গান যখন শেষ হলো তখন অনেক রাত। চাঁদের আলো নিভে গেছে। বুকের সূচীমুখো সুতীক্ষ্ণ যন্ত্রণার শিখার মতো আসমানে কম্পিত, শিহরিত অসংখ্য তারা জেগে আছে। সুলতান কিংবা গণি কারো দেখা পেলো না। দু’টো টাকা তার উসুল হলো না।
আর উসুল হবে না। সারিন্দাখানা মরা লাকড়ির মতো কাঁধে ফেলে ঘরে ফিরছে হাসিম। অসম্ভব ক্লান্ত।
কামারের হাঁপরের মতো বুকের ভেতরটা অসম্ভব উত্তপ্ত মনে হয়। নিঃশ্বাসে রক্ত ঝরে যায়। যে সারিন্দা হৃদয়ের প্রিয়তম দোসরের মতো সাড়া দিয়ে কেঁদেছে, এখন বড়ো বেশি বেদরকারী আর বড়ো বেশী ভারী মনে হয়।
মসজিদ ভিটা পেরিয়ে যেতে পাশাপাশি তার বাপ-মার কবর জোড়া চোখে পরে। আপনা আপনি চোখের পানি বেরিয়ে গন্ডদেশ ভিজিয়ে দিয়ে যায়। এর উৎস কোথায় জানে না হাসিম। বরগুইনির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এই বরগুনিতে তির তির ধারার একটি প্রবাহ ছিলো। বর্ষার পানি খেপা বাদ্যানীর মতো মাঠে মাঠে খেলা করতো। এখন স্রোতহীন, প্রবাহহীন বরগুইনি অনন্ত তৃষ্ণার একখানি লকলকে জিহ্বার মতো লোকালয়গুলোকে জড়িয়ে পেচিয়ে পড়ে আছে। এখন তার বুকে রেতী বালু চর খচ খচ করে। ধু ধু বালুকাময় বরগুইনির বুকের মতো হাসিমের বুক। ব্যাথা টন টন করে। অনেক রাত হয়ে গেলো। কালকেও পাহাড়ে যেতে হবে।
কবরস্থান ছাড়িয়ে বাঁ দিকে বাঁক ঘুরবার সময় আচমকা থমকে দাঁড়ায়। বড় আমগাছটার ধার ঘেঁষে কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ির আঁচলের একপ্রান্ত কলার পাতার মতো বাতাসে অল্প অল্প দুলছে। আবছা অন্ধকারে কেমন ছায়ামূর্তির মতো মনে হয়। সারা গা ছমছম করে। ভীত-বিহ্বল হাসিম ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে এগিয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় ছায়ামূৰ্তি কথা কয়ে উঠেঃ
“হাসিম বাই, তাড়াতাড়ি আইও। আঁর ডর লাগের দে।” (হাসিম ভাই তাড়াতাড়ি এসো, আমার ভয় করছে।)
“জোহরা এতো রাইতে তুই?” হাসিম জিজ্ঞেস করে।
“হ হাসিম বাই, তোঁয়ার গীত হুনিবার লয় আসিলাম দে। গোয়াল ঘরের পিছদি লুকাই হুন্যি। শেষ অইবার আগে চলি আস্যি। যাইতে ডর লাগে দে” (হাঁ হাসিম ভাই, তোমার গান শোনার জন্য এসেছিলাম। গোয়াল ঘরের পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। শেষ হবার আগেই চলে এসেছি। এখন যেতে ভয় করছে।)
তারা দুজন পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। হাসিমের চেতনার গভীরে একটা খুশি খুশি ভাব জেগে উঠে। সে সঙ্গে ভয়ও। রক্তের সঙ্গে এমন কিছু পদার্থ জড়িয়ে থাকে, কাউকে দেখলে আপনা থেকেই নেচে উঠে। খলু মাতুব্বরের ভাতিঝি জেহরা। রাতের অন্ধকারে পাশাপশি হাঁটছে। কেউ যদি দেখে ফেলে! সুফিয়ার মুখখানা মনে পড়ে। এ মুহূর্তে সে সব কিছু ভুলে থাকতে চায়! আনন্দের অঙ্কুর তার স্নায়ুকেন্দ্রে। হাসিম এ অনুভূতিটুকু শিল্পীমনে সঞ্চয় করে রেখে দিতে চায়।
২. বৈশাখ যায় যায়
বৈশাখ যায় যায়। বৃষ্টি নামে না। বরগুইনির দু’পাড়ের কৃষকদের মনের বাম্প আকাশে কালো মেঘ হয়ে দেখা দিলো না। কালো মেঘের আঁচল চিরে নেমে এলো না সুশীতল বারিধারা।
তারা আল্লাহর আরশের উদ্দেশ্যে করুণ মিনতি জানালো। আসমানের আল্লাহ প্রার্থনায় সারা দিলো না। সারা জাহানের মালিক কৃপণের মতো আরশের সিংহাসনে গাঁট হয়ে বসে রইলেন। তার মনে লেশমাত্র করূণা নেই। আখেরী জমানা দুনিয়াটা দিনে দিনে বুড়া হয়ে যাচ্ছে। মানুষের হায়া শরম আর ঈমান বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। সে জন্য দীন-দুনিয়ায় দো জাহানের মালিক তার সমস্ত মায়া সমস্ত মমতা মাটির খাঁক থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। বুড়োবুড়িরা মন্তব্য করলো কেয়ামতের আর বেশী বাকী নেই। নয়তো বৈশাখের সতেরো তারিখে বিয়ে হয়ে গেছে গাজী কালুর, এখনো নামলো না বৃষ্টি?
তাদের ধারণা–পীর কুলের মধ্যমণি, ফকির কুলের শিরোমণি গাজীকালুর বিয়ে হয় বৈশাখের সতেরো তারিখে। বৌ করে রাজার ঝি চম্পাবতাঁকে ঘরে নিয়ে আসবেন। সতেরো তারিখেই সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাত্রা করেন। কালো মেঘ ঢোলক বাজায়। বিজলী আলোক জ্বালায়। বিয়ের উৎসবে বঙ্গোপসাগর হতে উঠে আসা কালবৈশাখীর মৌসুমী ঝড় কেশর ফোলা সিংহের প্রমত্ত গর্জনে উড় মাটি চুর করে, এঁটেল মাটি ধুলো করে। সকলে বলে আমাদের গাজী পীর বিয়ে করতে যাচ্ছেন। রাজার দুলালী চম্পাবতীর তাবৎ শরীরে পাঁচটি ফুলের ভার। পঞ্চফুলের ওজন ফুলের মতো রাজকন্যার বিয়ের যোগাড়যন্তর শেষ-সমাপ্ত প্রায়। তখন ভেঙে গেলো বিয়ে। চম্পাবতীর চাঁপা বরণ গায়ের রঙ গাজীর মায়ের মনে ঈর্ষা জাগায়। ভাংচি দেয় মা। ভেঙে যায় বিয়ে। মাতৃভক্ত সন্তান মায়ের কথামতো চলে আসে। আবিয়েতা চম্পাবতী মনের দুঃখে কাঁদতে বসে। মনের জ্বালা আকাশে মেঘ হয়ে জমে… বৃষ্টি হয়ে গলে পড়ে। সারা জীবন কুমারী থাকার অনুক্ত বেদনা বৃষ্টির ধারায় ঝড়ে পড়ে। ফি বছর এমনি হয়। যতোদিন পৃথিবী থাকে এমনিই হবে। তা না হলে সৃষ্টি রক্ষা পাবে না। মানুষ কেমন করে চাষাবাদ করবে? একমাত্র কেয়ামতের দিন গাজী পীর রাজার কন্যা চম্পাবতাঁকে বিয়ে করতে পারবে, তার আগে নয়।
কবে চলে গেছে বৈশাখের সে সতেরো তারিখ। এবার অজন্মার বছর। তাই গাজী পীর আর বিয়ে করতে যান নি। গেলেও চুপি চুপি গেছেন। মাতৃভক্ত সন্তানের পৌনপুনিক কাপুরুষতার কথা সকলকে জানান দিতে হয়তো লজ্জাজনক মনে করেছেন পীর সাহেব। তাই অতো শান-শওকত করেন নি। কেউ একজন মন্তব্য করলো, এ অজন্মার বছরে, গাজী পীর অতো বড়ো পীর হয়েও বেফজুল হিসেব পত্তর করতে সাহস করেন নি।