খলুর কাছে দু’ভার বাঁশ বাবদ ছ’টাকা পেতো। সন্ধ্যে বেলা টাকাগুলোর জন্য গেলো। ঘাটার কাছে ভাইপো জলিলের সঙ্গে দেখা। জলিল হাসিমকে ধরে টেনে নিয়ে আসে। তারপর বললোঃ
“হাসিম, ভিতরে ন যাইস, আজিয়া বাজার গরম।” (হাসিম ভেতরে যাস নে, আজ বাজার গরম।)
হাসিম ব্যাপার কি জানতে চায়। জলিল তাকে কদমগাছটির তলায় এনে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনায়। হাসিমের মুখখানা শুকিয়ে আসে শুনে। দারোগার সঙ্গে যে ব্যাপারটির পর জোহরা গর্ভবতী হয়েছে। এ খবর সমস্ত পাড়ায় ছড়িয়ে গেছে। খলু মাতব্বর মানুষ। তার ভীষণ ইজ্জতহানি হচ্ছে। জোহরাকে হাফেজ ডাক্তারের কাছ থেকে এনে কতকগুলো শাদা ট্যাবলেট খেতে দিয়েছিলো। জোহরা রাগবশত সেগুলো কাউকে না বলে ফেলে দিয়েছে। পরিণামের কথা একটুও চিন্তা করে নি। এখন দারোগার বীজ তার পেটে অঙ্কুর হয়ে ফুটেছে। লোকে কানাকানি করছে। আর বেশি মানুষের কানে যাবার আগে অন্নদা ডাক্তারের কাছে গর্ভপাত করাবার জন্য নিয়ে গিয়েছিলো। জোহরা নাকি শোয়া অবস্থা থেকে পালিয়ে এসেছে। মাতব্বর জোহরাকে অনেক বুঝিয়েছে কাজটা ভাল হচ্ছে না। জোহরা শুনেনি। গর্ভপাত করাতে রাজি হয় নি। মাতব্বরের ছোট বউও বুঝিয়েছে স্বভাবসুলভ গালাগাল দিয়ে। একরাতের ব্যাপার–জোহরা কি একটু এদিক সেদিক করে ফেলতে পারতো না? আশ্চর্য ফলন্ত মেয়েমানুষ, বাপের বয়েসী দারোগার বীজটা পেটে ধরে ফেললো। এখন কিনা সমাজের প্রধান মানুষটার মাথা হেট করে দিতে চায়। জোহরার মতো অমন পাঁচজন বেশ্যা মেয়েমানুষের জীবনের চাইতে মাতব্বরের ইজ্জতের দাম কি বেশি নয়? জোহরা কিছুই শুনেনি। গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। মাতব্বর খুব মেরেছে। একটু কাঁদেনি। চীৎকার করে বলেছে, দারোগার ছেলে জন্ম দিয়ে খলুর নাক-কান কাটবে। বুকে গভীর বেদনা নিয়ে ফিরে এলো হাসিম।
অন্ধকারের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাসিমের কতো কথা মনে পড়ে যায়। শুকনো পাতার শব্দ তুলে যাচ্ছে ও কে? মেয়েমানুষ? হাসিম তাড়াতাড়ি ধাওয়া করে। কাছাকাছি গিয়ে হাঁক ছাড়েঃ
“হেইভা কন?” (ওটা কে?)
“আঁই, হাসিম বাই, তোঁয়ার লগে দেখা ক্যা অয়?” (আমি হাসিম ভাই, তোমার সঙ্গে দেখা কেন হয়?)।
“জোহরা! তুই কডে যরদে?” (জোহরা! তুমি কোথায় যাচ্ছো?) শুধোয় হাসিম।
“হাসিম বাই, আঁই মইরতাম যাইরদে। আঁর মরণ পড়িব। সাড়ে বারটার রাইতের গড়ি ধইরগম।” (হাসিম ভাই, আমি মরতে যাচ্ছি। আমাকে মরতে হবে। রাত সাড়ে বারোটার গাড়ি ধরবো।) জোহরা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে।
“তুই মরিবি ক্যা?” (তুই মরবি কেন?)।
“হাসিম বাই, এনেও আঁই বাঁচিত পাইরতাম নয়। চাচার কাছেও গেলে মরণ অইব। ন গেলে বিষ খাবাই মারিব। ন জান, আঁই দারোগার জারগুয়া পেড়ত ধরগি।” (হাসিম ভাই, এমনিতে তো আমি বাঁচতে পারবো না। চাচার কাছে গেলেও মরতে হবে। না গেলে বিষ খাইয়ে মারবে। জানো না, আমি দারোগার জারজ পেটে ধরেছি?) যে কথা এতোদিন বলি বলি করেও বলতে পারে নি, আজ অসঙ্কোচে বলে ফেললো।
হাসিম খানিক চুপ করে রইলো। তারপর বললোঃ
“জোহরা! তুই আঁর লগে চল।” (জোহরা তুই আমার সঙ্গে চল।)
“কডে?” (কোথায়?) ।
“আঁই কালুরঘাটর মিলত কাম গইরতাম যাইয়ম। কেরামত বাই কাম ঠিক গরি দিব।” (আমি কালুর ঘাটের মিলে কাজ করতে যাবো। কেরামত ভাই কাজ ঠিক করে দেবে।)
“না, হাসিম বাই, কেউর লগে যাইতাম নয়। মরণে আঁরে ডাক দিয়ে। পরের খুশীর লায় মরণের থুন নিজের ইচ্ছায় মরণ বউত ভালা।” (না, হাসিম ভাই, কারো সঙ্গে যাবো না, মরণ আমাকে ডাক দিয়েছে। পরের খুশীর জন্য মরার চাইতে নিজের ইচ্ছায় মরা অনেক ভালো।)
“হুন জোহরা, বেহুদা কথা ন কইস, চল আঁর লগে চল। বাজে খেয়াল ছাড়। আঁই তোরে বিয়া গইরগম।” (শোন, জোহরা বাজে কথা বলিস না। চল আমার সঙ্গে চল, বাজে খেয়াল ছেড়ে দে। আমি তোকে বিয়ে করবো।)।
“না হাসিম বাই, তুই আঁরে বিয়া গরিত পাইরতা নয়।” (না হাসিম ভাই, তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারবে না।)
“ক্যা জোহরা, ক্যা, আঁর কি দোষ?” (কেন, জোহরা কেন, আমার কি দোষ?)।
“দোষ তোঁয়ার নয়, দোষ নসিবের, আঁই যে কলঙ্কিনী জারগুয়া বাজানী।” (দোষ তোমার নয়, দোষ কপালের, আমি যে কলঙ্কিনী, জারজ ধারিণী।)
“জোহরা, হুন, কলঙ্ক তোর নয়, কলঙ্ক খল্যার। তুই ক্যা মরিবি? বেকুবের মত কাম ন গরিস। তোর কি দোষ? তুই আঁর লগে চল।” (জোহরা শোন, কলঙ্ক তোর নয়, কলঙ্ক খল্যার। তুই কেন মরবি? বেকুবের মতো তুই কাজ করবি না। তোর কি দোষ? আমার সঙ্গে চল।)
হঠাৎ জোহরা দু’হাত দিয়ে হাসিমকে কাঁকড়ার মতো জড়িয়ে ধরে। ছোট্ট মেয়েটির মতো আবদারের সুরে বলেঃ
“হাঁছা, হাঁছা হাসিম বাই, কুঁই আঁরে নিবা?” (সত্যি, সত্যি হাসিম ভাই, তুমি কি আমাকে নেবে?)
“আয় জোহরা, তোরে লগে লই যাইম আঁই। কাম গইরগম মিলত, তুই আঁরে রাধি-বাড়ি খাওয়াইস।” (হাঁ, জোহরা তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো। আমি মিলে কাজ করবো, তুই আমাকে বেঁধে বেড়ে খাওয়াবে।) হাসিম তার একখানা হাত জোহরার কাঁধের ওপর রাখে।
“তুই কঁড়ে যাইবা?” (তুমি কখন যাবে?) জিজ্ঞেস করে জোহরা।
“সোমবারে”, হাসিম জবাব দিলো।
“আর তো দুইদিন বাকি, যুদি মারি ফেলে?” (আরও তো দু’দিন বাকী। যদি মেরে ফেলে?)।