নীতু আন্টির মধ্যেও এই ব্যাপার ছিল। ভালবাসার প্রকাশকে তিনিও দুর্বলতা মনে করতেন। তার প্রধান চেষ্টা ছিল কেউ যেন তাঁর দুর্বলতা ধরে না ফেলে। তিনি শুরু থেকেই আমাকে পছন্দ করতেন। কিন্তু তাঁর দুর্বলতা আমি যেন ধরতে না পারি এটা নিয়ে সব সময় অস্থির থাকতেন।
আঁর সঙ্গে প্রথম দেখার গল্পটা শুনুন। আমি শুয়ে আছি। ঘুমাচ্ছি। হঠাৎ ঘুম ভাঙল। দেখি কে একজন আমার চুলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথম তাকলাম ছোট মা। তারপরই মনে হল, না ছোট মা না-ইনার গায়ের গন্ধ অন্যরকম। বেলি ফুলের গন্ধের মতো গান্ধ! আমি চোখ মেললাম। তিনি হাত সরিয়ে নিয়ে শুকনো গলায় বললেন, ঘুম ভাঙিয়ে ফেললাম?
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। তিনি আমার পাশে বসতে বসতে বললেন, শোন মেয়ে আমি এখন থেকে তোমাদের বাড়িতে থাকব। তোমার বাবার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। আমি তাকিয়ে রইলাম। কিছু বললাম না। তিনি আগের মতোই শুকনো গলায় বললেন, তুমি তো ইতিমধ্যে দুজনকে মা ডেকে ফেলছি। আমাকে মা ডাকার দরকার নেই। আমাকে আন্টি ডাকতে পার। অসুবিধা নেই। আমার নাম নীতা। তুমি ইচ্ছে করলে নীতু আন্টিও ডাকতে পার।
জি আচ্ছা।
ঘর এত নোংরা কেন? চারদিকে খেলনা। কাল সকালেই ঘর পরিষ্কার করবে।
জি আচ্ছা।
শোবার ঘরে স্যান্ডেল কেন? স্যান্ডেল থাকবে শোবার ঘরের বাইরে। শোবার ঘরটা থাকবে ঝকঝকে তকতকে, একদানা বালিও সেখানে থাকবে না। বুঝতে পারছ?
জি।
এখন থেকে শোবার আগে চুল বেঁধে শোবে। এতদিন তো চুল বাঁধার কেউ ছিল না। এখন থেকে আমি বেঁধে দেব। আরেকটা কথা শুনে রাখ-আমি কিন্তু আহাদ পছন্দ করি না। আমার সাথে কখনো আহ্লাদী করবে না। না ডাকলে আমাকে এসে বিরক্ত করবে না। মনে থাকবে?
থাকবে।
বাহ্, তোমার চুল তো খুব সুন্দর। সিল্কি চুল।
এই বলে তিনি আমার মাথার চুল নিয়ে খেলা করতে লাগলেন। আমি তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেললাম-ইনি চমৎকার একজন মহিলা। ইনার সঙ্গে সব রকম আহাদ করা যাবে। এবং আহ্বাদ করলেও তিনি রাগ করবেন না। আমি আরো বুঝলাম। এই মহিলার ভেতরও অনেক ধরনের আহ্রদীপনা আছে।
নীতু আন্টি খুব সুন্দর ছিলেন। তাঁর মুখ ছিল গোলাকার। চোখ বড় বড়। তবে বেশিরভাগ সময়ই চোখ ছোট করে ভুরু কুঁচকে তাকাতেন। ভাবটা এরকম যে তিনি খুব বিরক্ত হচ্ছেন।
তিনি বাড়িতে এসেই বাড়ির কিছু নিয়মকানুন পাল্টে দিলেন-যেমন আগে একতলা থেকে কাজের মানুষরা কেউ দোতলায় আসতে পারত না! এখন থেকে পারবে। শুধু যে পারবে তাই না–একটা কাজের মেয়ে রাখা হল, যার একমাত্র কাজ আমার ঘর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা এবং রাতে আমার ঘরেই ঘুমানো। তার জন্যে একটা ক্যাম্প খাটের ব্যবস্থা করা হল। সে ঘুমাতে যাবার আগে আগে আমার শোবার ঘরে সেই ক্যাম্প খাট পাতা হত। কাজের মেয়েটার নাম শরিফ। পনের-ষোল বছর বয়স। ভারী শরীর। দেখতে খুব মায়া-কাড়া। তার ছিল কথা বলা রোগ। অন্যদের সামনে সে চুপ করে থাকত। রাতে ঘুমাতে যাবার সময় যখন আমি ছাড়া আর কেউ থাকত না তখন সে শুরু করত। গল্প। ভয়ঙ্কর সব গল্প সে অবলীলায় বলত। গল্প শেষ করে সে নিৰ্বিকার ভঙ্গিতে ঘুমাতে যেত। বাকি রাতটা আমার ঘুম হত না।
ভয়ঙ্কর গল্পগুলি কী আপনি নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছেন। আপনার ধারণা ভয়ঙ্কর গল্প মানে ভূতপ্রেতের গল্প। আসলে তা না। ভয়ঙ্কর গল্প মানে নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের গল্প। আমার কাছে ভয়ঙ্কর লাগত। কারণ এই ব্যাপারটা অস্পষ্টভাবে জানতাম। আমার কাছে তা নোংরা, অরুচিকর এবং কুৎসিত মনে হত। আমি শরিফার গল্পের একটা নমুনা দিচ্ছি। আপনি আমার মানসিক অবস্থা ধরার চেষ্টা করছেন বলেই দিচ্ছি। অন্য কাউকে এ ধরনের গল্প আমি কখনো বলব না। আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। শরিফার যে গল্পটি আমি বলছি তা হচ্ছে তার কাছ থেকে শোনা সবচে ভদ্র গল্প। আমি শরিফার ভাষাতেই ঘলার চেষ্টা করি।
বুঝছেন আফা–আমরা তো গরিব মানুষ-আমরার গোরামের বাড়িত টাট্টিখানা নাই। টাট্টিখানা বুঝেন আফা? পাইখানারে আমরা কই টাট্টিখানা। উজান দেশে কয় টাট্টি কয়। তখন সইন্ধ্যা রাইত–আমার ধরছে পেসাব। বাড়ির পিছনে রওনা হইছি। হঠাৎ কে জানি আমার মুখ চাইপ্যা ধরছে। চিকুর দিমু হেই উপায় নাই। আন্ধাইরে পরিষ্কার কিছু দেখা যায় না। খালি বুজতাছি দুইটা গুণ্ডা কিসিমের লোক আমারে টাইন্যা লইয়া যাইতাছে। আমি ছাড়া পাওনের জন্যে হাত পাও মুচড়াইতাছি। কোনো লাভ নাই। এরা আমারে নিয়া গেল ইস্কুল ঘরে। এরার মতলবটা তো আফা, আমি বুঝতে পারতাছি। আমার কইলজা গেছে শুকাইয়া। এক মনে দোয়া ইউনুস পড়তাছি। এর মধ্যে ওরা আমারে শুয়াইয়া ফেলছে। একজনে টান দিয়া শাড়ি খুইল্যা ফেলছে ……….
গল্পের বাকি অংশ আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। আপনি অনুমান করে নিন। এ জাতীয় গল্প রোজ রাতে আমি শুনতাম। আমার শরীর ঝিমঝিম করত। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অনুভূতি। যার সঙ্গে আমি পরিচিত না। তখন আমার বয়স-মাত্র তের।
মিসির আলি সাহেব, শরিফার গল্প শোনার জন্যে আমি অপেক্ষা করতাম। ভয়ঙ্কর ভালো লাগত। আপনি লক্ষ করুন আমি ভালো শব্দের আগে ভয়ঙ্কর বিশেষণ ব্যবহার করেছি।
নীতু আন্টিও আমাকে গল্প বলতেন। সুন্দর সুন্দর সব গল্প। তার কিশোরী বয়সের সব গল্প। একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ হয়েছেন। চাচাতো বোন ভাই সব মিলিয়ে বাড়িতে অনেকগুলি মানুষ। সারা দিন কোথাও না কোথাও মজার কিছু হচ্ছে। নীতু আন্টির এক বোন আবার প্ল্যানচেট করা জানত। সে রোজই আত্মা নিয়ে আসত। বিখ্যাত ব্যক্তিদের আত্মা-রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্ৰ, শেকসপীয়র, আইনষ্টাইন, এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আসতেন খুব ঘন ঘন। প্ল্যানচেট করলেই তিনি চলে আসতেন। দু লাইন, চার লাইনের কবিতা লিখে যেতেন। সেসব কবিতা খুব উচ্চমানের হত না। কে জানে কবিরা হয়তো মৃত্যুর পর তাদের কাব্যশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ওনার লেখা একটা কবিতার নমুনা