“গেলাম হাসিম বাই।”
মান্নানের রক্ত গরম। সে কিছুকে পরোয়া করে না। কানা আফজলের দিকে তর্জনী বাড়িয়ে দারোগো-পুলিশের সামনেই বললোঃ
“এই কানা, খেয়াল রাখিস, আঁই যদি বাপের বাইচ্চা অই, তইলে বদলা লইয়ম।” (এই কানা, খেয়াল রাখবি, আমি যদি বাপের বাচ্চা হই, একদিন বদলা .নেবো।)
একজন পুলিশ তার পাছায় বেতের একটা বাড়ি দিয়ে বললোঃ
“শালা, হট হট।”
মনির আহমদের মা “অ পুতরে, তুই আঁরে ফেলে কডে যরদে?” (বাছা, আমাকে ফেলে তুই কোথায় যাস?) বলে গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলো। বাঁজা বউটি মাথা ভাঙা টিউব-ওয়েলটার পাশে দাঁড়িয়ে, একদৃষ্টে স্বামীর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওরা আল পেরিয়ে রাস্তায় উঠলো। সিকদার পুকুরের তেঁতুল গাছটির আড়ালে চলে গেলো। অমনি যে টির কালো চোখের মণি কেঁপে বড়ো ক’টি চোখের পানির ফোঁটা নেমে এলো। গোলগাল মুখখানা চোখের পানিতে ভেসে গেলো। হাসিমেরও গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। বুকটা তার জ্বলছে।
কৃষক সমিতির কর্মীদের গ্রেফতারের পর হঠাৎ হাসিমের মনে হলো মট মট করে তার অনেক পাঁজর একসঙ্গে ভেঙে গেছে। সে যেন আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারছে না। পৃথিবীটা তার জন্যে মিথ্যে হয়ে গেলো। হাসিমের মতো সমাজহারা পরিচয়হারা একজন মানুষকে সমিতির কর্মীরা ভাই বলে গ্রহণ করেছিলো। তারা জেলে গেলো। হাসিম এখন কার কাছে যাবে? কি করবে? কর্মীদের সাহচর্যে, তাদের সঙ্গে আলাপে সালাপে হাসিমের ভেতরে আরেকজন নতুন হাসিম কখন জন্ম নিয়েছে টেরও পায়নি। নবলব্ধ চেতনার আলোকে সন্ধান করে দেখে, ওরা তার কতোটুকু ছিলো। মনের গভীরে রামমঙ্গল গানে শোনা একটি কলি লতিয়ে উঠলোঃ
“সীতা মৈলে সীতা পাইয়ম প্রত্যেক ঘরে ঘরে
প্রাণের ভাই লক্ষণ মৈলে ভাই বলিয়ম কারে?”
সে যেন একা ছিরাম, তার ভাইয়েরা কেউ নেই। ঘরে এসে দেখে দাদীর পাশে জোহরা বসে রয়েছে। হাসিম গায়ের জামাটা খুলে দড়ির ওপর ঝুলিয়ে রাখে। তারপর একখানা পিড়ি টেনে নিয়ে বুড়ীর পাশে বসলো। বুকের ভেতর ঢেউ ভেঙে যাচ্ছে, মুখ দিয়ে কথা সরছে না। তিনজন মানুষ বসে আছে অধোমুখে। চেরাগ বাতির স্বল্প আলোকে একের মুখে কি চিন্তা ছায়া ফেলেছে, অন্যজন পড়ে দেখতে চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে রাত বাড়ে। আঁধার আদিম হয়ে বরগুইনির দু’পাড়কে গ্রাস করে। তিনজন মানুষ নীরবে আপনাপন স্মৃতির বোঁচকা খুলে নষ্ট অনুভূতি, নিহত স্বপ্নের লাশের গায়ে হাত বুলোচ্ছে যে যার মতো করে। একজনের নিশ্বাসের শব্দে আরেকজন চকিত হয়ে ওঠে। সকলেই কথা বলতে চায়। কিন্তু বলার কথা খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের আধসেদ্ধ জীবনের কথার মুকুল বহুকাল আগেই শুকিয়ে গেছে। এমনি সময়ে ছোট্ট বেড়ালের বাচ্চার মতো শিশুটা কেঁদে উঠলো। জোহরা হাত বাড়িয়ে শিশুকে কোলে তুলে নিলো। হাসিমের বুকের ভেতর খচ্ খচ্ করছে। কাটার মতো কি একটা যেন বিধছে। শান্তি নেই, শান্তি নেই। জামাটা টেনে গায়ে জড়িয়ে বললোঃ
“জেহরা তুই দাদীর লগে বয়, আঁই এককেনা মনির আহমদ আর হিমাংশু বাবুর বাড়ির থুন ঘুরি আই।” (জোহরা, তুই দাদীর সঙ্গে বোস্। আমি একটু মনির আহমদ আর হিমাংশু বাবুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।)
বেরিয়ে গেলো হাসিম।
তার পরদিন হাসিম সন্ধ্যেবেলা বাজার থেকে ঘরে ফিরে দেখে ভেতরে জোহরা। কোলে শিশু। ব্লাউজের বোতাম খুলে স্তনের বোঁটাটি শিশুর মুখে পুরে দিচ্ছে। আপনা-আপনি হাসিমের চলা থেমে যায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। ডান স্তন টেনে নিয়ে বাম স্তন মুখের ভেতর পুরে দেয়। আশ্চর্য দুটি স্তন জোহরার। বাতির আলোকে দেখা যায় ঈষৎ রক্তিম, শিরাল, শেষ রেখাঁটি পর্যন্ত ভরে উঠেছে মাংসে! কালো জামের মতো কালো দু’টি কলি। হঠাৎ হাসিমের বুকের রক্তধারা নেচে ওঠে। তালে তালে রক্ত শরীরের ভেতর মাদল বাজায়। দু’টি মাংসল চুম্বক তার দু’চোখের দৃষ্টিকে ধরে রেখেছে। আধো অন্ধকারে থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার নড়ার ক্ষমতা নেই। সমস্ত জগৎ হারিয়ে গেছে দৃষ্টি থেকে। দু’টি অমৃত কলসী থেকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে রস ঝরে পড়েছে। সে অমৃত তার শরীরে প্রবেশ করছে আর সে সূক্ষ্ম চিন্ময়, গভীর জীবনের স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠেছে।
খানিকক্ষণ চোষার পর শিশুটি কেঁদে উঠলো। জোহরা ব্লাউজ ঠিক করে পরলো। মোহ ভেঙে গেলো হাসিমের। স্তনের বোঁটায় দুধ নেই। তাই শিশু কাঁদছে। জোহরার গভীর দুঃখের কথা তার মনে খুঁচিয়ে জেগে উঠলো। তিন তিনবার বিয়ে হয়েছে। একবারও পুরোপুরি স্বামীর ঘর করতে পারে নি। শিশুকে স্তন্য পান করাবার বড় সখ বুঝি তার। মনে মনে চিন্তা করলো জোহরাকে শিশুটি দিয়ে দিলে কেমন হয়। হাসিম গলা খাকারি দিলো। জোহরা শাড়ীর আঁচলটা ভালো করে টেনে দিলো মাথায়। ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলোঃ
“জোহরা, দাদী কই?” (জোহরা, দাদী কোথায়?)
জোহরা জবাব দেয় না। চোখের অতল মণি দুটো একবার মাত্র তুলে হাসিমের মুখের পানে তাকালো। পরক্ষণে নামিয়ে নিলো। ভঙ্গীটি বড় সুন্দর লাগলো হাসিমের। এ দু’টো দৃষ্টিরেখা বুকের অস্থিমাংস ভেদ করে অন্তরের অতলে গিয়ে বিধছে বুঝি। জামাটা খুলে রেখে আবার জিজ্ঞেস করলোঃ
“দাদী কডে গেইয়ে ন কস ক্যা?” (দাদী কোথায় গিয়েছে বলিস না কেন?)