হরিমোহন প্রতিবাদ করে নি। হাঁ, ঠিক, কাজী সাহেবের বড়ো বংশ, বড়ো খানদান, বড়ো ইজ্জত। মুসলমান হলেও হরিমোহনকে মেয়ে বিয়ে দেবার পথে অনেক বাধা। বাদবাকী কথা কানা আফজল মর্তমান কলার ঝাড়টার কাছে নিয়ে কানে কানে বলেছিলো। সে কথায়ও রাজী হয়েছিলো তার বাপ। হায় রে প্রেম! তারপর একদিন চাঁদনী রাতে কানা আফজলের সাক্ষাতে আধসের পাকা সোনা আর দু’হাজার মহারাণীর ছবি আঁকা রূপোর টাকা মেয়ে জরীনার দাম স্বরূপ কাজী রহমতের হাতে তুলে দিয়েছিলো। গোপনে… অত্যন্ত গোপনে। গোপনও সময়ের পরিশেষে দল-পাপড়ি মেলে। সে কাজী রহমতই নেই, কাজী বাড়ির দবদবা রবরবা এখন ধুলোয় লুণ্ঠিত তাদের ঘাড়ে পা রেখে কানা আফজলেরা মাথা তুলছে। কানা আফজল এখন আলহাজ্ব আফজল আহমদ চৌধুরী। মান্যগণ্য ব্যক্তি, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। চেহারাতে চেকনাই লেগেছে। পোষাকে রুচি ফিরেছে। কিন্তু স্বভাবটা ঠিক আগের মতো আছে।
তারপরে একদিন বাগিচার হাটের বড়ো মসজিদে গিয়ে ইমাম সৈয়দ সাহেবের হাতে হাত রেখে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়েছিলো। দশ গ্রামের মুসলমান তাকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে উঠেছিলো। বাজী পুড়িয়ে ইসলামের জয়ধ্বনি ঘোষণা করেছিলো। হিন্দু ধর্মের অসারতা নিয়ে জোড় বক্তৃতা দিয়েছিলো। গরু জবাই করে জেয়াফত দিয়েছিলো। ইচ্ছে ছিলো হিন্দুদের মাথা চির জীবনের জন্য হেঁট করে দেবে।
মৌলানা সাহ্বে শাদা ফ্যাড়ফ্যাড়ে দাড়ি নেড়ে নেড়ে হাজেরান মজলিশের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন উর্দু ভাষায়ঃ
“এসলাম জিন্দা হোতা হ্যয় হর কারবালা কি বাদ।” (প্রতি কারবালার পরেই ইসলাম ধর্ম নবজীবন পায়।)।
হরিমোহনের নতুন নামকরণ হলো মুহম্মদ ইসমাইল খান।
টাকা আর সোনা নেয়ার রাতে কাজী রহমত নিজের মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দেয়ার একটা তারিখও হরিমোহনকে দিয়েছিলো। নির্দিষ্ট তারিখেই পাশের গ্রামের শিকদার সাহেবের ছেলের সংগে জরীনার বিয়ে দিয়ে দিলো এবং সে দিনেই তার বাপের সংগে তার মা–মানে কাজী বাড়ির বাঁদির বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলো। কি চেয়েছিলো? আর হয়ে গেলো কি? মুসলমান হলো, মুসলমানি নাম নিলো, তবু কেন হরি ব্যান্যা ডাকতো তার বাপকে। তার মা বাঁদী। আর বাপ বেনে।
তার পরিচয় মুসলমানের কাছে ব্যানার পুত, হিন্দুদের কাছে কি তা জানার অবকাশ হয় নি। কারণ তারাও নৃশংস কম নয়। বাপের প্রতি সমবেদনায় মনটা তার মেদুর হয়ে যায়। লোকটা সারা জীবন ধরে যে মানসিক নির্যাতন সহ্য করেছে তার কি কোনো তুলনা আছে?
ফুলশয্যার রাতে গলায় বেনারসী শাড়ী দিয়ে, দড়ি পাকিয়ে ফাঁসি দিয়ে আত্নহত্যা করেছিলো জরীনা। সে অব্যক্ত বেদনার গুরুভারও তার বাপকে বইতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, কাজী বাড়ীর দাসী বিয়ে করে দাস হিসেবে জিন্দেগী কাটাতে হয়েছে। সন্তান জন্ম দিতে হয়েছে। নির্মম নিষ্ঠুরতার আঘাতে প্রতি পলে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া জীবন তার বাপের। বান্যা পুকুরের বটগাছে লটকানো তেজেনদার চোখের জিজ্ঞাসার ছুরি তার বাপের মর্মে আমুল বিঁধে গিয়েছিলো যেনো। একবার আহা করবার সুযোগও পায়নি। অতীতের ছায়ামূর্তিগুলো তার সামনে নির্দিষ্ট গতিপথে নিজের নিজের ভঙ্গীতে প্যারেড করে যেন চলে গেলো। সকলে মিলে তার জীবনের যে গতিপথ নির্দিষ্ট করেছে, সে পথেই তাকে আমরণ হাঁটতে হবে। নির্দিষ্ট গন্ডী ভেদ করে কোনদিন সে উদার আকাশের তলায় এসে দাঁড়াতে পারবে না। নিজের অস্তিত্বের চারপাশে দেয়ালের মতো নিরেট কঠিন বাধা অনুভব করে। হাজার আঘাতেও পথ দেবে না।
মনের গভীরে সঙ্গোপনে ক্ষীণ স্পষ্ট একটি আলোক শিখা জেগে ওঠে। এই চেতনাই তার হাতিয়ার। এরই আলোকে পথ দেখে দেখে অত্যাচার অবিচার সয়ে সয়ে সে এতো বড়ো হয়েছে। হাসিম স্পষ্ট দেখতে পায়, মানুষের নীচতা, ক্ষুদ্রতা আর ভণ্ডামীর সীমা কতদূর। নিজেকে সময় নির্যাতিত মানব জাতির প্রতীক বলে মনে হয়। চেতনার শিখা আরো প্রোজ্জ্বল, সন্ধানী রশ্মি আরো তীক্ষ্ণতর হয়। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো শৃঙ্খলকে চোখের সামনে তুলে ধরে। নিজের অস্তিত্বের চার পাশের দেয়ালটাকে আরো স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। শরীর উত্তেজনায় আন্দোলিত হয়, মাথায় ছলাৎ ছলাৎ রক্ত ওঠে। সে চিৎকার করে ওঠে।
“এই দেয়াল আঁই ভাইঙ্গম”
এই দেয়াল ভাঙবো আমি।
উত্তেজনার মুহূর্তে জখমো পা’টাতে টান লেগে ব্যথিত হয়ে ওঠে সারা শরীর। মা গো! বলে বলে অস্ফুটে চীৎকার করে। পৃথিবীতে কোনো কিছু, কোনো বাদ্যযন্ত্র কোনো সুর সে যাতনাকে ধরতে পারবে না। সুফিয়া ছুটে আসে তাড়াতাড়ি। পায়ের পট্টি বদলায়। বাটা ঔষধের প্রলেপ লাগায়। হাসিম চুপচাপ মরার মতো নিঃশব্দে পড়ে থাকে।
দীর্ঘ আটদিন পরে বিষ্টি থামলো। আকাশে সোনার বরণ রোদ হেসেছে। বিকেল বেলা। উঠানের কাঁঠাল গাছটিতে দুটি চড়ুই পাখি কিচিরমিচির ডাকছে। হাসিম এক পায়ে ভর করে কোনো রকমে দাওয়ায় এসে মাদুরের উপর বসে। সূর্যের গালানো সোনা দু’চোখে পান করে মনের অলিগলি খুশিতে ভরে ওঠে। মনের ভেতর আলোর ঝরনা বয়ে যাচ্ছে… তার ভাষা নেই কোনো। প্রকৃতির সঙ্গে মনের এ সংযোগ কতো সহজ, কতো স্বাভাবিক। মনে মনে এর একটা অর্থ খুঁজতে চেষ্টা করে। এই যে আকাশ, এই যে গাছপালা, এই যে সূর্য কেমন প্রিয় বন্ধুর মতো তার সমগ্র সত্তা নিবিড় মেহের আবরণে পরম মমতায় আচ্ছাদিত করে রেখেছে।