“না, থাকতাইম নয়, বাইচ্চা একমাসের অইলে আঁই তীর্থ গইরতাম চলি যাইয়ম।” (না, থাকবো না, বাচ্চা একমাসের হলে আমি তীর্থ করতে চলে যাবো।)
“হুন, পোদ্দার গিন্নী, ঘরত চলো। অধর কিছু কইতো নয়। ধর্মের বিধান আছে প্রাচিত্তির গইরলে পাপ খণ্ডন অইবো।” (শোন পোদ্দার গিন্নী, ঘরে চলো। অধর কিছু বলবে না। ধর্মের বিধান আছে, প্রায়শ্চিত্ত করলে পাপ খণ্ডন হবে।)
বুড়ী জিজ্ঞেস করেঃ
“ঠাউর, কিয়র পাপ, কিয়র প্রাচিত্তির?” (কিসের পাপ, কিসের প্রায়শ্চিত্ত?)
“এই যে মুসলমানের বাড়িত এতো দিন থাহিলা?” (এই যে মুসলমানের বাড়িতে এতোদিন থাকলে।)
“আঁর নাতির বাড়িত রইলাম, হিথারলায় আঁর প্রাচিত্তি কি?” (আমি নাতির বাড়িতে থাকলাম, তার জন্য আবার প্রায়শ্চিত্ত কিসের?) রামাই পণ্ডিত প্রায়শ্চিত্তের কথা বলে বুড়ীকে টলাতে না পেরে অন্য সুরে কথা বলেঃ
“কাইল মা কালীর পূজা। বাড়ীর বুড়া মানুষ। উঁই ন থাহিলে পূজা অইব কেনে? মা কালির দিব্যি, চলো, চলো।” (কাল মা কালীর পূজা। বাড়ির বুড়ো মানুষ, তুমি না থাকলে চলবে কেন? মা কালীর দিব্যি, চলো৷)।
“ঠাউর, মা কালীও মাইয়া মানুষ। আঁর অবস্থা বুঝিব। আঁই চলি গেলে দুধের বাইচ্চা মারা যাইবো। তোঁয়ারা পূজা গরো আঁই হীরাধরের লই রইলাম। এই চ ঠাউর, একেবারে আইনমাইন হীরাধর।” (ঠাকুর, মা কালীও মেয়েমানুষ। আমার অবস্থা বুঝবেন। আমি গেলে বাচ্চা মারা যাবে। তোমরা পূজা করো, আমি হীরাধরকে নিয়ে রইলাম। দেখো, একেবারে অবিকল আমার হীরাধর।)।
বুড়ীর কথা শুনে ব্রাহ্মণের মাথার তালু পর্যন্ত জ্বলে উঠলো। আর একটু অপেক্ষা না করে চলে গেলো।
রামাই পণ্ডিতকে পাঠিয়েও কাজ না হওয়ায় অধরবাবু ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়লো। নানা লোক এসে নানা কথা বলে যায়। কেউ বলছে বুড়ী সাব-রেজিষ্টারের অফিসে গিয়ে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি যা আছে, সব হাসিমকে খুব শীঘ্রই দানপত্র করে দেবে। কি করবে ভেবে পায় না। চোখে অন্ধকার দেখে। প্রত্যেক দিন নতুন নতুন খবর আসে। হাসিম খলুর শরণাপন্ন হয়েছে, খলু লেঠেলদের নিয়ে অধরবাবুর চাষের জমিতে হাল বাইতে আসবে এবং পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরে নিয়ে যাবে, এমন খবরও শোনা যাচ্ছে। ভাইদের নিয়ে পরামর্শ করে। কেউ উপায় বাতলাতে পারে না। পাথরের তলায় হাত পড়েছে। মান-সম্মান সে গেছে কবে। এখন সম্পত্তিগুলো বাঁচাতে পারলেই হয়। আসন্ন বিপদের সম্ভাবনায় অধরবাবুর মগজের সবগুলো কোষ সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এ ক’দিনে অধরবাবু যেন অনেক বুড়িয়ে গেছে। ধনুকের মতো লিকলিকে শরীরখানা বাঁকা হয়ে গেছে। শেষে একটা উপায় আবিষ্কার করতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কানা আফজলের শরণাপন্ন হওয়ার কথা মনস্থ করলো। খলু যতো কূট-কৌশলী, যতো ধূর্ত হোক না কেন, তার হাতে যতো লেঠেল থাকুক না কেন, চেয়ারম্যান কানা আফজলের কাছে খলু কিছু নয়। অধরবাবু কানা আফজলকেই গিয়ে ধরলো। শুধু হাতে নয়। বাজার থেকে সাত আট সের পানতোঁয়া, সন্দেশ, রসগোল্লা ইত্যাদি গোপনে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারপরে গিয়ে দেখা করেছে এবং আসবার সময় নগদ পনেরো শ’টি টাকা পকেটে গুঁজে দিয়েছে। অধরবাবু ভারী কেপ্পণ মানুষ। লোকে বলে প্রস্রাব করার সময়েও হিসেব নিকেশ করে। কলে হাত পড়েছে, সুতরাং টাকা না দিয়ে উপায় কি? চেয়ারম্যান কাণা আফজল পথ বলে দিয়েছে।
মনির আহমদ, হিমাংশুবাবু, মান্নানেরা সিগারেট কোম্পানীর জমি দখলের প্রতিবাদে গাঁয়ের সমস্ত কৃষককে একজোট করেছিলো। কৃষক সমিতির সদস্যরা ওপরে দরখাস্ত পাঠিয়েছে। পত্রিকার কাগজে লেখালেখি করেছে কি সব। কোম্পানীর সার্ভেয়ার শেকল দিয়ে জমি মাপজোক করতে এলে সব কৃষকেরা মিলে খেদিয়ে দিয়েছে। কোম্পানী, কৃষক সমিতির সদস্য এবং গাঁয়ের আরো কতিপয় প্রতিবাদী কৃষককে আসামী করে থানায় এজাহার করেছে। কানা আফজল, জাহেদ বকসু, অধরবাবু এরা কোম্পানীর পক্ষে সাক্ষী হয়েছে। পরের দিন পুলিশ এসে মনির আহমদ, মান্নান, হিমাংশুবাবু এবং কয়েকজন কৃষককে পিছমোড়া করে বেঁধে থানায় চালান দিলো। অন্যান্য আসামীরা আগে খবর পেয়ে পালিয়ে গেছে। তাদেরকে ধরার জন্য পুলিশ আস্তানা গাড়লো। বরগুইনির পাড়ের একশোটি ঘরে একজন পুরুষ মানুষও নেই। যারা আসামী নয়, তারাও ভয়ে দূরের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে চলে গেছে। পুলিশ, চৌকিদার, দফাদারেরা সারা গাঁয়ে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মুর্গী, ওর খাসী জবাই করে দু’বেলা ভক্ষণ করছে।
ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেছে। অনেকেই মনির আহমদ এবং হিমাংশু বাবুকে সরে যেতে বলেছিলো। মনির আহমদ কিছু বলে নি। শুধু একটু হেসেছে। পুলিশ এসে যখন মনির আহমদকে হাতকড়ি পরালো মা এবং স্ত্রীর সামনে, হাসিমের চোখ দিয়ে আপনা-আপনি ঝর ঝর করে পানি বেরিয়ে এলো। একজন পুলিশ ঠাস করে গালে একটা চড় বসিয়ে বললো, ‘এই শালা এক নম্বর বরদমায়েশ।’ তখন হাসিমের শরীরের রোমে রোমে যেন বিদ্বেষের বিদ্যুত প্রবাহিত হলো। এমন কোনোদিন অনুভব করে নি। পুলিশ, দারোগা, দফাদার, চৌকিদার, মেম্বার, চেয়ারম্যান সকলের মাথাগুলো ফাটিয়ে দেয়ার জন্য হাতটা নিশপিশ করছিলো। মাথায় খুন চড়ে যাচ্ছিলো। অথচ যে লোকটাকে বিনাদোষে হাতকড়ি পরালো, স্ত্রী এবং মার সামনে মারলো, তার মুখে একটুও ভাবান্তর নেই। কপালের রেখাগুলো শুধু একটু কুঁচকে গিয়েছিলো। আসামীদের নিয়ে পুলিশ-দারোগা পথ দিলো। হাতকরি-পরা মনির আহমদ, একটু হেসে হাসিমের দিকে তাকিয়ে বললোঃ