উত্তরও কোথাও দেয়া নেই। মেয়েটির সঙ্গে দেখা হলেই উত্তরটা জানা যাবে। দেখা হবার সম্ভাবনা কতটুকু? এখনো তেমন কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না। কারণ মেয়েটিকে খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টা তিনি করছেন না। বয়সের কারণে তাঁর ভেতর এক ধরনের আলস্য কাজ করা শুরু করেছে। আশপাশের জগৎ সম্পর্কে উৎসাহ কমে যাচ্ছে। লক্ষণ খুব খারাপ।
আত্মার মৃত্যু হলেই এ জাতীয় ঘটনা ঘটে। কোনো কিছুই মনকে আকৃষ্ট করে না। আত্মার মৃত্যু হয়েছে কি হয় নি তা বের করার একটা সহজ পদ্ধতির কথা তিনি জানেন। বৃষ্টি কেটে যাবার পর আকাশে যখন রঙধনু ওঠে সেই রঙধনুর দিকে তাকিয়ে যে চোখ নামিয়ে নেয় এবং দ্বিতীয়বার তাকায় না, তার আত্মার মৃত্যু হয়েছে। আকাশে রঙধনু না উঠলে তিনি তাঁর আত্মার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না।
মৃত আত্মাকে জীবনদান করারও কিছু পদ্ধতি আছে। সবচে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে শিশুদের সঙ্গে মেশা। শিশুরা সব সময় তাদের আশপাশের মানুষদের তাদের আত্মা থেকে খানিকটা ধার দেয়।
সমস্যা হচ্ছে শিশুদের মিসির আলি তেমন পছন্দ করেন না। এদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতেই তাঁর ভালো লাগে। শিশুরা সুন্দর-অসম্ভব সুন্দর। যে কোনো বড় সৌন্দর্যকে দেখতে হয় দূর থেকে। যত দূর থেকে দেখা যায় ততই ভালো। কুৎসিত জিনিস দেখতে হয় কাছ থেকে, সুন্দর জিনিস দূর থেকে। এটা যেন কার কথা? মিসির আলি মনে করতে পারলেন না। তাঁর স্মৃতিশক্তি কি দুর্বল হতে শুরু করেছে?
ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মস্তিষ্ক তার মেমোরি সেলে জমিয়ে রাখা স্মৃতি ফেলে দিয়ে সেলগুলি খালি করছে। মৃত্যুর ঠিক আগে আগে মেমোরি সেলে কোনো মেমোরি থাকে না। মস্তিষ্ক সব ফেলে দিয়ে ঘর খালি করে দেয়।
মিসির আলি ঘুমাতে গেলেন রাত দশটায়। ইদানীং তিনি খুব নিয়মকানুন মেনে চলার চেষ্টা করছেন। যেমন রাত দশটা বাজতেই ঘুমাতে যাওয়া। সকালবেলা মর্নিং ওয়াক। ঘড়ি ধরে কাজ করার চেষ্টা। রাত দশটায় ঘুমাতে গেলেও লাভ হচ্ছে না-ঘুম আসতে আসতে তিনটা বেজে যাচ্ছে। দশটা থেকে রাত তিনটা এই পাঁচ ঘণ্টা মস্তিষ্ককে পুরোপুরি নিস্ক্রিয় রাখা সম্ভব না। মিসির আলি সেই চেষ্টা করেনও না। তিনি শুয়ে শুয়ে ফারজানা মেয়েটিকে নিয়েই ভাবেন।
মেয়েটি স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগী! সে তা জানে না। অধিকাংশ স্কিজোফ্ৰেনিয়াকই তা জানে না। তারা ভেবে নেয়—তাদের দেখা জগৎই সত্যি জগৎ। অন্যদের জগৎ ভ্রান্তিময়। তাদের একটা যুক্তি অবশ্যই আছে। কালার ব্লাইন্ড একজন মানুষ সবুজ রঙ দেখতে পায় না। তার জগতে সবুজের অস্তিত্ব নেই। সে বলবে পৃথিবীতে সবুজ রঙ নেই। তার কাছে এটাই সত্যি। তার সেই জগৎ মিথ্যা নয়।
মিসির আলি জেগে আছেন–তাঁর মাথায় ফারজানা মেয়েটি নেই। তাঁর মাথায় ঘুরছে। কোন প্রাণীর লেজের সংখ্যা দুই। তার হঠাৎ মনে হল ফারজানা মেয়েটি ইচ্ছে করে তাঁর মাথায় এই ধাঁধাটি ঢুকিয়ে দিয়েছে। ধাঁধার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত এটা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকবে। মেয়েটি এই ব্যাপার জানে। স্কিজোফ্রেনিয়াকরা খুব বুদ্ধিমান হয়ে থাকে। তারা নিজেরা বিভ্ৰান্তির জগতে বাস করে বলেই হয়তো অন্যদের বিভ্ৰান্তিতে ফেলে আনন্দ পায়। মিসির আলির মাথা দপদপ করছে। রেলগাড়িতে চড়লে যেমন কিছুক্ষণ পরপর শব্দ হয়—তাঁর মাথার ভিতর ঠিক সেরকম খানিকক্ষণ পরপর প্রশ্ন উঠছে–
কোন প্রাণীর দুটা লেজ?
কোন প্রাণীর দুটা লেজ?
নাস্তা খেয়ে লিখতে বসেছি
এখন বাজছে সকাল ১১টা। কিছুক্ষণ আগে আমি নাস্তা খেয়ে লিখতে বসেছি। সকালের চা এখনো খাওয়া হয় নি। চা দিয়ে গেছে। চায়ের কাপ থেকে ধোয়া উড়ছে। আমার চায়ের কাপের ধোঁয়া দেখতে খুব ভালো লাগে। মিসির আলি সাহেব আপনার কি চায়ের কাপের ধোঁয়া দেখতে ভালো লাগে? মানুষের ভালোলাগাগুলি একরকম হয় না কেন বলুন তো? মানুষকে তো নানান ভাবে ভাগ করা হয়। তাদের ভালোলাগা, মন্দলাগা নিয়ে তাদের ভাগ করা হয় না কেন? আপনারা সাইকিয়াট্রিস্টরা সেরকম ভাগ করতে পারেন না?
যেমন ধরুন যেসব মানুষ–
ক) চায়ের কাপের ধোঁয়া ভালবাসেন।
খ) বেলি ফুলের গন্ধ ভালবাসেন।
গ) চাপা রঙ ভালবাসেন।
তাদের মানসিকতা এক ধরনের। (আমার মত।) তাদের চিন্তাভাবনায় খুব মিল থাকবে।
আচ্ছা আপনি কি আমার জ্ঞানী টাইপ কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছেন?
থাক। আর বিরক্ত হতে হবে না, এখন আমি মূল গল্পে ফিরে যাই। এখন যে চ্যাপ্টারটা বলব। সেই চ্যাপ্টারের নাম—নীতু আন্টি।
আমি ঘুমাচ্ছিলাম-রাত দশটাটশটা হবে। আমার ঘরের দরজা খোলা। ছোট মানুষ তো। কাজেই দরজা খোলা থাকত। যাতে রাতে-বিরাতে বাবা এসে আমাকে দেখে যেতে পারতেন। এই কাজটা বাবা করতেন-রাতে খুব কম করে হলেও দুবার এসে দেখে যেতেন। তখন ঘুম ভেঙে গেলেও আমি ঘুমিয়ে থাকার ভান করতাম। কারণ কী জানেন? কারণ হচ্ছে আমি যখন জেগে থাকতাম তখন বাবা আমাকে আদর করতেন না। ঘুমন্ত অবস্থাতেই শুধু আদর করতেন। মাথার চুলে বিলি কেটে দিতেন। হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করতেন। এমনকি মাঝে মাঝে ঘুমপাড়ানি গানও গাইতেন। যদিও আমি তখন বড় হয়ে গেছি। ঘুমপাড়ানি গান শোনার কাল শেষ হয়েছে। ঘুমন্ত মানুষকে গান শুনানোখুব মজার ব্যাপার না? আমার বাবা আসলেই বেশ মজার মানুষ। ভালবাসার প্রকাশকে তিনি দুর্বলতা বলে ভাবেন। (আরেকটা ব্যাপারও হতে পারে, বাবা হয়তো আমাকে ভালবাসতেন না। ভালবাসার ভান করতেন। মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে ভান করা যায় না বলেই আমি যখন ঘুমাতাম তখন ভান করতেন।)