“আয় গণ্যা আয়”। (আয় গণি আয়।)
গণি মাথার টেরছা টেরী ঠিক করতে করতে বললোঃ
“যা বানিয়ার পুত, সারিন্দাখানা লই আগই। খানাপিনা হেডে হইব।” (যাও বেনের ছেলে সারিন্দাখানা নিয়ে এসো। খাওয়া দাওয়া ওখানে হবে।)
ওরা চলে গেলো। দোকানে চাপা গুঞ্জন উঠলো। কে একজন মিনমিনে গলায় বলেলোঃ
“দেশের মানুষ ভাতে মরের, জাহেদ বকসুর মনে খুসির অন্ত নাই।” (দেশের মানুষ ভাতে মারা যাচ্ছে, জাহেদ বকসুর মনে খুশির অন্ত নাই। “ন ক্যা অইতো খুশি সুদের টেয়া, টেয়ায় টেঁয়া বিয়ায়।” (খুশি হবে না কেন, সুদের টাকা তো, টাকায় টাকা বাড়ায়।)
কথা আর বাড়ে না। কেন বাড়ে না হাসিম জানে। লণ্ঠনের আলোতে যে সকল মুখ দেখছে, তাদের অনেকেই সুদে জাহেদ বকসুর টাকা ধারে। দোকানের মানুষগুলোর চোখমুখে হাসিম তেলীপাড়ার তেজেনের সে উচিয়ে ধরা প্রশ্নটিকেই দেখলো। আশ্চর্য, একটা মাত্র প্রশ্নের ভারে সকলে কেমন পশুর মতো বোবা হয়ে গেছে। তেজেনদা নিজের গলায় ফাঁসি লাগিয়ে হৃদয়ের রক্তে জীবনের জীবিকায় লীন সে প্রশ্নটিকে দিনের নিলাজ আলোতে তুলে ধরেছিলো। তেজেনদাকে এ সকল মানুষের তুলনায় অনেক সাহসী মনে হয় হাসিমের।
দোকান থেকে বেরিয়ে রসিদ আহমদের মুদী দোকানে গিয়ে দু’টাকার চাল-ডাল কিনে ঘরে চলে গেলো। এখনো সুফিয়া ঘরের দাওয়ায় বসে আছে। সাঁঝবাতিও জ্বালে নি। হাসিম জ্বালবে কিনা ভাবলো। যদি কেরোসিন না থাকে তা হলে খিটিমিটি লাগতে পারে। চাল-ডালগুলো সুফিয়ার সামনে রেখে সারিন্দাখানা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে। কতোদূর এসে পিছনে ফিরে তাকায়। সমাচ্ছন্ন অন্ধকারে সুফিয়াকে ভূতের মতো লাগে।
জাহেদ বকসুর বাড়ীতে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। কড়া আলোকের প্যাটোম্যাক্স শোঁ শোঁ শব্দে জ্বলছে। দশ গেরামের মানুষ গান শুনতে ভেঙে পড়ছে। অভাব দুঃখ, অর্থনৈতিক অন্তদাহ… গাঁয়ের মানুষের সবটুকু প্রাণ শুষে নিতে পারে নি। গান দুঃখের রাজ্য থেকে, অভাবের রাজ্য থেকে এক বিচিত্র রাজ্যে নিয়ে যায়। সে এক বিচিত্র অনুভূতির রূপ-রাঙা জগত।
খাওয়া-দাওয়ার পর শুরু হলো গান। উপস্থিত মানুষেরা ঠিক করে দিলো সিদ্দিক গাইবে পুরুষের ভুমিকায়। নারী হবে হাসিম। আসরে প্রথম উঠেই সিদ্দিক হাসিমকে বেপরোয়া ভাবে খোঁচাতে থাকে। সুরটুকু বাদ দিলে যা থাকে, নির্জলা গালাগালি ছাড়া আর কিছু নয়। প্রত্যেক গানের মধ্যে ঘৃণা, অবজ্ঞা, বিদ্রূপ হাসিমের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছে। ছাগল দিয়ে হাল চাষ করতে পারলে মানুষ কেন গরু কেনে? হাসিম ছাগল আর সে গরু। এমন কি তার বাপকেও টেনে এনেছে। তার মা দাসী। বাপ বেনে। জন্মসূত্রে কপালে যে শীলমোহর পড়েছে তার থেকে এ জন্মে আর নিষ্কৃতি নেই। তাকে লোকে ঘৃণা করবে, বিদ্রূপ করবে, অবজ্ঞা করবে। মানুষের মর্যাদা তার ভাগ্যে নেই। কোনোদিন উদার চোখে পড়ার মানুষ তার দিকে চাইবে না। তেমন বিরাট প্রসারিত মন এদের কই? শেষে মিল দিয়ে গানের আকারেই গালিগালাজ করে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তবলায় তাল ফুটছে। বেহালার করুণ রাগিণী কেঁদে কেঁদে এ অশ্লীতার প্রতিবাদ করছে। আর মানুষ… উঠোন ভর্তি মানুষ বীভৎস উল্লাসে হাত তালি দিচ্ছে। কে একজন উৎসাহের অতিশয্যে বলে উঠলো, “বাঃ বাঃ সিদ্দিক, বানিয়ার জাতরে ধুই ফেলা, বাপের বেড়া।” (বাঃ সিদ্দিক, বেনের জাতকে ধুয়ে ফেলো বাপের বেটা।)
এসব ঠাট্টা-বিদ্রূপ বিছুটি পাতার মতো লাগে এসে হাসিমের শরীরে। জ্বালা করে। চেতনায় সীসার বলের মতো আঘাত করে।
সিদ্দিক বলে পরে কম্পিত কলেবরে হাসিম সারিন্দা হাতে উঠে দাঁড়ায়। সারা শরীর তার কাঁপছে। চোখ ফেটে বার বার কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। সিদ্দিকের স্কুল রসিকতায় যাদের মন ভরেছে তারা কি তার বিনম্র আবেদন, অন্তরের স্বগতোক্তি কান ভরে শুনবে। কাঁপা কাঁপা স্বরে গানের কলি উচ্চারণ করে। পয়লা আল্লাহর নাম, রসুলের নাম দেবী সরস্বতীর বন্দনা করে ওস্তাদ গুরুর নাম স্মরণ করলো। সভার দশজনকে সালাম নিবেদন করে শুরু করলোঃ
“দয়া করো প্রভু তুমি দয়ার মহিমা
দীনহীন সন্তানে ডাকে পুরাও বাসনা গো।”
সারিন্দার তারে মৃদু আঘাত করলো। মুহুর্মুহুঃ ঝঙ্কারে নিপুণ হাতের স্পর্শে নাগেশ্বর কাঠের সারিন্দা বেজে উঠলো গুন গুন। নাগেশ্বর কাঠের কুঁদানো সারিন্দায় বুকের ভেতরের দুঃখে দুঃখে, বেদনায় বেদনায় ফোঁটা রক্তপদ্ম কণ্ঠভরা রক্তাক্ত সুষমায় জেগে উঠলো। ফুলের স্তবকের মতো ফুটে উঠতে থাকলো গানের কলি। প্রথমে ধীরে, খুব ধীরে, তারপর উঁচুতে আরো উঁচুতে চড়তে লাগলো গলার স্বর । হৃদয়ের ফেনিল কান্না, উদ্বেল বেদনা বাসনা পুস্পল গানের আকারে ঝেড়ে ফেলতে চায় হাসিম। বারংবার সারিন্দার কম্পমান তারে টুংটাং কেঁদে যাচ্ছে একখানি অভিমানী নারী-হৃদয় যেন। কোন দংশন, কামড় নয়, অশ্লীলতা, অপবাদ নয়; ব্যথা, শুধু ব্যথাই সভাজনের কাছে করুণ মিনতির উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে।
লোকগুলো শুনছে কেবল শুনছে। হাততালি দিচ্ছে না কেউ, টিপ্পনী কাটছে না কেউ, অবাক হয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছে। বুকের সীমান্ত অবধি হাতড়ে দেখে গানের সুরে সুরে। তাদের ঘরের নারীদেরও এমনি স্বপ্ন-কল্পনা অভাবের আগুনে মাঠের ফসলের মতো পুড়ে যাচ্ছে। তাদের রক্তের ঢেউ ফোঁটা আকাঙ্ক্ষার কাহিনী নির্মম বাস্তবতার আঘাতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। সুর সারিন্দায় মন্দ্রিত ধ্বনিতে, অনর্গল হাসিমের কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। নিস্তব্ধ সভার মধ্যে থেমে থেমে কাঁদছে। সারিন্দার ধ্বনি। সে দরদে অবাক তারার দৃষ্টি মিটি মিটি কাঁপছে।