জোহরা ডান হাত বাম হাতে বুলোতে বুলোতে বললো ধীরে ধীরেঃ
“দাদীরে জোর গরি হরিচরণ, সাধন আর অধরবাবু পাথারিকোলা গরি লৈ গেইয়ে গৈ।” (দাদীকে হরিচরণ, সাধন আর অধরবাবু জোর করে পাঁজাকোলা করে ধরে নিয়ে গেছে।)
কথা শুনেই হাসিম বসে পড়ে। আর কোনো স্বর বেরোয় না মুখ দিয়ে। দু’হাতে মাথাটা চেপে ধরে। সুফিয়া মারা গেলো, মনির আহমদ, হিমাংশুবাবু, মান্নান জেলে চলে গেলো, দাদীকে অধরবাবু জোর করে নিয়ে গেলো। স্নেহ-মমতার ভিত্তিতে হাসিমের যে একখানা জগৎ গড়ে উঠেছিলো, যে জগতে সে হৃদয়াবেগের মূল্য পেতো, চোখের সামনেই ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো। এখন শিশু সন্তানকে নিয়ে সে কোথায় দাঁড়ায়। সারা মনে বিতৃষ্ণা ছড়িয়ে যায়। নিজের বাহুমূল দংশন করতে ইচ্ছে করে। জোহরাকে উদ্দেশ্য করে ঝাঁঝালো স্বরে বললোঃ
“তুই কিয়রলাই রইয়স, তুইও যা।” (তুই কেন রয়েছিস, তুইও যা।)
“আঁই, আঁই, …।” (আমি, আমি, …) জোহরা আবার অতল কালো চোখের দৃষ্টি হাসিমের দিকে মেলে ধরে। হাসিম বলেঃ
“যা, যা কেউরে লাইগতো নয় আঁর।” (যা যা, কাউকে লাগবে না আমার।)
জোহরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায়।
তার পরদিন এলেন কেরামত ভাই। হাসিম আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। ঘটনা, দুর্ঘটনার আবর্তে পড়ে সে সাত হাত মাটির তলায় সেধিয়ে গিয়েছিলো। অনেকদিন যেন সূর্যের মুখ দেখে নি। কেরামত ভাইকে তার আশা-আকাঙ্খার প্রতীক বলে মনে হয়। লোকটাকে দেখলে বুকে কোত্থেকে বল আসে। প্রেরণা সবগুলো লোমকূেপের গোড়ায় গোড়ায় সঙ্গীতের অঙ্কুরের মতো কাপে। সব দেখলেন, সব শুনলেন। বিশেষ কিছু বললেন না। এক সময়ে উচ্চারণ করলেনঃ
“জামিন দেয় কিনা চেষ্টা করে দেখতে হবে।”
হাসিম মনে মনে বেজার হলো। গ্রামের এতোগুলো লোক জেলে পচে মরছে। কেরামত ভাই ব্যাপারটিকে এতো সহজভাবে নিলেন। না, হাসিম বরদাস্ত করবে না। বরদাস্ত করতে পারবে না। ফস করে বলে ফেললোঃ ।
“কেরামত ভাই আর কিছু ন গরিবা?” (কেরামত ভাই, আর কিছু করবে না?)
“না ভাই আর কিছু করার নেই বর্তমানে।” জবাব দিলো কেরামত।
“এই যে পঁচিশ জন ভালা মাইনষেরে জেয়লত লৈ গেল, তার পতিকার কি?” (এই যে পঁচিশ জন ভালো মানুষকে জেলে নিয়ে গেলো, তার প্রতিকার কি?)
“হাসিম ভাই, প্রতিকার এতো সহজ নয়। এই তো অত্যাচারের সবেমাত্র শুরু। জালেমেরা বনের বাঘের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে, আর মজলুমেরা সকলে একজোট হয়ে যতোদিন না রুখে দাঁড়াচ্ছে কোনো প্রতিকার নেই। মনির আহমদ কিংবা হিমাংশুবাবু তো নয় শুধু, এমনি হাজার হাজার মানুষ বিনা অপরাধে জেল খাটছে।”
চুপ করে গেলো কথা শুনে। হাসিম কেরামতকে তার ব্যক্তিগত ব্যাপার জানালো। সে আর গাঁয়ে থাকতে চায় না। এখানে থাকার সমস্ত আকর্ষণ চলে গেছে। হাসিম অন্য কোথাও চলে যেতে চায়। কেরামত ভাই যেন তাকে কোথাও খেটে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। ছেলেটিকে কাউকে পুষতে দিয়ে যাবে। কেরামত বললোঃ
“আকর্ষণ থাক না থাক, সকলকে যেতে হবে। শহরের কল-কারখানা গাঁয়ের মানুষকে লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে যাবে। আজ না হয় কাল। দু’দিন আগে কিংবা পরে। কল রক্তের রস, বীর্যের ব্যঞ্জনা শুষে নিয়ে সকলকে চোচা করে ছাড়বে। ভূঁড়িওয়ালা মহাজনদের পেট মোটা হবে। হাড়ে হাড়ে আগুন জ্বলবে যেদিন, শ্রমিকেরা সেদিন জাগবে”–বিড়বিড় করে বললো, “ইতিহাসের কঠিন ইচ্ছা কার সাধ্য রোধ করে!”
হাসিম অতশততা বোঝে না। দরকারও নেই। সোজা কথা সে কাজ চায়। কেরামত ভাই যদি একখানা কাজের ব্যবস্থা করে দেন চলে যেতে প্রস্তুত। কেরামত কথা দিলো, আগামী সোমবার কালুর ঘাট যদি চলে আসে, তাহলে একখানা কাজের ব্যবস্থা করে দেবে।
হাসিম কাঙালের মতো বললোঃ
“নিশ্চয়, নিশ্চয় যাইয়ম, কেরামত ভাই।”
কেরামত ভাইকে কথা দেয়ার পর থেকে মনটা তার বার বার কাঁদছে। গাঁয়ের যেদিকে তাকায়, গাছপালা, ক্ষেত-খামার, সবকিছু একসঙ্গে করুণ মিনতি করে বলে যেন, “হাসিম, তুই ন যাইস।” শরীরের শিরায় শিরায় কান্না ফুলে ফুলে উঠছে। বরগুইনির দু’পাড়ে কতো মায়া ছড়িয়ে আছে। কাজী পুকুরের নিতল কালো জল তাকে সলিল-বাহু দিয়ে বেঁধে রাখতে চায়। আশ্বিনের কাঁচা সোনার মতো ঘন মিহি রোদে শরীরের কুসুম কুসুম উত্তাপিত সোহাগ মাখিয়ে দেয়। তার বাপ-মা’র ধ্বসে যাওয়া কবর দুটো থেকে যেন দুটো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। দু’কবরের মাঝখানে একটি চারা মতো নিমের ডালে বসা শালিকটি হাসিমের চলে যাওয়ার খবর শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সুফিয়ার কবরের মাটিগুলো এখনো তাজা। উঁচু করা মাটির নীচে তিন বছরের দাম্পত্য জীবন শাদা কাফনে ঢেকে পুঁতে দিয়েছে। অভিমানে সুফিয়া যেন মুক হয়ে বসে আছে।
সোমবার ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। হাসিম পাকাপাকি করে ফেলেছে সে যাবে। কিন্তু শিশুটির এখনো কিছু করে নি; কি করবে ভেবে পায় না। নিজের কাছ-ছাড়া করার কথা ভাবতেও কষ্ট লাগে। বুকের ভেতরটা কেঁকির মতো আওয়াজ দিয়ে ওঠে। এতোটুকুন শিশুর যে এতো মায়া, তা কি হাসিম আগে জানতো? বুকটা চুর চুর করে। এক সময়ে মনকে কঠিন করে ফেলে। ন্যাকড়া-কানি জড়িয়ে মনির আহমদের বাজা বৌটির কাছে ছেলেকে রেখে আসে। হাসিম এখন মুক্ত। মায়ার সমস্ত কোমল বাঁধন সংকল্পের ধারালো করাতে কেটে ফেলেছে। সোমবার দিন সকাল বেলাই সে চলে যাবে।