বুড়ো-বুড়ীরা বৈশাখের শেষের দিকে সূর্যের হলুদ শিখায় কেয়ামতের নমুনা দেখতে পেলো। এবার আর তারা নিশ্চেষ্ট বসে থাকতে পারে না। খোদার দরবারে মোনাজাত করে। আরশের খোদা বান্দার দিকে মুখ তুলে চাও… তুমি না চাইলে তারা যে বাঁচবে না। বরগুইনির পাড়ের আদম সন্তানের কেউ নেই দয়াল প্রভু তুমি ছাড়া, তোমার রহমত ছাড়া তাদের কিছু সম্বল নেই। তারা লেখা পড়া জানে না চাকরী করে না, দূর-বিদেশ চিনে না, ব্যবসা কেমন করে করতে হয় জানে না। তারা আছে বাবা আদমের লাঙল নিয়ে বরগুইনির পলিমাটি আঁকড়ে। তুমি যদি তোমার রহমতের চোখ মেলে তাদের পানে না তাকাও, তারা যে মরে যাবে। ওগো আল্লাহ! অতো নিষ্ঠুর হয়োনা তুমি। দাও, দাও, মাটি ভিজিয়ে দাও। বৃষ্টি দাও। একশো মোল্লা মৌলানা দিয়ে ধূ ধূ করা বিলে খতম পড়ানো হলো। খতম পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাছুরকে দুধ খেতে দিলোনা গেরোস্ত। বুকের শিশুকে স্তন্য দিলো না জননী। আগে খতম শেষ হোক, আসমানে মেঘ উঠুক। কালো মেয়ের কালো যৌবনের মতো মেঘ। কিন্তু বিষ্টি হলো না। বিষ্টির আগমনী গান গেয়ে পাড়া পাড়া চাঁদা তুলে বেড়ালো জোয়ান-বুড়োঃ
“কালা মেঘা ধলা মেঘা তারা সোদর ভাই
এক লাচা ঝড় (বৃষ্টি) দে ভিজি পুড়ি যাই।”
শির্ণী-সালাত অনেক করা হলো। কিন্তু বৃষ্টি নামলো না। কেয়ামত–সাক্ষাৎ কেয়ামত। সূর্যের শিখা দিনে দিনে হলুদ হয়ে উঠছে। পৃথিবীতে আগুন উঠবে–আগুন ছুটবে পৃথিবীতে। আকাশের আগুনে বুকের আশা জ্বলে গেলো। এখনো আউশ ধান বোনে নি। সারা বছর পেটের দাবী, আধসের চালের সে মহাজনকে কি করে- যে বুঝ দেবে। সন্তান বউকে কি খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবো। সমস্যা–মস্ত সমস্যা।
জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি বৃষ্টি নামলো। কালো জলবাহী মেঘ ভারে নত হয়ে মধুর চাকের মতো ঝুলে পড়লো। শুরু হলো বর্ষণ। রাত নেই, দিন নেই। বর্ষণ সে কি বর্ষণ! সাত-আট দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি। চোখ মেলবার উপায় নেই। চাষীরা লাঙল-জোয়াল কাঁধে ফেলে মাঠের দিকে ছুটলো। বৃষ্টির পানি পেয়ে পলিপড়া মাটি ফকফকে হয়ে আছে। লাঙলের ধারালো ফলার ঘায়ে নরম মাটির বুক চিরে ফেলে। ধান ছড়াবার সময় চলে গেছে। এখন অঙ্কুরিত ধান চাষ জমিতে ফেলে জালা করতে হবে। কচি ধানের চারা। যেগুলোকে তারা বলে জালা একগাছি দু’গাছি করে সারি সারি রোপণ করতে হবে। শত অভাব, দুঃখের মধ্যেও গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে
গানঃ
“দেশ মরি গেল দুর্ভিক্ষের আগুনে
তবু দেশের মানুষ জাগিল না কেনে।”
কেন যে দেশের মানুষ জাগে না হাসিমের জানার কথা নয়। কবিয়াল ফনি বড়ুয়া গান বেঁধেছিলেন। কবিয়ালের কথাই সত্য। দেশ দুর্ভিক্ষের আগুনে জ্বলে গেছে, পুড়ে গেছে। তার পরেও দেশের মানুষ জাগছে না কেন? ঝিলিক মেরে চোখের সামনে তেজেনদার চোখ দুটো ভেসে উঠলো। মৃত নিথর চোখের ছুরির ফলার মতো অন্তরের অতলস্পর্শী জিজ্ঞাসাটি হাসিমকে ডাক দিয়ে অনেক দূরে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে এসকল কথা মনে ঘুরে ঘুরে কেন যে পানির ভাষায় বেজে উঠে হাসিম তার হদিশ পায় না। হাত দুটো কাদার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে চুপ করে থাকে। দলা দলা কাদা তুলে নিয়ে আল বাঁধতে ভুলে যায় সে। কিছুই দেখতে পায় না। কেবল দেখে হাতির মতো বলশালী তেলীপাড়ার তেজেনের বাঁকানো দৃষ্টি হাজার হাজার ভগ্নাংশ হয়ে জীবনে জীবনে মিশে গেছে।
“এই বানিয়ার পুত, মাইনসে কয়; ‘হাত-পাঁচ গুণ্যা চাষ নগরে ব্যান্যা।‘ কি গরসদে, তোরে দি চাষের কাম ন অইবো।” (অই বেনের ছেলে কি করছিস, লোকে বলে সাত পাঁচ হিসাব করে বেনেরা চাষ করে না। তোকে দিয়ে চাষের কাজ হবেনা।)
আমজুর চীৎকারে চেতনা ফিরে আসে। হাঁ, সাত পাঁচ ভেবে স্বর্ণ বণিকেরা চাষ করে না। অপরকে দিয়ে করায়। চাষ করার দরকারটা কি? সোনাতে পেতল মিশিয়ে বেচে ডবল ডবল লাভ করে। দশ-বিশ গেরামের বউয়ের নাক-কানের সোনা তাদের লোহার সিন্দুকে আটক থাকে। মাসে মাসে সুদ বাড়ে। সুদ সুদ বিয়ায়। এসব স্বর্ণ বণিকদের লোহার সিন্দুকে চাষী গোরোস্তের প্রাণ-ভভামরা বন্দী হয়ে থাকে। তবু মুসলমান চাষীরা বেনেদের বাবু বলে ডাকে। একখানি জমি এক সন চাষ করার জন্য সারা বছর ভেট বেগাড় বয়ে বেড়ায়। দু’আনা সুদ কম দেবার জন্যে দশবার হাতে-পায়ে ধরে। আসল যারা বেনে বাবু, সে মুসলমান তার বাবা নয়-বাবার বাবা বেনে ছিলো বলে তাকে ‘বানিয়ার পুত’ বলে ডাকে। এ সমাজের মানুষের সংকীর্ণতা, অনুদারতা, মমতাহীনতা তার বুকে কাঁসার ঘন্টার মতো বাজে। না সে আর আল বাঁধবে না। প্যাক মাখা হাত দুখানি বিলের পানিতে ধুয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে আসে। তাকে চলে আসতে দেখে আমজুর ছেলেটি চীৎকার করে বললোঃ
“বা-জান, বানিয়ার পুত যায় গৈ।” (বাপজান, বেনের ছেলে চলে যাচ্ছে।)।
“যউকদে হালা মালাউনের বাইচ্চা, একবারে ধুতা বলদ, কন কামের নয়।” (যায় যাক শালা মালাউনের বাচ্চা। হিন্দুদের সম্বন্ধে ঘৃণাসূচক উক্তি।) একেবারে অলস বলদের মতো। কোন কাজে আসে না জবাব দিলো আমজু।
সেই-যে চলে এসেছে তারপরে হাসিম আর কারো মাঠের কাজে মজুর খাটতে যায় নি। আকাশ ফুটো হয়ে বৃষ্টি ঝরছে। বাইরে বেরোবার উপায় নেই। পাহাড়িয়া পথ-ঘাট পিছল হয়ে আছে ভয়ানক রকম। একবার যদি পাহাড়ের ধার বেয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে যায়, এ জীবনে কোনোদিন উঠে বসে খেতে হবে না। তবু হাসিম পাহাড়ে যায় প্রতিদিন। ছড়িতে ঢল নেমেছে। হাঁসের মতো সাঁতার কেটে পেরোতে হয়। পাহাড়ে জীবনের রহস্যের সমাধান খুঁজে পায়। তাকে দেখে পাড়ার মানুষ হেসে ওঠে। মজুর পাওয়া যাচ্ছে না। দিনমজুরী তিন বেলা খেয়ে আড়াই টাকা তিন টাকার নীচে না। হাসিম পাহাড় থেকে বাঁশ এনে দু’টাকার বেশি পায় না। তার বোকামীর জন্য লোকে হাসে। তার নির্বুদ্ধিতায় তারা আমোদ পায়, সে কথা হাসিম জানে। কিন্তু কেন, সে কথা বুঝিয়ে বলতে পারবে না; খুলে বলতে পারবে না। পাহাড় তাকে কষ্ট দেয় বটে, সে কষ্ট কিছুতেই মানসিক নির্যাতনের সমান নয়। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হৃদয়কে রক্তাক্ত করতে জানে না ধানী মৌনী নীলশৃঙ্গবিশিষ্ট পাহাড়।