আকাশে মেঘমালা
বাতাসে মধু
নীতু নব সাজে সেজে
নবীনা বধূ
একবার নীতু আন্টির বিয়ের কথা হচ্ছিল তখন রবীন্দ্রনাথ প্লানচেটে এই কবিতা লিখে যান। সেই বিয়ে অবশ্য হয় নি।
আমি নীতু আন্টিকে খুব করে ধরলাম। আমাকে প্ল্যানচেট শিখিয়ে দিতে। তিনি শিখিয়ে দিলেন। খুব সহজ, একটা কাগজে এ বি সি ডি লেখা থাকে। একটা বোতামে আঙুল রেখে বসতে হয়। মুখোমুখি দুজন বসতে হয়। মুখে বলতে হয়-If any good soul passes by, please come. তখন মৃত আত্মা চলে আসেন এবং বোতামে আশ্রয় নেন। এবং বোতাম নড়তে শুরু করে। আত্মাকে প্রশ্ন করলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে সেই প্রশ্নের জবাব আসে। এক অক্ষর থেকে আরেক অক্ষরে গিয়ে পুরো বাক্য তৈরি হয়। এ বি সি ডি না লিখে অ, আ, লিখেও হয়। তবে A B C D লেখাই সহজ।
নীতু আন্টির কাছ থেকে শিখে আমি খুব আত্মা আনা শুরু করলাম। বেশিরভাগ সময়ই রবীন্দ্রনাথ আসেন। মনে হয় তাঁর অবসরই সবচেয়ে বেশি।
এক রাতে ছোট মা চলে এলেন। সে রাতে বাসায় কেউ ছিল না। বাবা এবং নীতু আন্টি গিয়েছেন বিয়েতে। ফিরতে রাত হবে। শরিফা গিয়েছে দেশের বাড়িতে। তার মামা এসে তাকে নিয়ে গেছে। তার বিয়ের কথা হচ্ছে। বিয়ে হয়ে গেলে সে আর ফিরবে না। একা একা প্ল্যানচেট নিয়ে বসেছি। বোতামে আঙুল রাখতেই বোতাম নড়তে শুরু করল। আমি বললাম, আপনি কি এসেছেন?
বোতাম চলে গেল Yes লেখা ঘরে। অর্থাৎ তিনি এসেছেন।
আমি বললাম, আপনি কে?
বোতাম চলে গেল R অক্ষরে। অর্থাৎ যিনি এসেছেন তাঁর নামের প্রথম অক্ষর R খুব সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ আবার এসেছেন। আমি বললাম, আপনার নামের শেষ অক্ষরও কি R বোতাম চলে গেল Yes এ। রবীন্দ্রনাথ যে এসেছেন তাতে আর সন্দেহ নেই। আমি বললাম। আমার মতো ছোট্ট একটা মেয়ের ড্রাকে যে আপনি এসেছেন। তাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি আমার অভিনন্দন গ্ৰহণ করুন। এই সব হচ্ছে গৎ বাধা কথা। মৃত আত্মাকে সম্মান দেখানোর জন্য এইসব বলতে হয়। তবে শুধু ভালো আত্মাদের বেলায় বলতে হয়। খারাপ আত্মাদের বেলায় কিছু বলতে হয় না। খারাপ আত্মাদের অতি দ্রুত বিদেয় করার ব্যবস্থা করতে হয়।
আমি ধন্যবাদ দেয়া শেষ করার পরপর এক কাণ্ড হল। দরজার পর্যাদা সরিয়ে ছোট মা ঘরে ঢুকলেন। অনেক অনেক দিন পর তার দেখা পেলাম। আগে ছোট মাকে দেখে কখনো ভয় পাই নি—সে রাতে হঠাৎ বুক ধক করে উঠল। ভয় পাবার প্রধান কারণ খাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, আমার ভয় হচ্ছিল–এই বুঝি ইলেকট্রসিটি চলে যাবে। আমার ঘয়ে একটা চার্জর আছে। ইলেকট্রসিটি চলে গেলে চার্জার জ্বলে ওঠার কথা। আমার ঘরের চার্জরটা নষ্ট। মাঝে মাঝে ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। কিন্তু চার্জার জ্বলে না। টেবিলের দুয়ারে অবিশ্যি মোমবাতি আছে। দেয়াশলাই আছে কি না জানি না। মনে হয়। নেই। ভয়ে আমার বুক ধকধক করছে–আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ছোট মার দিকে। তিনি বললেন, ফারজানা কেমন আছ?
এইরে আমার আসল নাম বলে ফেললাম। যাই হোক আমার ধারণা ইতিমধ্যে আপনি আমার নাম জেনে ফেলেছেন। ভালো কথা চিত্রাও কিন্তু আমার নাম। আমার আসল মা আমার নাম রেখেছিলেন চিত্রা। মার মৃত্যুর পর কেন জানি এই নামটা আর তাকা হত না। আমার আরো দুটা ডাকনাম আছে-বিবি, বাবা এই নামে আমাকে তাকেন। আরেকটা হল–নিশি। বাবা ছাড়া বাকি সবাই আমাকে নিশি নামে ডাকে। ঘাকি সবাই বলতে আমি স্কুলের বন্ধুদের কথা বলছি।
যে কথা বলছিলাম, ছোট মা বললেন, ফারজানা কেমন আছ?
আমি বললাম, ভালো।
তুমি, একা, তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
অনেক দিন পর তোমাকে দেখতে এসেছি! তোমার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। চুল খুব সুন্দর করে কেটেছে। কে কেটে দিয়েছে?
নীতু আন্টি।
তিনি তোমাকে খুব ভালবাসেন?
হুঁ।
তাঁকে কি তুমি আমার কথা বলেছি?
না।
খুব ভালো করেছ। শরিফাকে আমার কথা বলেছ?
হ্যাঁ।
শরিফা মেয়েটা খুব খারাপ তুমি কি তা জান?
না।
মেয়েটা তোমাকে খারাপ করে দিচ্ছে তা কি বুঝতে পারছ? মেয়েটাকে তুমি পছন্দ কর। তাই না?
হ্যাঁ।
তুমি আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছ কেন? তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?
হ্যাঁ।
ভয় পেও না।
আচ্ছা।
ভূত নামানোর খেলা কেন খেলছ? এইগুলি ভালো না। আর কখনো খেলবে না।
আচ্ছা।
নীতু আন্টিকে তুমি খুব পছন্দ করা?
হ্যাঁ।
তাকে আমার কথা কখনো বলবে না।
আচ্ছা।
আমি এখন চলে যাব।
আর আসবেন না?
আসব। শরিফাকে শাস্তি দেবার জন্য অ্যাসিব। ওকে আমি কঠিন শাস্তি দেব।
একটা ব্যাপার। আপনাকে বলি যে ছোট মা আমার কাছে আসতেন এই ছোট মা সেরকম নন। তার চোখের দৃষ্টি কঠিন, গলার স্বর কঠিন। অথচ আগে যিনি আসতেনতিনি ছিলেন আলাভোলা ধরনের। তাঁর মধ্যে ছিল অস্বাভাবিক মমতা। তিনি এসেই আমার মাথায় হাত দিতেন—অথচ ইনি দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। একবারও মাথায় হাত দিলেন না বা কাছেও এলেন না।
নিচে গাড়ির শব্দ হল। ছোট মা পরদা সরিয়ে বের হয়ে গেলেন। নীতু আন্টি তার কিছুক্ষণ পরই ঘরে ঢুকলেন। আমি জানি তিনি এখন কী করবেন-বিয়েবাড়িতে মজার ঘটনা কী কী ঘটল তা বলবেন। বলতে বলতে হেসে ভেঙে পড়বেন। যেসব ঘটনা বলতে বলতে তিনি হেসে গড়িয়ে পড়েন সাধারণত সেসব ঘটনা তেমন হাসির হয় না। তবু আমি তীকে খুশি করার জন্যে হাসি। আজ অন্যান্য দিনের মতো হল না। ঘরে ঢুকেই তিনি ভুরু কুঁচকে ফেললেন–তার হাসি হাসি মুখ হঠাৎ করে গভীর হয়ে গেল। তিনি শীতল গলায় বললেন, এই মেয়ে কেউ কি এসেছিল?