- বইয়ের নামঃ তন্দ্রাবিলাস
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ অন্বেষা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, দর্শন, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
ভোরবেলায় মানুষের মেজাজ
ভোরবেলায় মানুষের মেজাজ মোটামুটি ভালো থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খারাপ হতে থাকে, বিকালবেলায় মেজাজ সবচে বেশি খারাপ হয়, সন্ধ্যার পর আবার ভালো হতে থাকে। এটাই সাধারণ নিয়ম।
এখন সকাল এগারটা, মেজাজের সাধারণ সূত্র মতে মিসির আলির মেজাজ ভালো থাকার কথা। কিন্তু মিসির আলির মন এই মুহুর্তে যথেষ্টই খারাপ। তিনি বসার ঘরে বেতের চেয়ারে পা তুলে বসে আছেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে আছে। তাঁর মেজাজ খারাপের দুটি কারণের প্রথমটা হল–একটা মাছি। অনেকক্ষণ থেকেই মাছিটা তার গায়ে বসার চেষ্টা করছে। সাধারণ মাছি না-নীল রঙের স্বাস্থ্যবান ডুমে মাছি। আম-কঁঠালের সময় এই মাছিগুলিকে দেখা যায়। এখন শীতকাল-এই মাছি এল কেথেকে? মাছিটা তার গায়েই বারবার বসতে চাচ্ছে কেন? তার সামনে বসে থাকা মেয়েটির গায়ে কেন বসছে না?
মিসির আলির মেজাজ খারাপের দ্বিতীয় কারণ এই মেয়েটি। তার ইচ্ছা করছে। মেয়েটিকে একটা ধমক দেন। যদিও ধমক দেবার মতো কোনো কারণ ঘটেনি। মেয়েটি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। দেখা করতে আসার অপরাধে কাউকে ধমক দেয়া যায়। না। ধমক দেয়ার বদলে মিসির আলি শব্দ করে কাশলেন। প্রচণ্ড শব্দে কাশলে, কিংবা কুৎসিত শব্দে নাক ঝাড়লে মনের রাগ অনেকখানি কমে। মিসির আলির কমল না। বরং আরো যেন বাড়ল। মাছিটাও মনে হচ্ছে এই শব্দে উৎসাহ পেয়েছে। এতক্ষণ গায়ে বসতে চাচ্ছিল এখন উড়ে ঠোঁটে বসতে চাচ্ছে। কী যন্ত্রণা!
স্যার, আমার নাম সায়রা বানু। সায়রা বানু নামটা কি আপনার মনে থাকবে?
মিসির আলি বললেন, মনে থাকার প্রয়োজন কি আছে?
অবশ্যই আছে; আমি এত আগ্রহ করে আমার নামটা আপনাকে কেন বলছি, যাতে মনে থাকে সেই জন্যেই তো বলছি।
মিসির আলি রোবটের গলায় বললেন, মানুষের নাম আমার মনে থাকে না।
মেয়েটি তার রোবট গলা অগ্রাহ্য করে হাসিমুখে বলল, আমারটা মনে থাকবে। কারণ একজন বিখ্যাত সিনেমা অভিনেত্রীর নাম সায়রা বানু।
মিসির আলি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। এখন তাঁর মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। অর্থহীন কথা শুনতে ভালো লাগছে না। তা ছাড়া শীতও লাগছে। চেয়ারটা টেনে রোদে নিয়ে গেলে হয়। তাতে কিছুক্ষণ আরাম লাগবে তারপর আবার রোদে গা চিড়বিড় করতে থাকবে। শীতকালের এই এক যন্ত্রণা। ছায়া বা রোদ কোনোটাই ভালো লাগে। না। মিসির আলি মাছিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাছিটার কারণে নিজেকে এখন কাঁঠাল মনে হচ্ছে।
মেয়েটি খানিকটা মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আপনি দিলীপ কুমার, সায়রা বানু এদের নাম শোনেন নি?
দিলীপ কুমারের নাম শুনেছি।
সায়রা বানু হচ্ছে দিলীপ কুমারের বউ; আমার বন্ধুরা অবিশ্যি আমাকে সায়রা বানু। ডাকে না, তারা ডাকে এস বি। সায়রার এস, বানুর বি-এস বি! এস বি-তে আর কী হয় বলুন তো?
বলতে পারছি না।।
এস বি হচ্ছে স্পেশাল ব্রাঞ্চ। আমার বন্ধুদের ধারণা আমার চেহারায় একটা স্পাই স্পাই ভাব আছে। এই জন্যেই তারা আমাকে এস বি ডাকে। আচ্ছা আপনারও কি ধারণা আমার চেহারায় স্পাই স্পাই ভাব? ভালো করে একটু আমার দিকে তাকান না। আপনি সারাক্ষণ এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন কেন?
মিসির আলি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন না। মাছিটার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাছিটা এদিক-ওদিক করছে বলেই এদিক-ওদিক তাকাতে হচ্ছে। আচ্ছা পৃথিবীতে মোট কত প্ৰজাতির মাছি আছে?
এই যে শুনুন। তোকান আমার দিকে।
মিসির আলি মেয়েটির দিকে তাকালেন। অতিরিক্ত ফর্সা একটি মেয়ে। বাঙালি মেয়েদের গায়ের রঙের একটা মাত্রা আছে। কোনো মেয়ে যদি সেই মাত্রা অতিক্রম করে। যায়। তখন আর ভালো লাগে না। তার মধ্যে বিদেশী বিদেশী ভাব চলে আসে। তাকে তখন আর আপন মনে হয় না। সায়রা বানুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাকে পর পর লাগছে। মেয়েটির মাথা ভরতি চুল। সেই চুলেও লালচে ভাৰ আছে। অতিরিক্ত ফর্সা মেয়েদের ক্ষেত্রে তাই হয়। তাদের গায়ের রঙের খানিকটা এসে চুলে লেগে যায়। চুল লালচে দেখায়-খানিকটা এসে লাগে চোখে। চোখ তখন আর কালো মনে হয় না। মেয়েটির মুখ লম্বাটে। একটু বেচা ধরনের নাক। বেঁচো নাক থাকায় রক্ষা-বেঁচো নাকের কারণেই মেয়েটিকে বাঙালি মনে হচ্ছে। খাড়া নাকি হলে মেডিটেরিনিয়ান সমুদ্রের পাশের গ্রিক কন্যা বলে মনে হত। বয়স কত হবে? উনিশ থেকে পঁচিশের তেতর। মানুষের বয়স চট করে ধরতে পারার কোনো পদ্ধতি থাকলে ভালো হত। গাছের রিং গুনে বয়স বলা যায়। মানুষের তেমন কিছু নেই। মানুষের বয়স তার মনে বলেই বোধ হয়। আচ্ছা, একটা মাছি কতদিন বাঁচে?
স্যার কথা বলছেন না কেন? আমাকে কি স্পাই মেয়ে বলে মনে হচ্ছে?
স্পাই মেয়েদের চেহারা আলাদা হয় বলে আমি জানি না।
একটু আলাদা হয়। স্পাই মেয়েদের মুখ দেখে এদের মনের ভাব বোঝা যায় না। এদের মুখে এক রকম ভাব মনের ভেতর আরেক রকম।
তোমারও কি তাই?
জি। ও আপনাকে বলতে ভুলে গেছি। এস বি ছাড়াও আমার আরেকটা নাম আছে! নাম ঠিক না খেতাব। নববর্ষে পাওয়া খেতাব। আমাদের কলেজে পহেলা বৈশাখে খেতাব দেয়া হয়। আমার খেতাবটা হচ্ছে সাদা বাঘিনী। এস বি-তে সাদা বাঘিনীও হয়। সাদা বাঘিনী টাইটেল কেন পেয়েছিলাম শুনতে চান? খুবই মজার গল্প।