“অ জলিল ভাই, তুই আজুয়া কিছু ন দিলে চইল কিনিত পাইত্যাম নয়, পোয়া মাইয়াম উয়াস থাইবো। দুয় টেঁয়া দ্য, বাকী টেঁয়া পরে দিয়।” (জলিল ভাই, তুমি আজ যদি কিছু না দাও চাল কিনতে পারবো না, ছেলেমেয়েরা উপোস থাকবে। আজ দুটি টাকা দাও, বাকী টাকা পরে দিও ।)
“আরে অজিয়া কন পরকারে সামালি ল, অমাবস্যার যো আইয়ুক… বেবাক টেয়া শোধ গরি দিয়ম।” (আজ কোনরকমে সামলে নাও, অমাবস্যার সময় আসুক সব টাকা এক সঙ্গে শোধ করে দেবো।)
কথাগুলো বলে তিন ব্যাটারী টর্চটা হাতে নিয়ে কাঁধে মাফলার জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে যায় জইল্যা চোরা। জোয়ান সদ্য বিধবা মতির মার ঘরের কাছে গিয়ে ‘বন্ধু… রে’ বলে গানে টান দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করলো নবী, ‘আলা ডাহাইত’ কিন্তু চোখদুটো তার ছল ছল করে।
হাসিম দোকানে ঢুকে সুপারী গাছের ফালিতে তৈরি বেঞ্চির মতো আসনে চুপচাপ বসে থাকে। অনেকক্ষণ! মাগরেবের আজান শেষ হয়ে গেছে। নামাজও শেষ প্রায়। একজন দু’জন করে দোকানে মানুষ জমতে থাকে। ছতুর বাপ তসবীদানা টিপে টিপে দোকানে ঢুকে বেঞ্চিটা ঝেড়ে বসলো। তার মুখ দিয়ে দোয়া দরুদ ঝরছে। এক সময় তসবীহর ছড়া লম্বা কোতার পকেটে রেখে তার দিকে দৃষ্টি ফেরায়। সে দৃষ্টিতে এমন কিছু আছে যা রহস্যময়, ভয়ঙ্কর, দুর্বোধ্য তাকে ভয় ধরিয়ে দেয়। দৃষ্টির শরে বিদ্ধ হয়ে বুকটা তার দুরু দুরু করে। রহস্যময় দুটো চোখের শিখা হাসিমের চোখের ওপর রেখে হিমশীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে সে শীতলতার স্পর্শে বুকের রক্ত জমে যায়ঃ
“বান্যিয়ারপুত, তুই এডে ক্য? নমাজ-কালাম কিছু নাই, শুক্কুরবারেও জুমাত ন আইয়স ক্যা?” (বেনের ছেলে, তুমি এখানে কেন? নামাজ কালাম কিছু নেই, শুক্রবারেও মসজিদে এসো না কেন?)
হাসিম জবাব দেয় না। জবাব না পেয়ে ছতুর বাপের শান্ত শীতল কণ্ঠস্বরে একটু উত্তাপ জাগে। অধিকতররা দৃঢ়কণ্ঠে বললোঃ
“কাইলখুন মসজিদ ন দেখিলে পাড়াত থাকিত ন পারিবি। সময় থাকতে কই দিলাম। মুসলমানের পাড়া।” (কাল থেকে মসজিদে না দেখলে পাড়ায় থাকতে পারবে না, আগে থাকতে বলে দিলাম, মুসলমানের পাড়া।) সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে আবার রহস্যময় দৃষ্টিরেখায় হাসিমকে বিদ্ধ করে লাঠি ঠক ঠক করতে করতে চলে যায়।
ছতুর বাপ চলে যাওয়ার পর কথা বললো, নাজিমঃ
“বেড়ার পুতে দুনিয়ার হক্কল কুকাম করে হেই খেয়াল নাই। পরের খুঁতা পাইলে তাঁই কাজী, তাই মাঝি। আর মাইয়ারে যা একখানা বানাইয়ে।” (তার ছেলে পৃথিবীর সকল কুকর্ম করে বেড়ায়, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই, পরের খুঁত পেলেই তিনিই কাজী, তিনিই মাঝি বনে যান। আর মেয়েটিকে যা বানিয়েছে না।)
পাশের একজন নাজিমের মুখে তাড়াতাড়ি হাত চাপা দিলো। নাজিম চমকে উঠে। ছতুর বাপের বড় ছেলে সুলতান দোকানে ঢুকছে। নাজিম তার মুখের দিকে তাকায়। মন্তব্য শুনতে পেয়েছে কিনা মুখের প্রকাশিত ভাবের মধ্যে সন্ধান করে দেখে। নিশ্চিত হয় সে। সুলতানের থমথমে কালো মুখমন্ডলে বসন্তের অনেকগুলো বড়ো বড়ো গর্ত। চার পাঁচটা ব্রণ পেকে পুঁজের রসে পুষ্ঠ হয়েছে। ঢেঙা মতো নাকটা। কথা বলার সময় তার সারা মুখে লোলুপতা প্রকট হয়ে উঠে। বাঁ পাশের বিশ্রী দাগটা দেখা যায়। দোকানে একথা সেকথা নানা কথা হয়। বেশির ভাগ অভাব, দুঃখময় দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার কথা ঘরে চাল না থাকার কথা, বউয়ের পিঠে কাপড় না থাকার কথা, বৃষ্টির অভাবে অকর্ষিত মাঠের কথা। আউশ ধান ছড়ানো হয় নি। অনাবৃষ্টিতে মাঠ ফুটি-ফাটা হয়ে আছে। লাঙলের হল ফোঁটায় তেমন সাধ্য কোন বাপের বেটার নেই।
“নারে নারে নাটুয়ার দিঘির পারে, সুন্দরীরে দেখতে দেখতে বাড়াইল মেলা মারে!”
গাইতে গাইতে আরেকজন দোকানে পা দিয়ে হাসিমকে দেখামাত্রই কলকন্ঠে চীকার করে উঠললাঃ
“এই যে সুলতান, চিন্তার কারণ নাই আর, বান্যিয়ার পুতরে পাইলাম। যামিনী ন আইলে ন আইয়ুক। বানিয়ার পুতে গাইত ন পারিব? কি কস?” (এই যে সুলতান, চিন্তার কারণ নেই। বেনের ছেলেকে পেয়ে গেলাম। যামিনী না আসলে না আসুক, বেনের ছেলে গাইতে পারবে না, কি বলিস?)
“মন্দ কি!”
জবাব দিলো সুলতান।
ঘাড়ের তেল মুছে তর্জনী নেড়ে নেড়ে বলতে থাকে আগত লোকটিঃ
“হুন বানিয়ার পুত, সাতবাড়িয়ার, ছিদ্দিক আর ধলঘাটের যামিনীর পাল্টা গান অইবার কথা আছিল জাহেদ সাবির বাড়ীত। যামিনী খবর দিয়ে আইত পাইরত নয়। হেই কথার লাই তোর গান গাহনের লাই থাহন পড়িব।” (শোন বেনের ছেলে, সাত বাড়িয়ার সিদ্দিক আর ধলঘাটের যামিনীর পাল্টা গান হওয়ার কথা ছিলো জাহেদ সাহেবের বাড়ীতে। যামিনী খবর দিয়েছে আসতে পারবে না। সেজন্য তোমাকে গান গাইতে থাকতে হবে।)
মানিব্যগ খুলে দু’খানা একটাকার কাগজের নোট তার হাতে গুঁজে দিয়ে বলেঃ
“এই দুই টেয়া দিলাম বাকী দুই টেয়া পরে পাবি।” (এই দুই টাকা দিলাম। বাকী দু’টাকা পরে দেবো।
হাসিমের হাতে টাকা দুটো শুয়ে থাকে। ওরা দু’জন পরস্পরের দিকে চেয়ে অর্থপূর্ণ হাসি হাসে। কেন হাসে হাসিম জানে। সিদ্দিকের সঙ্গে গান গাইতে হলে তিরিশ টাকার কম কেউ রাজি হবেনা। তাকে চার টাকাতে রাজী করালো। সুলতান দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁক দিলোঃ