“বাইচ্চারে কি গইরগম হিমাংশুদা?” (বাচ্চাটিকে কি করবো হিমাংশুদা?)
হাসিমের মুখের দিকে চেয়ে হিমাংশুবাবু হঠাৎ কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। মাথা নীচু করে রইলেন। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বললেনঃ
“হাসিম বাই, যা অইবার অই গেইয়ে–অহন মাথা খারাপ গরিলে তো চইলতো নয়। আঁই কইলাম দে বাইচ্চার কি হাল অইবো? একদিনের বাইচ্চা।” (যা হবার হয়ে গেছে, এখন মাথা খারাপ করলে তো চলবে না। আমার কথা হলো একদিনের বাচ্চা, কি অবস্থা হবে?)
হিমাংশুবাবুর কথার প্রতিধ্বনি করে হাসিম বলেঃ
“হিমাংশুদা, বাইচ্চার কি হাল অইবো?” (হিমাংশুদা, বাচ্চার কি অবস্থা হবে?)
হিমাংশুবাবু বললেনঃ
“কেউরে পালিবার লায় দিলে কেন অয়?” (কাউকে পুষ্যি দিলে কেমন হয়?)
“কনে পালিব আঁর পোয়া, আঁই তো বান্যিয়ার পুত, আঁর মা তো বাদী। কনে নিব।” (কে পুষ্যি নেবে আমার ছেলে, আমি বেনের ছেলে, আমার মা তো বাদী।)।
কথা ক’টি হাসিমের সমস্ত জীবনের তিক্ততা, ক্ষোভ, বঞ্চনা, শোক এবং হাহাকার মিশে আশ্চর্যভাবে ব্যঞ্জিত হয়ে সকলের কানে বাজলো। মনির আহমদ তার কাঁধে আস্তে আস্তে হাত বুলোয়। হাতের ছোঁয়া দিয়ে সমস্ত জীবনের গ্লানি যেন শুষে নিতে চায়। হাসিমকে একটু শান্ত মনে হলে বললোঃ
“হাসিম বাই, তোঁয়ার পোয়া আই নিইয়ম, নিজের পোয়ার মতো গরি পাল্যাম।” (হাসিম ভাই, তোমার ছেলে আমি নেবো। নিজের ছেলের মতো করে পুষবো।)
তারপরে তারা তিনজন ঘরে ঢোকে। বুড়ী ন্যাকড়া জড়ানো শিশু সন্তানটিকে অস্থিচর্মসার হাতের ওপর নিয়ে পা দুটো লম্বা করে টেনে বসে আছে। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। হিমাংশু বাবু বললেনঃ
“অ ঠাউরমা, বাইচ্চারে মনির আহমদের কাছে পুষ্যইন দি ফেলাইল হাসিম বাই।” (ও ঠাকুরমা, বাচ্চাকে হাসিম ভাই মনির আহমদের কাছে পুষ্যি দিয়ে ফেললো।)
“কি কলি হিমাংশু তুই?” বুড়ী আঁতকে ওঠে। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে অসম্ভব, সবচেয়ে অবাস্তব কথাটি শুনেছে। ফের হিমাংশুবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলেঃ
“কি কলি হিমাংশু তুই?” কতদিন পর আঁর হীরাধর আবার আঁর কোলত ফিরি আইস্যে, কেউরে দিতাম নয়।” (হিমাংশু তুই কি বললি? কততদিন পর হীরাধর আমার কোলে ফিরে এসেছে। কাউকে দেবো না।)
দু’হাতে শিশুকে নিয়ে অতি সন্তর্পণে বুকের সঙ্গে ঠেকায়। বুড়ীর ভাবভঙ্গী দেখে মনির আহমদ বললোঃ
“ঠিক আছে, ঠিক আছে, এহন চল যাই।” (ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন চলো যাই।)
হাসিম শুধোয়ঃ
“কি, নিতা নয়, মনির আহমদ ভাই?” (কি, নেবে না, মনির আহমদ ভাই?)
“পরে নিইয়ম, তোঁয়ার দাদী এককেনা ঠাণ্ডা অউক আগে। বুড়ীর মনেতে বউত দুঃখ।” (পরে নেবো। তোমার দাদী একটু ঠাণ্ডা হোক। বুড়ীর মনে অনেক দুঃখ।
তারা বেরিয়ে এলো।
কি ভেবে মনির আহমদ শিশুটিকে নিয়ে যায় নি। বলেছে হাসিমের ঘরেই থাক। তার স্ত্রী এসে দেখে যাবে, যাতে শিশুর কোনো অসুবিধে না হয়। পাশের বাড়ির কাঠমিস্ত্রীর মেয়ে কালাসোনার হাতে দু’চার দিনের জন্য দেখাশোনার ভার দেওয়া হলো। মনির আহমদ বোঝালো, হাসিমের দাদী, যখন নিজে হাতে দেবে তখনই সে শিশুটিকে নেবে। বুড়ীকে বেজার করে নিয়ে কোনো লাভ নেই।
হাসিমের ঘর থেকে যেতে যেতে বেলা দুপুর গড়িয়ে গেলো। নিজের নাতি। তাকে এমন বিপদে ফেলে বুড়ী কি হুট করে চলে যেতে পারে? তা ছাড়া ঐ মা-হারা গোরাচাঁদ। ও যেন তার হীরাধর। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল আবার ফিরে এসেছে। অমন রক্তমাংসের ছোট পুঁটুলি গোরাচাঁদকে ফেলে বুড়ী কি চলে যেতে পারে? প্রবল হৃদয়াবেগ তাকে আটকে রেখেছিলো। ঘরে ফেরার কথা মনে হওয়ায়, ইতিমধ্যে কি কি করেছে, আগাগোড়া ব্যাপারটা মনে মনে ভেবে দেখলো। শিউরে উঠলো। একি করেছে? হাসিমের কাছে এসেছে, তার ছেলেকে কোলে নিয়েছে, এ খবর শুনলে অধর কি ঘরে ঢুকতে দেবে?
এসব কথা চিন্তা করতে করতে বরগুইনির কাঠের সাঁকোর গোড়াতে এলো। সেখানেই অধরের সঙ্গে দেখা। বুড়ী কাঁপতে লাগলো। অধরের চোখ-মুখ গম্ভীর। কোণা চোখে একবার বুড়ীর দিকে চাইলো। বুড়ী লাঠিটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। অনুমানে অধরের প্রতিক্রিয়াটা জেনে নিতে চায়। অধর কিছু বলছে না দেখে সাঁকোর দিকে পা বাড়ায়। অধর এবার জলদগম্ভীর স্বরে বললোঃ
“বরগুইনির এই পাড়ত আর ন আইস্যো।” (বরগুইনির এ পাড়ে আর আসবে না।)
বুড়ী সাহসে ভর করে জবাব দিলোঃ
“নাতি, তোরার কাছে ন আই কডে যাইয়ম?” (নাতি, তোদের কাছে না এসে কোথায় যাবো?)
বুড়ীর কথায় অধরবাবু একটুও গলেনি। বরঞ্চ বিরক্তই হয়েছে বেশী। বার বার হাসিমের কাছে না আসতে বারণ করেছে। বুড়ী যে বারণ মানতো না, তা জানতো অধরবাবু। লুকিয়ে চুকিয়ে যেতে নিজের চোখেও দেখেছে, কিছু বলে নি। কারণ কেউ যখন জানছে না, তার সম্মানহানির আশঙ্কা নেই। কিন্তু আজ অধরবাবুর মান সম্মান একেবারে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে। পাড়ার মধ্যে ছি ছি পড়ে গেছে। সারা শরীর অপমানে জ্বলছে। বুড়ীকে খুন করলেও গায়ের জ্বালা মিটবে না। অধরবাবুর ঠাকুরমা মুসলমানের ঘরে যায়, শৌচ অশৌচ জ্ঞান নেই। পাড়ার লোকে দুষবে। অসহ্য, একেবারে অসহ্য। সমাজের কর্তাব্যক্তি অধরবাবু। তার ঠাকুরমা কিনা মুসলমানের মরা দেখতে যায়। যে সর্ষে দিয়ে ভূত ছাড়ান হয়, সে সর্ষেতেই ভূত। রাগে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বুড়ীকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।