“জোহরা, তুই যদি নিজের ইচ্ছায় মরিত পারস নিজের ইচ্ছায় বাঁচিতও পারিবি। কি কস, ন পারিবি?” (জোহরা, যদি তুই নিজের ইচ্ছায় মরতে পারিস, নিজের ইচ্ছায় বাঁচতেও পারবি। কি বলিস, পারবি না?)।
জোহরা কালো চুলের রাশি মুখের সামনে ফেলে দিয়ে সলজ্জভাবে বললোঃ
“হ পাইরগম।” অল্প অল্প জোছনায় তাকে রহস্যময়ীর মতো লাগে। জোছনার তন্তুতে গড়া যেন সমস্ত শরীর। শাড়ীটা কাঁধের থেকে এলিয়ে পড়েছে। আধখোলা ব্লাউজের ফাঁকে এক ফালি জোছনা এসে লেগেছে। বাম স্তনের অর্ধাংশ চক চক করছে। হাসিম দু’হাতে জোহরাকে জড়িয়ে ধরে। জোহরা গভীর আশ্রয়ের নিশ্চিত খুঁটিটিকে আঁকড়ে থাকে। অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ। আসার সময় বললো হাসিমঃ
“খেয়াল রাখিস, সোমবারে মোল্লায় আজান দিবার আগে।”
“আইচ্ছা”, মুচকি হেসে জবাব দিলো জোহরা। পৃথিবীর কারো বিরুদ্ধে যেন তার কোনো নালিশ নেই।
সোমবার দিন সূর্য ওঠার আগেই পথ দিয়েছে দু’জন। কুয়াশা পড়েছে চারদিক। আকাশে শুকতারাটি দপ দপ করছে। ঘরে ঘরে ঝুঁটি দুলিয়ে মোরগগুলো বাঙ দিচ্ছে। হাসিম আর জোহরা বাকা পথটা বেয়ে গ্রামের সীমানা পেরিয়ে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছে। হাসিমের বুকের ভেতর কান্নার নদী গর্জাচ্ছে। বরগুইনিরপাড় কতো সহস্র বাঁধনে যে তাকে বেঁধে রেখেছে। কদম বাড়াতে গেলে স্নায়ু-শিরা ছিঁড়ে যেতে চায়। পায়ের তলায় ভেজা ধুলিতে মিশে রয়েছে মায়ের আদর। কতোদিন এ পথ পরম বন্ধুর মতো তাকে সঙ্গ দিয়েছে। গভীর নিশীথে আপন বুকের ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে ছোট্ট বেড়ার ঘরখানিতে সুফিয়ার পায়রার মতো নরম বুকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। পথ– বোবা পথ, ভেজা ধূলোর সুড়সুড়িতে কি যেন কথা কয়। পা চলতে চায় না। বরগুইনির পাড়ের মাটি যেন কথা কয়। সহস্র লোকালয় জড়ানো-পেচানো অনন্ত তৃষ্ণার লকলকে জিহ্বার মতো বরগুইনি, তুমি কতো সুন্দরী, গেরোস্ত ঘরের বউয়ের মতো কতো স্নিগ্ধা, নটিনীর মতো কেমন ক্ষীপ্রস্রোতা! বিদায়, তোমাকে বিদায়! কাজী পুকুরের অতল কালো জল, তোমার বুক যেন অসীম স্নেহের ভাণ্ডার, তোমাকে বিদায়। হে বাপ, ঘুমিয়ে থাকো, হে মা ঘুমিয়ে থাকো, প্রিয়তমা সুফিয়া, তুমি একটিবার পাশ ফেরো ঘুমের ঘোরে; বিদায়, তোমাদের বিদায়। কুয়াশা ঢাকা সবুজ মাঠ, তোমাকে বিদায়। কাজী বাড়ির দাসত্ব, তোমাদের বিদায়। বাপের মা দাদী, তোমাকেও বিদায়।
তারা হেঁটে হেঁটে আধ মাইল পেরিয়ে এলো। বাঁ পাশের বাঁকটা ঘুরলেই চন্দ্ৰকান্তের ঘর। গলার সুর ভেসে আসছে। চন্দ্রকান্ত বোধহয় একতারা বাজিয়ে গান গাইছে। কিছুদূর এগিয়ে গেলো। হাঁ, চন্দ্রকান্তই গান গাইছে।
“মাটির পিঞ্জরের মাঝে বন্দী হৈয়া রে
কান্দে হাসান রাজার মন মনিয়ারে।
পিঞ্জরের ভিতরে ময়না ছটফট ছটফট করে
মজবুত পিঞ্জর ময়না ভাঙ্গিতে না পারে।”
এবার আর চোখের জল সামলাতে পারলো না। দু’চোখ বেয়ে ঝরঝর পানি নেমে আসে। সোনার মানুষ চন্দ্রকান্ত, সোনার মতো তোমার মন, বিদায়। শেষ রাতে চন্দ্ৰকান্তের গানের রেশ রেশমের চাঁদরের মতো হিম হিম হাওয়ায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। এবার চন্দ্রকান্ত গান ধরেছে
“দূরদেশী হৈলা বুলি মায়া না ছাড়িও
আমি অভাগিনীর কতা মনেতে রাখিও।”
গ্রামের সীমানা পেরিয়ে এসেছে। পেছন দিকে চেয়ে দেখে গ্রামের গাছপালা, মাটি, ঘরবাড়ি, ঘাস, পশুপক্ষী, মানুষজন সকলে একসূরে যেন চন্দ্ৰকান্তের গান হয়ে মিনতি করছে, “আমি অভাগিনীর কথা মনেতে রাখিও।” নিনাদিত বুকের ওপর হাত রেখে বললো মনে মনে হাসিম, সোনার দেশ, তোমাকে ভুলবো না, সোনার মানুষ চন্দ্রকান্ত, তোমাকে ভুলবো না।
তারা সাতবাড়িয়ার সীমানায় এসেছে। ঐতো সে তিনকানি জমিন, যেখানে দুদু রক্ত দিয়েছে। প্রথম সূর্যের আলোতে সে রক্ত চিচিকিয়ে জ্বলবে। হঠাৎ জোহরা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ঐ জমিনের মতো সেও নিজের শরীরের চরে সকলের দখল মেনে নিয়েছে। একটিবারও কথা কয় নি, প্রতিবাদ করে নি। এই পয়লা নিজের ইচ্ছে মতো একজন পুরুষের সঙ্গে যাচ্ছে। জমিনের কি কোনো দিন চোখ ফুটবে? চিনে নেবে আপন জন। মাটি তেমন প্রাণ পাবে কোনো দিন? মমতা কি ধারালো হবে মাটির?
ওই তো ইস্টেশন। সিগন্যালের লাল আলোটা বাঘের চোখের মতো জ্বলছে। অনেক হারানো দু’জন মানুষ পরম নির্ভরতায় একে অপরের হাতে হাত রাখলো। দুটো হৃদপিণ্ডের ধ্বনি এক হয়ে বাঁশরীর সুস্বরের মতো দিগন্তের কোথায় মিলিয়ে গেলো। ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে হাঁফাচ্ছে। দু’খানা টিকিট কিনে চড়ে বসলো গাড়িতে। গার্ড সবুজ পতাকা দুলিয়ে হুইসেল দিলে ট্রেন চলতে আরম্ভ করলো। জানালা দিয়ে পূব দিকে তাকায়। নীল পাহাড়ের ঘন বনরেখার ললাটদেশে সূর্য উঁকি দিয়েছে। রাঙিয়ে যাচ্ছে পূবদিক। রাঙিয়ে যাচ্ছে হাসিমের সমস্ত চেতনা। বরগুইনির জলের হৃদয়ে আলোর শান্ত সাহস খেলা করছে। ট্রেন ছুটছে পশ্চিমে ঝিক্-ঝিক-ঝি। সূর্যটা লাফিয়ে পশ্চিমে চলেছে যেন যুগ-যুগান্তরের সাথী।