বৃষ্টি অবিরাম ঝরছে। উপায় নেই চোখ মেলবার। হাসিমের সেদিন বাশ কাটার পাশ ছিলো না। ফরেস্টারের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে ঘুরতি পথে আসছিলো। থমথমে গুমোট আকাশে বিরাম-বিহীন বিষ্টি। বনের ভেতর শ্বাপদের থাবার মতো সন্ধ্যা নামছিলো। তাড়াতাড়ি হাঁটছিলো হাসিম। চড়াই বেয়ে নামতে গিয়ে হাত দেড়েক লম্বা কাটা বাঁশের চোখা একটি ফালি তার পায়ের তলা দিয়ে সেঁধিয়ে পাতার ওপর দিয়ে বেরিয়ে আসে। উঃ করে বসে পড়ে! কাঁধ থেকে কাঁচা বাঁশের ভারটা সটকে পড়ে। চিরকি দিয়ে ছোটে রক্ত। ফিনকি দিয়ে প্রবাহিত হয়। টকটকে, লাল তাজা রক্ত। জীবনের জীবনী রস। হাসিমের মাথা ঘুরতে থাকে। এ দৃশ্য দেখতে পারে না চোখ দিয়ে। কোমরের গামছা খুললো। দু’হাতে শরীরের সমগ্র শক্তি জড়ো করে হেঁচকা টানে বিধে যাওয়া ফালিটি বের করে নিয়ে আসে। তারপর কিছু লতাপাতার রস চিপে গামছাতে কষে ক্ষতস্থান বেঁধে পাথুরে পথ রক্তে রাঙিয়ে চলে এসেছিলো। কেমন করে চলে এসেছিলো সে কথা হাসিম বলতে পারেনা। ঘরের কাছে এসে দেখে বরগুইনিতে কুলফাটা ঢল। আশ্চর্য জীবনীশক্তি, জীবনতৃষ্ণার তাগিদে সাঁতার কেটে এপাড়ে এসে ঢলে পরছিলো। তার পর আর জানে না। জ্ঞান ফিরেনি তিন দিন।
চার দিনের দিন জ্ঞান ফিরলো। নড়তে চড়তে পারে না। সারা শরীরে ধান দিলে খৈ ফোঁটার মতো বেতাপ জ্বর। জখমী পা-টা ফুলে ঢোল হয়ে আছে। বেলা ভাটির দিকে জ্বর আসে। হাড় কাঁপানো জ্বর। সারারাত দুঃসহ যন্ত্রনায় কঁকায়। দিনের দিকে জ্বর ছেড়ে যায়। সুফিয়া অম্লান বদনে সেবা করে। পায়ের পট্টি বদলায়। গাছ গাছড়ার পাতা, মূল শেকড় পিষে ক্ষতস্থানে প্রলেপ লাগায়। সারাদিন বসে থাকে শয্যার পাশে। পায়ের ফুলাতে টোটকা ওষুধের প্রলেপ দেয়। মানকচু পাতা গরম করে সেঁক দেয়। বিষ্টি থামার নাম গন্ধ নেই। ঘরের শনের পচা চালের ফুটো দিয়ে জল ঝরছে। সমস্তটা আঙ্গিনা থিক থিকে কর্দমাক্ত হয়ে গেছে। ফাঁকা জয়গা কোথাও নেই। দু’চোখ বুজে বুক ভরা বেদনা আর শরীর ভরা ব্যথার গভীর আস্বাদ গ্রহন করে হাসিম। কলজে ধরে টান দেয় বেদনার শৃঙ্খল। এ সেই বেদনা শরীর থেকে আলাদা করে পাথরে ছেড়ে দিলে পাথর ক্ষয় করে ফেলবে। তেমনি গভীর, চোখা সর্বব্যাপ্ত বেদনা। চেতনার প্রতিভাসে আলোকিত হয় কতকিছু।
বাপের কথা মনে হয়। মার কথা। কাছের অতীত… দূরের অতীত আজ হাসিমের চেয়ে বড়ো বেশি দৃশ্যমান। স্মৃতির উৎস গভীর খুবই গভীর। প্রথম যে মানুষ তার জন্মের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে সংগ্রামী চেতনায় জন্ম নিয়েছিলো তার খবরও ধরে রেখেছে স্মৃতি।
হায় রে বাপ! গোকুল ধরের কনিষ্ঠ সন্তান। কোনদিন কী কুক্ষণে কাজী বাড়ির রহমত কাজীর মেয়ে জরিনাকে দেখে মজেছিলো! তার বাপের হিতাহিত, জাত বিচার ভুলিয়ে–দেয়া সুন্দরী নারী জরিনার একটি ছবি মনের ভিতরে খাড়া করতে চেষ্টা করে। জরিনা কি খুব সুন্দর ছিলো? তার চোখ দুটো কেমন ছিলো? সুন্দরী দেখেই কি তার বাপ পতঙ্গের মতো উড়ে এসেছিলো? শুধু কি সৌন্দর্য? নাকি আরো কিছু ছিলো? হয়তো ছিলো কিন্তু হাসিম কোনো দিন জরিনাকে দেখে নি।
বাঁশখালী থানার কালীপুর গ্রামে গোকুল ধরের কনিষ্ঠতম সন্তানের বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। বিয়ে করলো না তার বাপ। ছিটকে বেরিয়ে এলো। প্রেমের তাগিদে বেরিয়ে আসা জনকের স্মৃতিতে মনটা তার ফলভারে নত নম্র গাছের মতো নুয়ে আসে। তার বাপ হরিমোহনের সমাজ ছেড়ে বেরিয়ে আসার কাহিনী গ্রামে পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে আছে। সে কথা হাসিমের চেতনায় লজ্জা, দুঃখ, ক্ষোভের সহযোগে স্তরে স্তরে সঞ্চিত আছে।
কাজী রহমতের তখন বড়ো টাকা-পয়সার টানাটানি। ঘুষ-ঘাস খেয়ে, গাঁয়ে মামলা-মোকদ্দমা লাগিয়ে শরাফতির ভড়ং বজায় রেখে কোনো রকমে চালাচ্ছিলো দিন। চরিত্রের বলিষ্ঠতা, প্রতিপত্তির ব্যঞ্জনা মরে গেছে সে কতোকাল আগে। যতো রকমে সম্ভব অন্যায় করেই যাচ্ছিলো রহমত। শাশুড়ীর বিছানায় জামাইকে শুইয়ে যে লোক ঠাট বজায় রাখে সে কাজী সাহেব শুনলো। শুনে জোড়া চোখে দপ্ দপ্ করে জ্বলেছিলো লোভলালসা। আগের দবদবা রবরবা থাকলে কাফেরের সন্তানকে কতল করে ফেলতো। পচা অভিজাত রহমত কাজী শুধু মনে মনে একটা ফন্দি এঁটে চুপচাপ রইলো। কাজী রহমতের ছোট চোখ আরো ছোট হয়ে যে অবর্ননীয় একটি ভাবের সঞ্চার হয়েছিলো, তাই কল্পনায় ভাসে। ধূর্ত শেয়ালের মতো চকচকে চোখবিশিষ্ট কাজী রহমতের ছবি চোখের সামনে জেগে উঠে। ছোটবেলায় কাজী রহমতের সে মুর্তি অনেকবার দেখেছে। শাদা শাদা খোঁচা খোঁচা আমের আটির কেশের মতো দাঁড়িগুলো। দুরভিসন্ধিতে কুটিল-কথা কইবার সময় কাঁপে।
যার এক কথায় মিথ্যা সত্য বনে যায়, সে কাজী রহমত সহচর কানা আফজালকে দিয়ে তার বাপ হরিমোহনকে ডাকিয়ে নিয়েছিলো। এসেছিলো তার বাপ। যদি না আসতো! আহা, যদি সে রাতে কাজী রহমতের বৈঠকখানায় না আসতো! হাসিম কিন্তু বিগত ঘটনার কথা ভাবছে। কাজী রহমত স্নিগ্ধ কণ্ঠে নাকি বলেছিলোঃ
“তয় বাজান মাইনসে নানান কথা কই বেড়ায়। আঁর খান্দানের ইজ্জত আছে। হেই কথা ভাবি চাইও। তারপরেও আঁই বেদীনরে মইয়া দিত পাইরতাম নয়। মুসলমান ত অইবা, বাকী কথা আফজালে কইবা।” [তারপর বাপজান, মানুষে নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে। আর আমার বংশেরও তো একটা ইজ্জত আছে। সে কথা ভেবে দেখো। তাছাড়াও কিন্তু আমি বেদীনকে (বিধর্মীকে) মেয়ে দিতে পারবো না। তুমি তো মুসলমান হবে, বাকী কথা আফজল বলবে।]