“বাঁচি থাকতে চাইত যুদি পারে, মইরলেও চাইত ন পাইরত ক্যা? ওলাউঠার মরা কত মাইনষরে হিমাংশুবাবু তো নিজে হাতে ধোয়াই তারপর কবরত নামাইয়ে। তারা কি হক্কলে দোযখত যাইবো?” (বেঁচে থাকতে যদি দেখতে পারে, মরলে দেখতে পারবে না কেন? ওলাউঠার মরা কত মানুষকে হিমাংশু বাবু তো নিজের হাতে ধুইয়ে কবরে নামিয়েছে। তারা কি সবাই নরকে যাবে?)
মনির আহমদের কথার কেউ জবাব দিতে পারলো না। বাস্তবিকই গেলো ওলাউঠার সময়ে হিমাংশুবাবুকে অনেক মৃতদেহ নিজের হাতে বোয়াতে হয়েছে। পাড়ার মানুষ ভয়ে পালিয়েছিলো। কৃষক-সমিতির কর্মীরাই মৃতদেহ সৎকারের কাজ করেছে। হিন্দু-মুসলমান অত কিছু জাত বিচারের সময় ছিলো না। ছদুর বাপ গোমড়া মুখে বসে রইলো। অন্য সময়ে হলে এহেন অমুসলমানী ক্রিয়াকাণ্ডের জন্য একটা দক্ষযজ্ঞ না বাধিয়ে ছাড়তো না।
বুড়ী মৃতা সুফিয়ার মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। হলদে পাখির ছাওয়ের মতো মেয়েটি আর কোনদিন কথা বলবে না। রাতের অন্ধকারে লাঠির ঠক ঠক আওয়াজ শুনে, কেরোসিনের কুপী হাতে ‘দাদী’ বলে ডাক দিয়ে হাসি হাসি মুখ নিয়ে ঘাটার কাছ থেকে এগিয়ে নিতে আসবে না। টুনটুনি পাখির মতো মেয়েটি আর কোনদিন তেলহীন রুখু চুল মেলে দিয়ে দাওয়ার ওপর পা ছড়িয়ে বসে থাকবে না। কেন জানে না, হরিমোহনের মৃত্যুশোক যেন তিরিশ বছরের ব্যবধান এক লাফে পেরিয়ে বুকের ভেতর কাঁচা হয়ে জেগে উঠলো। জমে যাওয়া শোকের বরফের কণাগুলো বুকের ভেতর গলে যাচ্ছে। বুড়ীর তোবড়ানো গাল বেয়ে নেমে আসছে দুটো চোখের পানির ধারা। অনেক দিন অনেক দিন এ অশ্রু গোপন করে রেখেছিলো– আর পারা গেলো না। ফোয়ারার মতো বলকে বলকে উঠে আসছে–পানি নেমে আসছে দু’টি কোণ বেয়ে, বয়সের অভিজ্ঞতার হাজার রেখা আঁকা মুখের ওপর দিয়ে। বুড়ীর শক্তি নেই, ইচ্ছে করলেও এ রোদন-ধারা থামাতে পারবে না। কতদিন, কতদিন এ ক্রন্দন বুকের ভেতর আষাঢ়ের মেঘের মতো থরে থরে জমে ঘন হয়ে উঠেছে। মেঘে মেঘে ঘষা লেগে কত রাতে শোকের চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ মনের ভেতর ঝিলিক হেনেছে। সারাজীবন বুড়ী যেন এমনি করে চোখ ভরে কাঁদবার জন্য অপেক্ষা করেছিলো। জোহরা আঁচল দিয়ে কয়েকবার চোখ মুছিয়ে দিলো। কিন্তু বুড়ীর চোখ বারণ মানে না। অন্তরের কোন্ পাগলা ঝোরার উৎসমুখ যেন খুলে গেছে। বুড়ী কাঁদছে–অঝোরে কাঁদছে।
সুফিয়াকে গোসল দিতে নিয়ে গেলোলোকজন। বুড়ী ঠায় বসে রইলো। দু’চোখে বইছে ধারা। বুড়ী মনের সমস্ত দুঃখ, সমস্ত যন্ত্রণা জমা করে ঝেরে দিতে চায়। শরীরের সমস্ত রক্তও বেরিয়ে যাক জল হয়ে। জন্মের মতো একবার বুক ভরে কেঁদে মরে যেতে চায়। জোহরা ন্যাকড়া জড়ানো সুফিয়ার ছেলেটিকে কোলে দিলো। ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদছে। একেবারে এতোটুকুন। পুতুলের মতো। বুড়ী আঁচলের খুঁটে দু’চোখ মুছে নবজাতকের দিকে তাকায়। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই নাক, অবিকল তেমনি। হরিমোহন যেন আবার শিশু হয়ে ফিরে এসেছে। বুড়ী চেয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে আশা মিটে না। এ কি হরিমোহন নয়? তার কনিষ্ঠ ছেলে হরিমোহন কি আবার ফিরে এলো?
শিশুকে আলতোভাবে নিয়ে বুকের সঙ্গে লাগাল। শিশু প্রস্রাব করে বুড়ীর কাপড়-চোপড় ভিজিয়ে দেয়। সেদিকে খেয়াল নেই। দু’হাতে শিশুকে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবে। এ কেমন করে হলো? এ কেমন করে হলো? স্বপ্ন কি কখনো সত্য হয়? তাহলে হরিমোহন কথা রেখেছে। তার কোলে আবার শিশু হয়ে ফিরে এসেছে? অস্থিসর্বস্ব হাতের আঙুলে শিশুর শরীরে হাত বুলোয়। নিজের স্তনে হাত ঘষে দেখে। হরিমোহন ফিরে এসেছে কিন্তু তার স্তনে যে দুধ নেই। শুকিয়ে দড়ির মতো হয়ে গেছে। শিশু চিৎকার করে কাঁদছে– ওঁয়া ওঁয়া! বুড়ীর মনে হচ্ছে, হরিমোহন যেন বলছে, “মা, হিন্দু হই, মুসলমান হই, আমি তো তোরই সন্তান, কোলে তুলে নে।” শিশু কাঁদছে ওয়া ওয়া। কিছুতেই কান্না থামে না। জোহরা শিশুর মুখে একটু মধু দেয়। ছোট্ট জিভ দিয়ে চুষে খায়। একটু পরে আবার কাঁদতে থাকে। জোহরা বলেঃ।
“মারে খাইয়ে জন্মের পর কেন চীকার গরে বাঘের মতন।” (জন্মের পর মাকে খেয়ে কেমন বাঘের মতো চীৎকার করে।)
সুফিয়াকে কবর দেবার পর কথা উঠলো নবজাতক শিশুটির কি হবে? হাসিম একা মানুষ। কেমন করে রাখবে শিশু? তা ছাড়া তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। জননীকে হত্যা করে পৃথিবীতে এসেছে যে শিশু তার দায়িত্ব নেওয়া কি হাসিমের কাজ? মনির আহমদের বৌটি বাঁজা। মনির আহমদ নিজেও একটি ছেলের কাঙাল। নিজের হলো না, কারো ছেলে নিয়ে পুষতে বড় শখ তার। এ পর্যন্ত হাতের কাছে কোনো ছেলে পায় নি। হাসিম তার মা-হারা শিশুটিকে যদি দেয়, অবশ্যই নেবে। বৌটি কেমন বড় বড় নিশ্বাস ফেলে। শিশুটিকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বুকের ব্যথা কিঞ্চিত শান্ত করতে পারবে। কিন্তু নিজের থেকে কিছুই বললো না। হিমাংশুবাবু হাসিমকে জিজ্ঞেস করলোঃ
“হাসিম বাই, বাইচ্চারে কি গরিবা?” (হাসিম ভাই, বাচ্চা কি করবে?)
“কি গইরগম?” (কি করবো?) এতোক্ষণ হাসিম একটি কথাও বলে নি। কলের পুতুলের মতো সব কাজ করে যাচ্ছিলো। বাচ্চার কথা ওঠায় নতুন করে তার মনে পড়লো সুফিয়া নেই। নতুন করে অনুভব করলো ছিন্নমূল গাছের মতো পৃথিবীর সঙ্গে তার সম্পর্কও শেষ হয়ে গেছে। ছল ছল চোখে চারদিকে তাকালো। বেড়ার ঘরখানির দরজা হাট করে খোলা। সে ঘরে সুফিয়া নেই। কেউ আর তার জন্য মিটিমিটি চেরাগ জ্বালিয়ে আধারাত ঘুম ভরা ঢুলুঢুলু চোখে অপেক্ষা করে থাকবে না। ক্লান্ত হয়ে ঘরে এলে মাটির সানকীতে মোটা চালের ভাপওঠা ভাত বেড়ে তালের পাখা হাতে ছুটে আসবে না। দাম্পত্য জীবনের হাজার সুখ-স্মৃতি টুকরো টুকরো ছবি হয়ে চোখের ওপর দিয়ে ভেসে গেলো। মধু জড়ানো ঘটনা, একটু হাসি, একটু পরশ। তার অস্তিত্বের চারপাশে বিবাগী হাওয়া হু হু করতে লাগলো। অন্তরের কোন গভীর তন্ত্রীতে টান লেগে চোখের কোণায় দু’ফোঁটা পানি চিক চিক করে উঠলো। লুঙ্গিতে মুছে উদ্ভ্রান্তের মতো আবার জিজ্ঞেস করলোঃ