কাঠের সাঁকোর পাশে শোনালু গাছটার ওপর গিয়ে পড়ে। আর উঠতে পারে না।
হিমাংশুবাবু এসে বুড়ীকে পতনাবস্থা থেকে ওঠায়। গায়ের ধুলো ঝেড়ে দেয়। অধরের দিকে চেয়ে বলেঃ
“অধর, তুই গুরুজনের শরীরত আত দিলি”? (অধর, তুই গুরুজনের শীরের হাত দিলি?)।
হিমাংশুবাবুর মন্তব্যের কোন জবাব দিলো ন অধর। বুড়ীকে উদ্দেশ্য করে এবং হিমাংশুবাবুকে শুনিয়ে বললোঃ
“আইজখুন আর বাড়িত আইয়ন পইরত নয়, যারা আদর দেয় তারার বাড়িত থাইবা।” (আজ থেকে আর বাড়িত আসতে হবে না। যারা আদর দেখায় তাদের বাড়িতে থাকবে।)
অধর চলে যাচ্ছিলো। তার কর্তব্য সে করেছে। মুসলমান নাতির জন্য বুড়ীর দরদ উথলে উঠেছে, তার কাছেই থাকুক। অধর আর দরজা খুলে দেবে না। হিমাংশুবাবু বললোঃ ।
“এই অধর, হুন্।” (এই অধর, শোন।)
অধরবাবু ঘুরে দাঁড়িয়ে বললোঃ
“হিমাংশু, কি কবি ক’। আঁর টাইম নাই।” (হিমাংশু, কি বলবি বল। আমার সময় নেই।)
“তুই যে ঠাউরমারে ঘরত যাতি মানা করলি, কাম কি ভাল গরলি? বুড়া মানুষ, কডে থাইবে?” (তুই যে ঠাকুরমাকে ঘরে যেতে বারণ করলি, কাজটা কি ভাল করলি? বুড়ো মানুষ, কোথায় থাকবে?)
অধরবাবু স্পষ্টত বিরক্ত হয়। হিমাংশু তাকে উপদেশ দেবার কে? বললোঃ
“যেডে মনে লয় যউক, তোর যদি মনে পোড়ে তোর বাড়ি নিয়ে রাখ গৈ।” (যেখানে যেতে ইচ্ছা হয় সেখানে তিনি যেতে পারেন, তোর মনে দুঃখ লাগলে তুই নিয়ে যেতে পারিস।) কথা ক’টি ছুঁড়ে দিয়ে মিহি ধুতির কাছা সামলাতে সামলাতে হন হন করে চলে গেলো।
হিমাংশুবাবু বুড়ীকে সত্যি সত্যি নিজের ঘরে নিয়ে এলেন। তাঁর স্ত্রী সাবান মেখে স্নান করালেন। চুল আঁচড়ে বেঁধে দিলেন। মাথাটা ঘুরায় বলে চুলে জবজবে করে তিলের তেল মেখে দিলেন। হাত ধরে ভাত খাওয়াতে বসালেন। কিছুই খেতে পারলো না বুড়ী। বুকটা ধু ধু বালুচরের মতো জ্বলছে। দু’এক গ্রাস মুখে দিয়েই থালাটা সরিয়ে রাখলো। তারপর আস্তে আস্তে উঠে লাঠিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। হাঁটতে পারে না ভালো করে। অন্তরে প্রবল ভাবের বন্যাবেগ বুড়ীকে যেন ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হিমাংশুবাবু জিজ্ঞেস করেঃ
“কি ঠাউরমা কডে যরদে?” (কি ঠাকুরমা, কোথায় যাও?)।
বুড়ী জবাব দেয় না। ঘোলা চোখ দুটো বাঁকা পথের ওপর বিছিয়ে রাখে। ঝাকড়া আমগাছটা ছাড়িয়ে কবরস্থান। কবরস্থান বাঁয়ে রেখে কাজীর পুকুরের উত্তরপাড় পেরিয়ে, কাজীদের পুরনো মসজিদটার ডান পাশেই হাসিমের ছোট্ট ঘরখানা। সে ঘরখানা টানছে। পা দুটো দুর্বল। তবু বুড়ো বয়সের জড়তার শাসন উপেক্ষা করে পা দুটো আপনা আপনিই চলছে। হিমাংশু বাবু আবার শুধোয়ঃ
ঠাডা রইদত কড়ে যাইবা, ঠাউরমা। এককেনা জিরাই লও। তারপর যেডে যাইবার যাইয়ো।” (এতো কড়া রোদের মধ্যে কোথায় যাবে ঠাকুরমা, একটুখানি বিশ্রাম কর। তারপর যেখানে যাওয়ার দরকার মনে করো যেয়ো।)
“ভাই আঁর সোনার বড় বিপদ। সোনার হেডে যাইয়ম।” (ভাই আমার সোনা বড় বিপদে পড়েছে। সোনার কাছে যাবো।)।
হাসিমকে বুড়ী সোনা বলেই ডাকে। হিমাংশুবাবুর আর কোনো কথার অপেক্ষা না করে রোদের তেজ অগ্রাহ্য করে বাঁকা পথটি বেয়ে হাঁটা শুরু করে।
বুড়ী হাসিমের ঘরে এসে আর ফিরে যায় নি। জীবনের সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজটি করে ফেলেছে। একরত্তি তুলতুলে রক্তমাংসের পুতুলের মতো বাচ্চা ছেলের মুখের দিকে চেয়ে জীবনের আশিটা বছর পেছনে রেখে এলো। শরীর বড়ো দুর্বল। উঠতে পারে না, বসতে পারে না, আধা রাতে ঘুম ভেঙে যায়। কোমরের ব্যথাটা উঠলে পৃথিবী অসার লাগে। শিশুকে নিয়ে কি করবে ভেবে পায় না। কখনো মুখে মধু দেয়। মোমের পুতুলের মতো বাচ্চা সরু জিহাটি দিয়ে আস্তে আস্তে চুষে খায়। কপালে কালির ফোঁটা দিয়ে দেয়। বলে- দেশে তো দুষ্ট লোকের অভাব নেই। গোরাচাঁদের ক্ষীণ কোমল শরীরে না জানি আবার নজর-টজর লেগে যায়। কাঁদলে ন্যাকড়া জড়িয়ে অস্থিচর্মসার হাতে তুলে নিয়ে দোলা দেয়। নানারকম ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে শোনায়। তার অর্ধেক বোঝা যায় অর্ধেক বোঝা যায় না। শিশু শুনবে কেন, কেঁদেই চলে। হাসিমকে ডেকে বলেঃ
“অ সোনা, নজর মেলি চা। একেবারে তোর বাপের নাহান। তোর বাপও কাইনতো। ভালা গরি চা, হেই মুখ, হেই নাক, হেই কান।” (সোনা একবার দৃষ্টি খুলে দেখ। একবারে তোর বাপের মতো। তোর বাবা এমনি করে কাঁদতো। ভালো করে দেখ। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই নাক, সেই কান।)
ছেলে তার বাপের মতো? হাসিম সচকিত হয়। বাপকে সে ভুলে থাকতে চায়। বাপের জীবনের দিনগুলোর স্মৃতি পারলে চেতনা থেকে বাদ দিতো। ছেলে পিতামহের চেহারা নিয়ে এসেছে। সে জীবনটাও নিয়ে আসে নি তো? চোখের সামনে সামাজিক নিপীড়নের ছবি রূপ ধরে জেগে ওঠে। ইচ্ছে করেও ভুলে থাকতে পারে না।
ছোট্ট ফুটফুটে শিশুর দিকে তাকালে তার দৃষ্টি আপনা থেকেই মেদুর হয়ে আসে। কি যেন আছে শিশুর ক্ষীণ কোমল দেহে। একহাত লম্বা অবয়বের মধ্যে কি যে ছড়িয়ে আছে! চোখ ফেরাতে পারে না। ছোট্ট শিশু, ছোট্ট ঠোঁট, ছোট্ট হাত-পা। কালো পাতলা চুল। দুটি বড় বড় কালির ফোঁটার মতো চোখ কেমন অবাক হয়ে পৃথিবীর দিকে চেয়ে থাকে নিথরে। তাকালে বুকটা আপনা-আপনি কেঁপে যায় হাসিমের। সুফিয়ার চেহারাখানা ঝিলিক খেয়ে যায় চোখের পাতায়। নীরবে বুকের ভেতরে হৃদয়ের রক্ত ঝরে যায়। মন চায় না, কারো কাছে পুষ্যি দেয়। তার কাছে সুফিয়ার আমানত সুফিয়ার দেয়া উপহার, রক্তমাংসের এ সজীব পুতুল। কেমন ওঁয়া ওঁয়া করে তীক্ষ্ণ স্বরে কাঁদে। কান্নার স্বরে ঘরের জমাট বাঁধা স্তব্ধতা কেঁপে যায়। শিশুর সামনে থেকে দূরে যেতে মন চায় না। কিন্তু যেতে হয়। হাসিমের নানা ধান্ধা। বড় কঠিন পরিশ্রম করে তাকে জীবন চালাতে হয়। পূর্বের জঙ্গলে গিয়ে বাঁশ গাছ কেটে আনতে হয়। কি করে সে শিশুকে রাখবে? দাদীও বা কয়দিন থাকবে? একসময় তো হৃদয়াবেগ শুকিয়ে যাবে। হিমাংশুবাবু বুড়ীর জন্য খাবার কয়দিন পাঠাতে পারবে? হাসিম ভাত খেয়ে আঁচায় না বলে ইতিমধ্যে কুঁই কুঁই করতে লেগেছে। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে হাজার রকমের অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়েছে। মুসলমান সমাজের চালচলন হিন্দু সমাজের বোধগম্য নয়– অন্তপুরিকাদেরতো কথাই নেই। হৃদয়ের টানটা বাইরের খলু এবং অধর বাবুদের দুনিয়াতে বজায় রাখা কি এতোই সহজ? প্রিয় সংস্কারগুলো ত্যাগ করা কি সম্ভব হবে? যে বয়সে সম্ভব সে বয়স তো পেছনে ফেলে এসেছে কতো যুগ আগে। মনে মনে হাসিম ঠিক করলো ছেলেকে মনির আহমদের কাছেই দিয়ে দেবে।