয়েছ কী? যৌতুক পাও নি বলে বউ ঘরে নেবে না। তুমি কি জান পুলিশে খবর দিলে তোমার পাঁচ বছরের জেলা হয়ে যাবে। বাংলাদেশে যৌতুক নিবারণী আইন পাস হয়েছে। দেব পুলিশে খবর?
সিরাজ মিয়া বলল, ইচ্ছা হইলে দেন। আফনেরা বড়লোক। আফনেরা যা বলবেন। সেইটাই ন্যায়।
আন্টি আরো রেগে গেলেন। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল এখনই তিনি ধানমন্ডি থানার ওসিকে খবর দেবেন। আমাকে বললেন, ফারজানা দাও তো টেলিফোনটা। ওসি সাহেবকে আসতে বলি।
আমি টেলিফোন এনে দিলাম। আমার একটু ভয় ভয় করছিল, কিন্তু সিরাজ মিয়া নির্বিকার। তাকে চা আর কেক খেতে দেয়া হয়েছে। সে চায়ে কেক ড়ুবিয়ে বেশ মজা করে খাচ্ছে।
আন্টি ধানমন্ডি থানার ওসিকে খবর দিলেন না। কাকে যেন টেলিফোন করে। বললেন, একটা নতুন সাইকেল কিনে বাসায় নিয়ে আসতে।
সিরাজ মিয়া নির্লজের মতো বলল, আমারে টেকা দেন। আমি দেইখ্যা শুইন্যা কিনিব। বাজারে নানান পদের সাইকেল–সব সাইকেল ভালো না।
আন্টি বললেন, তোমাকে দেখেশুনে কিছুই কিনতে হবে না। তুমি তোমার আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে আসা। আমি তোমাকে সাইকেল আর পাঁচ হাজার এক টাকা দিয়ে দেব। তুমি শরিফাকে নিয়ে যাবে। যদি শুনি এই মেয়ের উপর কোনো অত্যাচার হয়েছে আমি তোমার চামড়া খুলে ফেলব। গরুর চামড়া যেভাবে খোলে ঠিক সেইভাবে খোলা হবে।
সিরাজ মিয়া চা কেক খেয়ে হাসিমুখে চলে গেল। বলে গেল। আগামী বুধবার সে তার বাবাকে নিয়ে আসবে। এবং সেদিনই বউ নিয়ে চলে যাবে।
আন্টির এই ব্যাপারটা আমার কী যে ভালো লাগল। আনন্দে আমার চোখে প্রায় পানি এসে গেল। আর শরিফা যে কী খুশি হল। এক্কেবারে পাগলের মতো আচরণ। এই হাসছে। এই কাঁদছে।
বুধবার সকালে শরিফাকে নিয়ে যাবে। আন্টি তার বরের জন্যে শুধু যে সাইকেল আনালেন তা না-একটা নতুন শার্ট কেনালেন। শরিফাকে দিলেন দুটা শাড়ি—কানের দুল। শরিফা নিজেই দোকান থেকে রুপার নূপুর কিনে এনে পায়ে পরেছে। যখন হাঁটে ঝমোঝম শব্দ হয়। খুব হাস্যকর ব্যাপার।
মঙ্গলবার আমাদের স্কুল ছুটি ছিল। বৌদ্ধ পূর্ণিমার ছুটি। আমি দুপুরে শুয়ে আছি— হঠাৎ স্বপ্নে দেখি–ছোট মা এসে আমাকে বলছেন, ফারজানা আমি বলেছিলাম না। এই মেয়েটাকে শাস্তি দেব? ও চলে যাচ্ছে—যাবার অ্যাগে শাস্তি দিয়ে দেয়া দরকার তাই না? আমি চুপ করে রইলাম। ছোট মা বললেন—কথা বলছি না কেন? কী ধরনের শাস্তি দেয়া যায় বল তো। তুমি যেরকম শাস্তির কথা বলবে আমি ঠিক সেরকম শাস্তি দেব।