বরগুইনির দু’পাড়ে জবর খবর রটেছে, পোদ্দার গিন্নী হাসিমের কাছে চলে এসেছে। বাড়াবাড়ির বটতলায় এ নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। কেউ কেউ বললো, বুড়ীর নামে আটকানি থালার মতো, ডাক দিলে কথা কয়, এমন সম্পত্তি আছে। পোদ্দার মারা যাওয়ার সময় গিন্নীকে অনেক সোনা এবং রুপার টাকা দিয়ে গেছে। বুড়ী সব হাসিম কে দিয়ে যাবে। গ্রামে সহসা হাসিমের কদর বেড়ে গেলো। কেন, হাসিম বুঝতে পারে না। খলু মাতব্বর এখন হাসিমকে বেশ খাতির করে। সম্পন্ন চাষী মজু মিয়া হাসিমকে তোয়াজ করতে শুরু করেছে। বলেছেঃ
“হাসিম বাই, মগ বিলের দুইকানি জমিন আঁরে চাষ গইরতা দিবা। আঁই তালি বালি গইরতাম নয়। ঠিক ঠিক ধান দিয়ম।” (হাসিম ভাই, মগ বিলের দু কানি জমি আমাকে চাষ করতে দেবে। আমি কোন গোলমাল করবো না। ঠিক ঠিক ধান শোধ করবো।)
খলু হাসিমকে ঘরে ডেকে নিয়ে যায়। বানিয়ার পুত আর ডাকে না। হাসিম মিয়া বলে সম্বোধন করে। হাসিমের সামনেই জোহরাকে ডাক দিয়ে নিয়ে আসে। জোহরা এলে বলেঃ
“হাসিমের দাদী বুড়া মানুষ, একা থাহে, মাঝে মাঝে তুই যাই হাতের কাম কিছু গরি দিস। খবরদার, ন ছুঁইস-টুইস। কি না কি মনে পরে। বিধবা মানুষ।” (হাসিমের দাদী বুড়ো মানুষ। একা থাকে। মাঝে মাঝে তুই গিয়ে হাতের কাজকর্ম কিছু করে দিস। খবরদার, ছুঁসটুস নে। কি না কি মনে করে। বিধবা মানুষ।)
হাসিম হতবাক হয়ে তার নতুন সমাদরের কারণটা চিন্তা করে। দুষ্ট লোকে বলে খলু বছর খানেক আগে ভিক্ষুদের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে বৌদ্ধ মন্দিরের মুর্তির গা থেকে সোনার অলঙ্কার ডাকাতি করেছে। সে খলুকে এখন হিন্দু বিধবার আচারের প্রতি শ্রদ্ধাবান হতে দেখে বিস্ময়ে থ’ বনে গেলো। ধর্মটা কিছু নয় যেন। বছর দশেক আগে খলুদের অত্যাচারেই তো পাল মশায়রা হিন্দুস্থান চলে গেলেন। হিমাংশু বাবুকে কতোবার মালাউনের বাচ্চা বলে গাল দিয়েছে। অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে স্বার্থের জন্য না করেছে এমন জঘন্য কাজ খুব কমই আছে। সে খলু কিনা আজ একজন হিন্দু বিধবার নিষ্ঠার প্রতি হঠাৎ মনোযোগী হয়ে উঠলো। তার মনের ভেতরে অভিপ্রায়টি কি, হাসিম মনে মনে চিন্তা করে।
অধরবাবু এখন খুব পস্তাচ্ছে। রাগের বসে বুড়ীকে একটা ধাক্কা দিয়েছিলো। তার যে এমন ফল হতে পারে, সে কথা স্বপ্নেও ভাবে নি। ধারেকাছে আত্মীয় স্বজনের বাড়ী ছিলো, চলে গেলেই পারতো। অথচ বুড়ী কিনা চলে গেলো হাসিমের ঘরে। অধরবাবুর মান-সম্মান বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। মান-সম্মান তো গেছে। তদুপরি স্বার্থের ওপর বিরাট একটা আঘাত আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সত্যি সত্যি বুড়ী যদি আট কানি সম্পত্তি হাসিমকে লেখাপড়া করে দিয়ে দেয়, যে ক্ষতি হবে, সারা জীবন সুদের কারবার করেও পূরণ করতে পারবে না। কেন সেদিন এমন ভুলটা করলো সেজন্য রাগে, দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। বুড়ী যদি স্বেচ্ছায় না আসে। তাহলে জোর করে আনার কোনো পথই খোলা নেই। জোর করে যদি আনতে যায়, সমস্ত মুসলমান পাড়া রুখে দাঁড়াবে। কারণ বুড়ীর সম্পত্তি আছে। সে সম্পত্তি হাসিমকে যদি দেয় তাহলে তাদের চাষে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং তারা এ সুযোগ নিতে ছাড়বে না। রাতের বেলা ঘুমোতে পারে না। পাগলের মতো হয়ে গেছে। এখন লোকে তাকে দেখলে মুখ টিপে হাসে। অনেক ভেবে একখানা বুদ্ধি বার করে। অধরবাবু গিয়ে কুলপুরোত রামাই পণ্ডিতের শরণাপন্ন হয়। কালী পুজোর আগের দিন রামাই চক্রবর্তী দুপুর বেলা বুড়ীর কাছে আসে। বুড়ী তখন হাসিমের ছেলেটিকে দুধ খাওয়াচ্ছিলো দাওয়ায় একখানা মাদুর বিছিয়ে। রামাই পণ্ডিত হাসিমকে ডাকতে ডাকতে উঠোনে উঠে এলো। পণ্ডিতের গলা শুনে বুড়ীর হাত থেকে বোতলটা পড়ে গেলো। পণ্ডিত বললোঃ
“অপোদ্দার গিন্নী, উঁই এডে ক্যা?” (অপোদ্দার গিন্নী, তুমি এখানে কেন?)
বুড়ী জবাব দেয় না। শুধু মাথার খাটো চুলের ওপর দিয়ে ঘোমটাটা দীর্ঘ করে টেনে দেয়। রামাই বেশ উৎসাহের সুরে বলেঃ
“নাতি পুতরে চাইতা আইস্যদে বুঝি?” (নাতির ছেলেকে দেখতে এসেছে বুঝি?)।
বুড়ী ক্ষীণ কণ্ঠে বলেঃ
“না ঠাউর মশায়, আঁই একেবারে চলি আস্যি। অধর আঁরে উঁড়াই দিয়ে।” (না ঠাকুর মশায়, আমি একেবারে চলে এসেছি। অধর আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।)
“একেবারে চলি আস্য কডে?” (একেবারে চলে এসেছে, সে কি, কোথায়?)
“এই ঘরত। সোনা আঁরে এক কামরা ঘর ছাড়ি দিয়ে। সন্ধ্যা আহ্নিকের কন অসুবিধা ন অয়। হিমাংশু দুই বেলা ভাত দিয়া যায়। লক্ষ গরি চাও ঠাউর মশায়, একবারে অবিকল আঁর হীরাধর।” (এই ঘরে, সোনা আমাকে একটি কামরা ছেড়ে দিয়েছে। সন্ধ্যা আহ্নিকের কোন অসুবিধে হয় না। হিমাংশু দু’বেলা ভাত দিয়ে যায়। লক্ষ্য করে দেখুন ঠাকুর মশায়, একেবারে অবিকল আমার হীরাধর।) কোলের শিশুর দিকে ব্রাহ্মণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ব্রাহ্মণ তিন কদম পিছিয়ে যায়।
“চার-পাঁচ দিন রইলা পোদ্দার গিন্নী–এহন ঘরত চলল। (চার-পাঁচ দিন তো থাকলে পোদ্দার গিন্নী এখন ঘরে চলো।)
“না, আঁই আর যাইতাম নয়।” (না, আমি আর যাবো না।)।
“ন যাই কি মুসলমানের বাড়িতে থাহি যাইবা?” (না যেয়ে কি মুসলমানের বাড়িতে থেকে যাবে?) রামাই ঠোঁট দিয়ে জিভ কাটে। “ছি, ছি!”