মিসির তার খাতায় গুটিগুটি করে লিখলেন-ফারজানা মেয়েটি শারীরিকভাবে সুস্থ।
তিনি আরেকটি কাজও করলেন-ফারজানার এক শ পৃষ্ঠার কোন অংশগুলি দিনে লেখা হয়েছে-কোন অংশগুলি রাতে লেখা হয়েছে–তা হলুদ মার্কার দিয়ে আলাদা করলেন। কাজটা জটিল মনে হলেও আসলে সহজ। ব্লাতে আলো কমে যায় বলে রাতের লেখায় অক্ষরগুলি সামান্য বড় হয়। এবং লেখা স্পষ্ট করার জন্যে কলমে চাপ দিয়ে লেখা হয়। দিনের লেখা এবং রাতের লেখা আলাদা করার তেমন কোনো কারণ নেই। তারপরেও করে রাখা-হঠাৎ যদি এর ভেতর থেকে কিছু বের হয়ে আসে। খড়ের গাদায় হারিয়ে যাওয়া সুচও পাওয়া যায়। যদি ধৈর্য ধরে প্রতিটি খড়ু-একটি একটি করে আলাদা করা হয়। মিসির আলি তাঁর অনুসন্ধানে ইনটিউশন যত না ব্যবহার করেন-পরিশ্রম তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যবহার করেন।
ছোট মা
ছোট মাকে আমি দেখতে শুরু করলাম। প্রথম প্রথম দু দিন, তিন দিন পরপর হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্যে দেখা যেত। তারপর রোজা-ই দেখতে পেতাম।
শুরুতে তিনি আমার সঙ্গে কোনো কথা বলতেন না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপচাপ শুনতেন। তারপর কথা বলা শুরু করলেন। কথা বলতেন। ফিসফিস করে। কোথাও কোনো শব্দ হলে দারুণ চমকে উঠতেন।
হয়তো বাতাসে দরজা নড়ে উঠল-সেই শব্দে মা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ছুটে চলে গেলেন পর্দার আড়ালে। ছোট মারা দেখা পাওয়াটা ঠিক স্বাভাবিক ধ্যাপার না এটা আমার বোধের ভেতর ছিল। আমি এর বাইরেও কিছু কিছু ব্যাপার লক্ষ করলাম। যেমন ছোট মা কখনো কিছু খান না। আমি কমলা সেধেছি। প্লেট থেকে কেক তুলে দিয়েছি। তিনি কখনো কিছুমুখে দেন নি। তিনি যখন আশপাশে থাকতেন তখন আমি এক ধরনের গন্ধ পেতাম। মিষ্টি গন্ধ, তবে ফুলের গন্ধ না। ওষুধ ওষুধ গন্ধ!
আসল ছোট মার সঙ্গে এই মায়ের কিছু অমিলও ছিল। যেমন ছোট মা আমাকে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত নামে ডাকতেন। ইনি ডাকতেন না। একদিন আমি নিজেই বললাম, তুমি ওই নামগুলি বল না। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন নাম? তা থেকে বুঝলাম নামগুলি তিনি জানেন না।
ছোটরাও নিজেদের মতো করে কিছু পরীক্ষাটরীক্ষা করে। আমিও ছোট মাকে নিয়ে কিছু পরীক্ষা করলাম-যেমন একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?
ছোট মা বললেন, জানি না তো।
আমি বললাম, সত্যি জান না?
তিনি বললেন, না। আমার কী নাম?
আমি বললাম, তোমার নাম চাপা।
তিনি খুবই অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি? আমার সামান্য খটকা লাগলেও আমি নিৰ্বিকার ছিলাম। একজন খেলার সাখী পেয়েছি, এই আমার জন্যে যথেষ্ট ছিল।
ছোট মা খেলার সঙ্গী হিসেবে চমৎকার ছিলেন। যা বলা হত। তাই ক্লোবটের মতো করতেন। কোনো প্রশ্ন করতেন না! মাদের ভেতর খবরদারির একটা ব্যাপার থাকে। ওনার ভেতর তা ছিল না।
পায়ে মোজা নেই কেন?
ঘর নোংরা করছি কেন?
ঘুমাতে যাচ্ছ না কেন?
এ জাতীয় প্রশ্ন করে তিনি আমাকে কখনো বিব্রত করতেন না। আমার বেশ কজন টিচার ছিলেন। পড়ার টিচার, গানের টিচার, নাচের টিচার। তাঁরা যখন আসতেন–নিচ থেকে ইন্টারকমে আমাকে বলা হত। আমি নিচে যাবার জন্যে তৈরি হতাম। মাকে সেই সময় খুব বিব্রত মনে হত। তিনি যেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। কী করবেন। তাঁকে খুব কাঁদতেও দেখতাম। দু হাতে মুখ ঢেকে খুনখুন করে কাঁদতেন। চোখ দিয়ে তখন অবিশ্যি পানি পড়ত না। তাঁর কান্না সব সময় ছিল অশ্রুবিহীন!
মিসির আলি সাহেব। আপনি আমার সামনে নেই বলে আপনার নিশ্চয়ই অসুবিধা হচ্ছে। হয়তো আপনার মনে অনেক প্রশ্ন উঠে আসছে, কিন্তু আপনি প্রশ্নগুলি করতে পারছেন না। সামনাসামনি থাকলে প্রশ্ন করতে পারতেন। আর আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না…-কোনো ডিটেল বাদ পড়ে যাচ্ছে কি না। গুরুত্বহীন মনে করে আমি হয়তো অনেক কিছু লিখছি না-যা আপনার কাছে মোটেই গুরুত্বহীন না। তবু আপনার মনে সম্ভাব্য যেসব প্রশ্ন আসছে বলে আমার ধারণা-আমি তার জবাব দিচ্ছি।
প্রশ্ন : উনার গায়ে কী পোশাক থাকত?
উত্তর : সাধারণ পোশাক শাড়ি। যেসব শাড়ি আগে পরতেন। সেইসব শাড়ি।
প্রশ্ন। উনি কি হঠাৎ উপস্থিত হতেন এবং পরে বাতাসে মিলিয়ে যেতেন?
উত্তর : না। কখনো হঠাৎ উদয় হতেন না। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেন। বের হয়ে যাবার সময়ও দরজা খুলে বের হয়ে যেতেন। তাঁর পুরো ব্যাপারটাই খুব স্বাভাবিক ছিল। আঁকে আমি কখনো শূন্যে ভাসতে দেখি নি–কিংবা লম্বা একটা হাত বের করে দূর থেকে কিছু আনতে দেখি নি।
প্রশ্ন। তুমি নিশ্চিত যে উনি তোমার ছোট মা?
উত্তর : জি নিশ্চিত। তবে আগেই তো বলেছি–আমার চেনা ছোট মারি সঙ্গে তার কিছু অমিল ছিল-যেমন তিনি পড়তে পারতেন না। অথচ ছোট মা আমাকে রোজ রাতে গল্পের বই পড়ে শুনাতেন। কাজেই আমি একদিন উনাকে গল্পের বই পড়ে শুনাতে বললাম। তিনি লজ্জিত গলায় বললেন যে তিনি বই পড়তে জানেন না। তিনি আমাকে বই পড়া শেখাতে বললেন।
প্রশ্ন : তুমি তাকে বই পড়া শেখালে?
উত্তর : জি। উনি খুব দ্রুত শিখে গেলেন।
প্রশ্ন : উনি কি তোমার জন্যে কখনো কোনো উপহার নিয়ে এসেছেন?
উত্তর : জি এনেছেন।
প্রশ্ন : কী উপহার?
উত্তর : সেটা আমি আপনাকে বলব না।
প্রশ্ন : তুমি ছাড়া আর কেউ কি উনাকে দেখেছে?
উত্তর : জি না।
প্রশ্ন : তাকে দিনে বেশি দেখা যেত, না রাতে?
উত্তর : দিন রাত কোনো ব্যাপার ছিল না।
প্রশ্ন : সব সময়ই কি একই কাপড় পরা থাকতেন?